জাতীয়

নির্বাচনের তারিখ পুণনির্ধারনের লক্ষ্যে সংখ্যালঘু ঐক্য মোর্চার প্রস্তাবনা উপস্থাপনসহ আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সংগঠনসমূহের জাতীয় সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে পল্টন টাওয়ারস্থ ঐক্য পরিষদ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ করে ৩০ জানুয়ারী সরস্বতী পূজোর দিনে ধার্যকৃত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন কোনভাবে পেছানো যাবে না বলে নির্বাচন কমিশন থেকে যে কথা বলা হচ্ছে তা’ নিতান্তই ‘খোঁড়া যুক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেছে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও সংখ্যালঘু ঐক্য মোর্চার সমন্বয়ক এ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত বলেছেন, স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা, ২০১০-র ১০ নম্বর বিধির (১)(ঘ) উপবিধিতে বলা আছে ‘ভোট গ্রহণের তারিখ, যাহা প্রার্থিতা প্রত্যাহারের তারিখের অন্তত ১৫(পনের) দিন পরে হইবে।’ ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের তারিখ ছিল ৯ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার আর প্রতীক বরাদ্দ হয়েছে ১০ জানুয়ারী শুক্রবার। সেক্ষেত্রে এ নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হতে পারত ২৫ জানুয়ারী। কিন্তু ১৫ (পনের) দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তারিখ নির্বাচন কমিশন ধার্য করেছে ৩০ জানুয়ারী। যদি নির্বাচন কমিশন ১৫ (পনের) দিনের দিন নির্বাচনের তারিখ ধার্য না করে এর ৫ (পাঁচ) দিন পরে করতে পারে, সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বলা যায়, নির্বাচনের তারিখ ধার্যে কোন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। এসএসসি পরীক্ষার সময়সূচী অনুযায়ী ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২০ হতে শুরু হয়ে তা ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২০ পর্যন্ত চলবে। লক্ষ্যণীয় বিষয় এর মধ্যে বেশ কয়েটি পরীক্ষার মাঝে মাঝে ফাঁকা দিন রয়েছে। অতীতেও আমরা লক্ষ্য করেছি, রাজনৈতিক হরতাল ইত্যাদি কর্মসূচীর পরপরই পরীক্ষার তারিখ পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, নির্বাচনের তারিখ পুণনির্ধারণ করা সম্ভব ২৫ থেকে ২৮ জানুয়ারীর মধ্যে যে কোন দিন ধার্য করে কিংবা ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২০ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য বাংলা (আবশ্যিক)- ১ম পত্র ও সহজ বাংলা ১ম পত্রের তারিখটি পিছিয়ে দেয়া হলে অথবা পরীক্ষা চলাকালীন সময়ের যেকোন একটি দিনে যেদিন পরীক্ষা থাকবে না। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, চার মাস আগে শারদীয় দূর্গোৎসবের মহাসপ্তমীর দিনে রংপুর- ০৩ আসনের উপ-নির্বাচনের তারিখ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষণার পর প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে আমরা আশা করেছিলাম, পরবর্তীতে হয়তো নির্বাচন কমিশন এহেন দুঃখজনক ঘটনার পুণরাবৃত্তি করবে না। কিন্তু এবারে সরস্বতী পূজোর দিন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা থেকে আমাদের কাছে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়েছে, দূর্গাপূজো ও সরস্বতী পূজোর দিনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা একই সূত্রে গাঁথা। এর মধ্য দিয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতি বিবেচনায় আনতে নির্বাচন কমিশন যে অক্ষম তা’ আরেকবার জাতির সামনে পরিস্ফুটিত হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, এবারের সরকারী ক্যালেন্ডারে ২৯ জানুয়ারী, ২০২০ সরস্বতী পূজো উপলক্ষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির দিন এবং সরকারী ঐচ্ছিক ছুটি হিসেবে ঘোষিত আছে। এ ক্যালেন্ডারটি প্রকাশিত হয়েছে ডিসেম্বরের শেষে জানুয়ারীর প্রথম দিকে। বাংলাদেশের সরকারসহ সকল জনগন তাদের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করে ইংরেজী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। কিন্তু হিন্দু ধর্মীয় নানান পূজো-পার্বন এমনকি বিবাহ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তিথি, ক্ষণ এবং লগ্ন বাংলা পঞ্জিকার উপর নির্ভরশীল। এবছরের অর্থাৎ বাংলা ১৪২৬ সনের পঞ্জিকামতে ২৯ জানুয়ারী, ২০২০ ইং তারিখ সকাল ৯টা ১৫মি ৬সেকেন্ড পর শ্রীপঞ্চমী তিথি শুরু হচ্ছে যার অবসান ঘটবে তার পর দিন ৩০ জানুয়ারী, ২০২০ ইং তারিখ বেলা ১১টা ২৫মি ৩ সেকেন্ডে। সরস্বতী পূজো অনুষ্ঠিত হয় শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে প্রাতঃকালে। যেহেতু, ২৯ জানুয়ারী প্রাতঃকালে শুক্লাপঞ্চমী তিথি পরছে না সুতরাং বিধান অনুযায়ী ২৯ জানুয়ারী প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা গেলেও পূজোনুষ্ঠান ঐদিন সম্ভব নয়। পূজো হবে ৩০ জানুয়ারী প্রাতঃকাল হতে বেলা ১১টা ২৫মি ৩সেকেন্ডের মধ্যে। আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে বারংবার এ তথ্য তুলে ধরেছি, কিন্তু তারা তা আমলে আনার চেষ্টা করেননি সরকারী ছুটির তালিকা বিবেচনায় নিয়ে। আমরা দেখেছি, সংখ্যাগুরু জনগনের কোন ধর্মীয় উৎসব সরকারী ছুটির তালিকায় থাকলেও যেহেতু তা চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল সেহেতু ছুটির দিনের আগে চাঁদ দেখা না গেলে ছুটির তারিখ পরিবর্তিত হয়। সরকারী ছুটির তালিকায় সরস্বতী পূজোকে কেন্দ্র করে কোন ভূল থেকে থাকলে তার জন্যে এদেশের সাধারণ পূজার্থীরা কোনভাবেই দায়ী নয়। পরন্তু যেদিন পূজো নয় সেদিন পূজোনুষ্ঠান চাপিয়ে দেওয়া কোনভাবেই কাম্য নয় এবং হতেও পারে না।

