মতামত ও বিশ্লেষণ

সুমন চাকমার মৃত্যু শোক নয়, ক্রোধ জাগিয়ে দেয়ঃ ইমতিয়াজ মাহমুদ

(১)
ছেলেটার ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে ফেসবুকের পাতায় পাতায় গতকাল থেকে। ছিপছিপে গড়নের সুদর্শন একটা চাকমা ছেলে। চোখে চশমা, বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি। পড়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘পড়তো’ বলছি তার কারণ এই ছেলেটা এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে না, এই পৃথিবীর কোথাও আর কোনদিন পড়বে না এই ছেলেটা। প্রচণ্ড শারীরিক কষ্ট নিয়ে গতকাল মৃত্যুবরণ করেছে সে। এইটুকু তথ্য হয়তো আপনার মনে ছেলেটার জন্যে শোক জাগাবে। আহা, দূর পাহাড়ের না জানি কোন বাবা মায়ের বুকের ধন, সন্তানকে ঘিরে না জানি কত স্বপ্ন ওরা ডেকেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠিয়েছে। সন্তানকে হারিয়ে বাবা মায়ের না জানি কি হাল এখন!

কিন্তু কি অবস্থায় প্রাণ দিতে হয়েছে সুমন নামের এই ছেলেটার সেকথা জানলে আপানর শোক হয়তো ক্রোধে রূপান্তরিত হবে। এই ছেলেটার এমনিই মৃত্যু হয়নি- তাকে হত্যা করা হয়েছে। কারা করেছেন? আমাদের ডাক্তার সাহেবেরা। না, ইচ্ছে করে হয়তো তাকেহ খুন করেননি আমাদের ডাক্তার সাহেবেরা- কিন্তু ওরা যেটা করেছেন সেটা অন্তত অবহেলা জনিত হত্যাকাণ্ড তো বটেই।

কি ঘটেছিল? কেন আমরা ডাক্তার সাহেবদেরকে এইরকম দোষারোপ করছি?

এই ছেলেটি ফুসফুসের জটিল ব্যাধিতে ভুগছিল- ক্যান্সার। কিছুদিন আগে ভারতে ওর কিছু চিকিৎসা হয়েছিল। সম্পূর্ণ সুস্থ সে হয়নি। ঢাকায় জগন্নাথ হলে থাকতো সে। সেখানে সেদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওর বন্ধু অনুপম চাকমার ফেসবুক পোস্ট থেকে যেটা দেখা যাচ্ছে, সুমন প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিল। সেখানে ওরা করোনা সন্দেহে চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করে। এরপর মুগদা হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ল্যাব এইড, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, গণস্বাস্থ্য- এই সব কয়টা হাসপাতালের দরোজার দরোজায় অসুস্থ সুমনকে নিয়ে ঘুরেছে। করোনা রোগী সন্দেহে তাকে কোথাও ভর্তি করেনি, কোথাও তাকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা করেননি ডাক্তার সাহেবরা।

(২)
এইটা নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন আমার ডাক্তার বন্ধু একেএম রেজাউল করিম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলতে চেয়েছেন যে ছেলেটার অসুস্থতা যে পর্যায়ের ছিল তাতে তার মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। সুতরাং এটার জন্যে ডাক্তার সাহেবদেরকে দোষারোপ করা ঠিক নয় ইত্যাদি। আমি আমার এই বন্ধুর কথাটাকে ভুল মনে করি। এবং মনে করি যে ডাক্তার সাহেবেরা এখানে যেটা করেছেন সেটা একরকম নরহত্যা। কেন বলছি সেটা ব্যাখ্যা করছি।

আমরা যখন বলি যে একটা মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, এই কথাটার মানে কি? হত্যা মানে হচ্ছে মৃত্যুকে তরান্বিত করা। কেননা সকল মানুষই মরণশীল। আমি আজ বা কাল বা পরশু নাও মরতে পারি, কিন্তু আমি যে একদিন মরে যাব এটা নিশ্চিত। অর্থাৎ মৃত্যু প্রতিটা মানুষের জন্যেই অনিবার্য পরিণতি। তাইলে পরশুদিন যদি কেউ আমাকে হত্যা করে সে কি করলো? সে আমার মৃত্যুটা তরান্বিত করলো। সেজন্যে আমরা বলি যে প্রতিটা হত্যাকাণ্ডই আসলে মৃত্যুকে তরান্বিত করা। হয়তো আমি বিশ বছর পর মরতাম বা বিশদিন পর- হত্যাকারী সেটাকে কেবল তরান্বিত করে।

