আঞ্চলিক সংবাদ

মামলা ও আতঙ্কে জর্জরিত গোবিন্দগঞ্জের সান্তালদের জীবন: কেমন আছে দ্বিজেন টুুডুর পরিবার?

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে ফিরে,

সুমেধ চাকমা: বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা। এই গোবিন্দগঞ্জে বসবাসকারী আদিবাসী সাঁওতালরা দীর্ঘদিন ধরেই পৈত্রিক জমি ফিরে পাবার লড়াই করে যাচ্ছেন। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মে উচ্ছেদ অভিযানের নামে সাঁওতাল গ্রামে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং তিনজন সাঁওতালকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু নামের তিনজন সাঁওতাল নিহত হন। পরবর্তীতে সরকার নতুন করে ইপিজেড স্থাপনের ঘোষণা দেয় । কিন্তু গত ছয় বছরে তিন সাঁওতাল হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলার বিচার শুরু হয়নি। হামলার ওই দিনটিকে প্রতিবছর ‘সাঁওতাল হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করছেন সাঁওতালরা। তবে এখন কেমন আছেন সাহেবগঞ্জ ও বাগদাফার্ম অঞ্চলের সেই সান্তাল ও সাধারণ বাঙালিরা ?

গত ৫ অক্টোবর সরজমিনে ঘুরে দেখা যায় যে, সেখানকার সান্তাল ও সাধারণ বাঙালিরা এখনও আতংকের মধ্যে দিনাতিপাত করছ। মূলত ১৯৫৫ সালে চিনিকল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম এলাকাটিকে বেছে নেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। সেই লক্ষ্যে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ ১৯৫৫ সালে বাগদাফার্ম এলাকার প্রায় ১৮৪২.৩০ একর জমি অধিগ্রহণ শুরু করে। অধিগ্রহণকৃত অধিকাংশ জমি আদিবাসী সাঁওতালদের।

স্থানীয় বয়োঃবৃদ্ধ সাঁওতালদের তথ্যমতে, ১৯৫৫ সালে জমি অধিগ্রহণের সময় ওই জায়গাতে ২০টি গ্রাম ছিল। এর মধ্যে ১৫টি গ্রাম সাঁওতালদের এবং ৫টি গ্রাম মুসলমান ও হিন্দু বাঙালিদের। সেসময় পাকিস্তান সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, আখ ব্যাতিত অন্য কোন  ফসল সেখানে উৎপাদিত হলে জমির প্রকৃত মালিকদের ক্ষতিপূরণসহ জমি ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু ২০০৪ সাল থেকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে মিল কর্তৃপক্ষ নামমাত্র মূল্যে অধিগ্রহণকৃত জমি লীজ দিতে শুরু করে। তখন থেকেই আদিবাসীরা মিল কতৃপক্ষের এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন।

নানা দাবী নিয়ে মানববন্ধনে আসা কয়েকজন সান্তাল ও বাঙালি। ছবি: সুচী রাজ, গোবিন্দগঞ্জ, ৮ অক্টোবর ২০২২।

গত  ৪ অক্টোবর (মঙ্গলবার) সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট নাজমুল হাসানের বিচারিক আদালতে তিন সাঁওতাল হত্যা মামলার নারাজির  ওপর শুনানির দিন ধার্য ছিল।  দুপুর নাগাদ গোবিন্দগঞ্জ যখন পৌঁছেছি, তখন গোবিন্দগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল আদালত সংলগ্ন সড়কে সাঁওতাল-বাঙালিদের যৌথ উদ্যোগে চলছিল বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি । তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার, বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, লুটপাট ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে তাদের এই কর্মসূচী। কিন্তু তাদের মানববন্ধন কর্মসূচি শেষ হতে না হতেই খবর এলো আলোচিত এই হত্যা মামলার নারাজির পর শুনানি আবারও পিছিয়েছে। এভাবে অনেক সাধারণ সান্তাল ও বাঙালি বিচারপ্রার্থীদের ক্ষোভ নিয়ে ফিরতে দেখা যায়।

সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি পুনরুদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি  ডা. ফিলিমন বাস্কে। ছবি: আন্তনী রেমা 