নির্বাচন কমিশন সচিব কর্তৃক একই দিনে পূজো ও নির্বাচনের যেসব প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন তাকে প্রত্যাখ্যান করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয় সরস্বতীপূজো যেক্ষেত্রে অধিকাংশ শিক্ষায়তনের উন্মুক্ত পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে সেক্ষেত্রে তাঁর দেয়া প্রথম প্রস্তাব নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র শিক্ষায়তনের এক কক্ষে নির্বাচন, আরেক কক্ষে পূজো কিভাবে সম্ভব তা আমাদের বিবেচনায় আসে না। পূজো চলাকালীন ঢোল বাজবে, কাসর বাজবে, শংখ বাজবে, মাইক বাজবে সেক্ষেত্রে ভোটকেন্দ্রের পরিবেশটি কোথায় থাকবে? পরবর্তী প্রস্তাবে তিনি বলেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভক্তি টেনে পূজো ও ভোট-দু’টোই চলবে। সংবাদ সম্মেলন থেকে প্রশ্ন করা হয়, বিভক্তিরেখা টানলেও শাখা কাসর মাইকের আওয়াজ সেখানেও তো যাবে আর নির্বাচনের আগে যেখানে পুরো ঢাকা মহানগরী ১৪৪ ধারার আওতায় চলে যাবে, যানবাহন বন্ধ থাকবে, জনগনের সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকবে সেক্ষেত্রে পূজার্থীরা শিক্ষায়তনে যাবে কি করে, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙ্গালী উৎসবে মিলিত হবে কি করে?। এহেন বাস্তবতা বিবর্জিত ও অবান্তর প্রস্তাবনাকে প্রত্যাখ্যান করে ধর্মীয় অনুভূতি ক্ষুণœকারী ও ধর্মীয় স্বাধীনতা সংকোচনকারী বক্তব্য প্রদানের জন্যে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন সচিবকে তার পদ থেকে অপসারনের জোর দাবী জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলন থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, ৩০ জানুয়ারী, ২০২০ সরস্বতী পূজোর দিনে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আপামর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ইতোমধ্যে মেনে নেয় নি এবং মানবে না।

সংবাদ সম্মেলনে সরস্বতী পূজোর দিনে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের বিরোধিতায় ঢাকাসহ দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ‘সরস্বতী পূজোর দিন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন মানি না, মানবো না’ এ শ্লোগানে আগামী ২০ জানুয়ারী সোমবার ঢাকাসহ সারাদেশে বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল, ২৪ জানুয়ারী, ২০২০ শুক্রবার ঢাকাসহ সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা গণঅবস্থান, ২৫ জানুয়ারী, ২০২০ অবরোধ এবং ২৭ জানুয়ারী, ২০২০ প্রতীকী অনশনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এর পরবর্তীতে ২৮ জানুয়ারী, ২০২০ নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও সংখ্যালঘু ঐক্য মোর্চা পুণরায় বৈঠকে মিলিত হয়ে পরবর্তী করণীয় ঘোষণা করবে।

সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য মোর্চাভুক্ত ৩১টি সংগঠনের পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন- প্রফেসর ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক (ঐক্য পরিষদ), সাংবাদিক বাসুদেব ধর (পূজা উদ্যাপন পরিষদ), এ্যাড. সব্রত চৌধুরী (শ্রীশ্রী ভোলানন্দগিরি আশ্রম ট্রাষ্ট), সাংবাদিক স্বপন কুমার সাহা (জগন্নাথ হল এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন), পলাশ কান্তি দে (জাতীয় হিন্দু মহাজোট), মনোরঞ্জন মন্ডল (জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি), ভদন্ত সুনন্দপ্রিয় ভিক্ষু (বুদ্ধিষ্ট ফেডারেশন), নির্মল রোজারিও (খ্রিস্টান এ্যাসোসিয়েশন), সঞ্জিব দ্রং (আদিবাসী ফোরাম), রামানন্দ দাস (ঋষি পঞ্চায়েত ফোরাম), সন্তোষ শর্মা (স্বজন), এ্যাড. অশোক ঘোষ (মাইনোরিটিজ সংগ্রাম পরিষদ), গোবিন্দ চন্দ্র চৌধুরী (জাতীয় হিন্দু নাগরিক কমিটি)। সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন- প্রফেসর ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক।

Back to top button