সুমন ছেলেটা ক্যান্সারের যে পর্যায়ে ছিল, ধরে নিলাম কয়েকদিনের মধ্যেই তার মৃত্যু অনিবার্য ছিল। ডাক্তার সাহেবেরা চিকিৎসা না করার ফলে হয়তো ছেলেটা একমাস আগেই মরে গেল বা একসপ্তাহ বা একদিন আগেও হতে পারে। কিন্তু এই যে ওঁর মৃত্যুটা তরান্বিত হলো, সেটা হয়েছে ডাক্তার সাহেবদের ইচ্ছাকৃত কর্ম বা গুরুতর অবহেলার কারণে। এইজন্যেই বলছি ডাক্তার সাহেবেরা যেটা করেছেন সেটা হত্যাকাণ্ডের সমান।

আপনি যদি জানেন যে আপনার কাজের ফলে বা অবহেল্রা ফলে লোকটার আশু মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে তাইলে আপনি সেই কাজটা করবেন না বা সেই অবহেলাটা করবেন না। আপনি একজন ডাক্তার, আপনার কাছে রোগী গেছে গুরুতর অসুস্থ। আপনি তার চিকিৎসা করবেন না? আপনি তো রোগের গুরুত্ব বুঝার কথা, রোগীর অসুস্থতার মাত্র বুঝার কথা। তাইলে এইটাও বুঝার কথা যে আশু পদক্ষেপ না নিলে এই ছেলেটা মরে যেতে পারে। তারপরও চিকিৎসা করেননি। এটা হত্যাকাণ্ড নয়?

(৩)
রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত জেনে চিকিৎসা করতে অস্বীকার করবেন? সেটা তো হয় না। আরে মৃত রোগী নিয়ে গেলেও তো আপনারা বুকে ঐসব ধাক্কা ফাক্কা দিয়ে হলেও রোগীকে ফেরত আনার চেষ্টা করেন। আমার নিজের দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে- স্ট্রোক করে মরে গেছে রোগী নিয়ে গেছি সরোয়ার্দি হাসপাতালে। ডাক্তার সাহেবেরা নার্সরা ওরা সেই অবস্থায়ও ইস্ত্রির মতো দুইটা জিনিস দিয়ে বুকে ইয়ে দিয়ে চেষ্টা করলেন। ডাক্তার সাহেবদের সেই প্রাণপণ চেষ্টা দেখে ওদের উপর শ্রদ্ধা বেড়েছে। আস্থা বেড়েছে। এইটাই তো আপনারা করার কথা। শেষ চেষ্টাটাও করে দেখবেন।

আর সুমনের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, হাসপাতালগুলি স্রেস্ফ তার চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেছে বা এড়িয়ে গেছে। রোগীর অবস্থা খুব খারাপ ছিল, ওকে বাচানো যেতো না এসব তো কোন কথা হতে পারে না আরকি। আর ছেলেটা যখন মরেই গেল, তখন তার মৃত্যু অনিবার্য ছিল সেটা বলে ডাক্তারদের এই নিন্দনীয় অপরাধমূলক কাজটার তো জাস্টিফিকেশন হতে পারে না।

আমাদের ডাক্তারদের প্রতি আমার আস্থা সম্মান শ্রদ্ধা এইসবের শেষ নাই। ডাক্তার সাহেবদের দিকে আমি সবসময়ই বিস্ময় ও ঈর্ষা নিয়ে তাকাই। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সাথে লড়ছেন আপনারা। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ডাক্তার সাহেবেরা একদম আজরাইলের হাত থেকে মানুষকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। এর চেয়ে মহান কাজ আর কি হতে পারে? এইজন্যেই তো দেখবেন দেশের সংখ্যাগুরু বাবা মা চায় ওদের বাচ্চারা যেন ডাক্তার হয়। না, আর্থিক সাফল্য ইত্যাদিও একটা কারণ বটে। কিন্তু পেশার মাহাত্বও কি ডাক্তারি পেশার প্রতি মানুষের আকর্ষণের একটা কারণ নয়?

এই পেশার কয়েকজন লোক যখন এইরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করে- আপনি কি ওদের নিন্দা করবেন না? ওদের বিচার চাইবেন না? ওদের প্র্যাকটিস করার লাইসেন্স কেড়ে নেওয়ার সুপারিশ করবেন না? নাকি আপনি নিজে ডাক্তার বলে সকল ডাক্তারের অন্যায় অপরাধমূলক কাজেরও কোন না কোনোভাবে জাস্টিফিকেশন দাড় করাবেন?

(৪)
আমি সুমনের হত্যার জন্যে সংশ্লিষ্ট এইসব ডাক্তার সাহেবদের বিচার চাই। শাস্তি চাই। এইরকম লোক যেন ডাক্তারি পেশায় থাকতে না পারে সেইটা নিশ্চিত করার দাবী জানাই।

………………………..
ইমতিয়াজ মাহমুদ, লেখক ও আইনজীবী

Back to top button