এদিকে আদালত প্রাঙ্গণে দেখা হল সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি পুনরুদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি  ডা. ফিলিমন বাস্কের সাথে। শুনানি পেছানোর কথা বলতেই তিনি চরম হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন,  সুষ্ঠ বিচার পাবো কিনা এ  নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান। কেননা হত্যাকাণ্ডের ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আজও গ্রেপ্তার করা হয়নি। মামলার মূল ১১ আসামীকে বাদ দিয়ে চার্জশীট দেওয়া হয়েছে। এর বিরুদ্ধে নারাজি করা হলেও তদন্তের নামে সময় নষ্ট করা হচ্ছে। এদিকে সরকার নতুন করে ইপিজেড স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ঘোষণা সাম্প্রতিক সময়ে এলাকায় ফের উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। প্রায় দুই হাজার একরের এই জমিতে ইকোনমিক জোন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর জমি পরিদর্শনসহ পরবর্তী কাজও শুরু করেছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (বেপজা) কর্তৃপক্ষ। একটি মহল বেপজা কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করে সাঁওতাল-পল্লীর তিন ফসলি জমিতে শিল্প-কারখানা স্থাপনের পাঁয়তারা করছে বলেও জানালেন ফিলিমন বাস্কে।

ফিলিমন বাস্কে ক্ষোভ নিয়ে বলেন,  আমার নামেও ৪টি মিথ্যা মামলা রয়েছে। এই মিথ্যা মামলা দিয়ে যতই হয়রানি করার চেষ্টা হোক, নিজেদের পৈতৃক জমিতে  ইপিজেড স্থাপন করতে দেওয়া হবে না।  সাঁওতাল ও বাঙালি পরিবারগুলোকে তাদের নিজ ভূমিতে পূর্ণবাসন করতে হবে। তাদের জন্য ঘরবাড়ি, স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও আবাসনের সকল ব্যবস্থা সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।

এদিকে ২০১৯ সালে সরকারের এক সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়ে যায় রংপুর চিনিকলসহ দেশের বেশ কয়েকটি চিনিকল। তখন থেকে সব জমি ভোগদখল করে আসছেন সাঁওতাল-বাঙালিরা। কিন্তু জমিতে সেচ দেয়ার ব্যবস্থা না থাকায় সব জমিতে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না বলেও জানালেন ফিলিমন বাস্কে। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হলেও প্রশাসন যা ব্যবস্থা করেছেন তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলেও জানান তিনি।

‘তিন ফসলি জমিতে ইপিজিডে নয়’ এই দাবী নিয়ে মানববন্ধনে আসা এক সান্তাল বৃদ্ধ। ছবি: সূচী রাজ। গোবিন্দগঞ্জ, ৪ অক্টোবর ২০২২।

সেদিন কথা হলো ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বরের ওই ঘটনায় হওয়া মামলার বাদী থমাস হেমব্রমের সাথে। শুনানি আরো একবার পিছিয়ে যাওয়ায় অন্য সবার মতো তিনিও হতাশ। বিচার পাবার আশা করেন কিনা জানতে চাইলে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলেন না। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, সঠিক বিচার পাবার আশা করি না। নিজে বাদী হয়ে তৎকালীন গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ ও চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আউয়ালসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয়ে আসামি করে মামলা করেছিলাম। মামলাটি পরবর্তী সময়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। কিন্তু তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই পিবিআই মূল ১১ আসামিকে বাদ দিয়ে ৯০ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভও জানান মামলার এই বাদী।

 এদিকে ৬ নভেন্বর ঘটনার ঘটনাস্থলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই সেখানে আমাদের নিয়ে গেলেন ফিলিমন বাস্কে। ঘটনাস্থলে আমাদের উপস্থিতি ছোট-খাটো এক জটলার সৃষ্টি করলো। তাদের মধ্যে অনেকেই ৬ নভেম্বরের ঘটনায় ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, বাগদা সরেনের নামে বাগদা ফার্ম জায়গাটির নামকরণ করা হয়েছে। যদিও বাগদা সরেনের বংশধরদের কেউ আর এখন এ দেশে থাকেন না, সবাই পরিবার নিয়ে পাশের দেশ ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। ১৯৫৫ সালে জমি রিকুইজিশনের সময় অনেকেই দেশান্তরিত হয়েছিলেন।

জটলার মধ্য থেকে মোহাম্মদ আনিসুর রহমান মন্ডল নামে এক বিচারপ্রার্থী বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা হয়েছে। আসামী করা হয়েছে ১১০ জনকে। যদিও এখনো কোন মামলার চার্জশিট দেয়া হয়নি। কিন্তু এভাবে শুধু শুধু হয়রানি করার কোনো মানে হয় না।

জটলার সবচেয়ে বয়স্ক ব্যাক্তি রাফায়েল হাজদা বলেন, ঘটনার অনেক আগে থেকেই সাঁওতালদের নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছিলো। একবার সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ “শালা সাঁতালের বাচ্চা তোদের দেখে নিমু” বলেও হুমকি দিয়েছিলেন।

তিনি আরো বললেন, তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করা সম্ভব নয়। মৃত ৩ জনের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে কোন ধরণের সাহায্য করা হয়নি। লোকজন মিথ্যা মামলায় জর্জরিত। মামলার খরচ জোগাতে অনেকেই গরু-ছাগল বিক্রি করেছেন, কাউকে জমি বন্ধক দিতে হয়েছে। কেউ কেউ এখন শেষ সহায়সম্বল টুকু হারিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবন নির্বাহ করছেন। এমনকি ‘মংলি টুডু’ নামে এক নারীর বিরুদ্ধেও মামলা রয়েছে বলে জানান তিনি।

সাবিনা সরেন (৫৯) ছবি: আন্তনী রেমা 

এদিকে বৃদ্ধা সাবিনা সরেন দুঃখ  নিয়ে আইপিনিউজকে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যারা আমাদের খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছে, এরা এম পি হওয়ার পর আমাদের ওপরই হামলা করেছে, গ্রামে আগুন দিয়েছে। আমাদের দেখার কেউ নেই।

কেমন আছে দ্বিজেন টুডুর পরিবার: 

গত ৬ নভেম্বর ২০১৬ সালের সকালের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু নামের তিনজন সাঁওতাল নিহত হন। আরও বেশ কয়েকজন সাঁওতাল-বাঙালি গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। তাদের অন্যতম দ্বিজেন টুডু। এক চোখ চিরতরে হারানো দ্বিজেন টুডুর সাথে দেখা করতে গিয়ে তাকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। কথা হলো তার স্ত্রী অলিভিয়া হেমব্রমের সাথে। সেদিন কি হয়েছিল জানতে চাইলে বললেন, এই ঘটনার সময় পুলিশ-প্রশাসনের উপস্থিতিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও একাধিক জনপ্রতিনিধির প্রত্যক্ষ মদদে তাদের অনুসারীরা এই হামলা ও লুটপাটে অংশ নেয়।

পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো দ্বিজেন টুডুর স্ত্রী অলিভিয়া হেমব্রম। ছবি- আন্তনী রেমা

ঘটনার পরে জীবন কেমন চলছে জানতে চাইলে তিনি  বলেন, পঙ্গু স্বামী, তিন ছেলে নিয়ে খুবই কষ্টে আছি। ছেলেদের পড়ালেখার খরচ চালাতে পারছি না। আমার স্বামীর (দ্বিজেন টুডু) এক চোখ নষ্ট হয়েছে। দিনের বেলা রোদ থাকলে কাজ করতে পারেন না। আমাকেই সংসার টানতে হচ্ছে। এদিকে দ্বিজেন টুডুর নামে পুলিশের অস্ত্র লুট, পুলিশের ওপর হামলা, জমি দখলের মামলা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

অলিভিয়া হেমব্রম আইপিনিউজকে বলেন, আমরা চাই সরকার এভাবে আমাদের হয়রানি না করে নিজেদের বাপ-দাদার জমি আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিক। তবে আমাদের পেছনে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউই ভাত মুখে তুলে দেবে না, নিজেকেই জোগাড় করে খেতে হবে। তাই মামলা, হয়রানি করে আমাদেরকে দমানো যাবে না। বাপ-দাদার জমিতে ইপিজেড স্থাপন করতে দিবো না।

Back to top button