রিজেন্ট সাহেদ, ডা. সাবরিনা বনাম মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রশ্ন: পাভেল পার্থ

কলেরা, বসন্ত কি কালাজ্বরের পর দুনিয়া আজ কাহিল কোভিড মহামারিতে। তো করোনাকালে কতকিছু কতভাবে দেখা হলো, জানা হলো। উসকে গেল, ছলকে ওঠল, নিবে গেল, চাপা পড়লো, দগদগ করে ওঠল, কুঁকড়ে গেল বা ঝিমিয়ে পড়লো। একদিকে আশা, আরেকদিকে নিরাশা। আর চারধারে দমবন্ধ দুনীর্তি। কী নিদারুণ, কী দশাসই। চিন্তা করা যায়, না চিন্তা করা উচিত? যে মাস্ক দিয়ে বাঁচবে জীবন সেই মাস্ক নকল হয়। পরীক্ষা না করে রিপোর্ট দেয়া হয়। এ কেমন কলিজা, এ কেমন শিক্ষা। এসব তো গরিব মেহনতি মানুষ করেনি। নিরক্ষর নিম্নবর্গ করেনি। এরা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পাঠ নিয়েছে। এরা বিশাল অর্থবিত্তের মালিক। এরা আইন জানে, এদের কাছে তথ্যের ভান্ড থাকে। কিন্তু মহামারিকালে এমন নিদারুণ দুর্নীতি করতে এদের কারোর বুক কাঁপেনি। তাহলে আমাদের বিদ্যাপীঠ আর সমাজ কী শিক্ষা দেয়? মহামারিকালেও কেন দুর্নীতি থামে না? একদিকে দেশের অন্ন জোগাতে কুঁচকে যাচ্ছে কৃষকের চামড়া, আরেকদিকে দুর্নীতি করে চিকনাই হয় ডা. সাবরীনাদের জগত। কেন কেউ বারবার রিজেন্ট সাহেদ বা ডা. সাবরীনা হয়ে ওঠে? কে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়? একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভেতরে থেকেই কেন এমন লাগাতার দুর্নীতির জাল ছড়িয়ে যাচ্ছে চারধারে? মহামারিকালে এসব প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া জরুরি। করোনাউত্তর এক নয়া স্বাভাবিকতার দুনিয়ায় আমরা কোনো রিজেন্ট সাহেদ বা ডা. সাবরীনা চাই না। কারণ সংবিধান এদের চায় না। সংবিধান বলেছে, দেশের মালিক জনগণ। সেই জনগণ শ্রমশীল উৎপাদনমুখী সৃজনশীল মেহনতি মানুষ। এরাই বাংলাদেশের কারিগর। তো এই মহামারিকালে চাপচাপ দুর্নীতির দমবন্ধে বারবার মনে আসে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রশ্ন। ৪৬ বছর আগে রাষ্ট্রকে এই প্রশ্ন করেছিলেন মানবেন্দ্র। আজ করোনাকালে তাঁর ৩৭ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বারবার সেই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে। এই প্রশ্নের ফায়সালা হওয়া জরুরি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লারমার প্রশ্ন
১৯৭৪ সনের ৫ জুলাই বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বাজেটের উপর সাধারণ আলোচনায় মানবেন্দ্রর সংসদীয় বক্তৃতাকে টেনে আনছি। মানবেন্দ্র বলেছিলেন, মাননীয় স্পীকার সাহেব, সুতরাং সরকার জেনে শুনে এক শ্রেণীর মানুষকে ধনী করার পথ প্রশস্ত করেছেন। এটা সরকারের পক্ষে একটা অশুভ লক্ষণ। সরকার যদি আদর্শ মেনে চলতেন, তাহলে এটা করতেন না। সবকিছু জানা সত্ত্বেও trading of licences- এর ব্যাপারে সরকারের দুর্নীতি মুক্ত হওয়া উচিত ছিল। পরিস্কারভাবে সরকারের উচিত ছিল এইসব দুর্নীতির মূল উৎপাটন করা। দুর্নীতি সব কিছুর মধ্যে রয়েছে। দুর্নীতি দমন করার ব্যাপারে সরকার সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছেন। আমি সরকারকে দুর্নীতিপরায়ণ সরকার বলব না। তবে দুর্নীতিপরায়ণ লোক সরকারকে ঘিরে রয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট লেভেল থেকে আরম্ভ করে সেক্রেটারিয়েট লেভেল পর্যন্ত খোঁজ করলে দেখা যাবে তার মধ্যে বহুলোক দুর্নীতির সাথে জড়িত। সাধারণভাবে যারা দুর্নীতির সাথে জড়িত আছে, তাদেরকে ৩ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, যথা:- (১) ব্যবসায়ী (২) এক শ্রেণীর রাজনৈতিক কর্মী, এবং (৩) এক শ্রেণীর সরকারী কর্মচারী। সমাজের এই তিন শ্রেণীর মানুষকে শায়েস্তা করতে না পারলে বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না। যদি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চান, তাহলে দুর্নীতিপরায়ণ লোকদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। মাননীয় স্পীকার, স্যার, দুর্নীতির প্রশ্রয় দেওয়া যে কত বড় মারাত্মক, তা বলে শেষ করা যায় না। দুর্নীতি যদি আমরা দূর করতে না পারি, তাহলে সরকার যত রকমের আইনই করুক না কেন, যত কড়া নির্দেশনামাই দিক না কেন, কোন সুরাহা হবে না। আজকে এই দুর্নীতি সবখানে। যে কোন মঙ্গলজনক কাজই আমরা দেশের জন্য করতে যাই না কেন, সর্বপ্রথমেই আমরা মনে মনে ঠিক করে নেই যে, দুর্নীতিপরায়ণ হবে। “দুর্নীতিপরায়ণ হব না” এটা আমরা চিন্তাও করি না। এই দুর্নীতিকে আকঁড়ে ধরে যারা কালো টাকা রোজগার করে, আইনের ছত্রছায়ায় তাদেরকে রক্ষা করা হয়।
মঞ্জু থেকে মানবেন্দ্র
সুভাষিণী দেওয়ান ও চিত্ত কিশোর চাকমার তৃতীয় সন্তানের নাম ‘মঞ্জু’। মহাপুরম জুনিয়র হাই স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর তিনি ১৯৫৮ সালে রাঙামাটি সরকারি কলেজ থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। ১৯৬৬ সালেই খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উচ্চ দিব্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং বিএড পরীক্ষা দেন। ১৯৬৯ সালে এল এল বি পাশের পর চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশনের আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৬ সনেই ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন, ১৯৫৭ সনে অনুষ্ঠিত প্রথম পাহাড়ি ছাত্র সম্মেলনের একজন কেন্দ্রীয় উদ্যোক্তাও ছিলেন তিনি। ১৯৫৮ সনে পূর্ব পাকিস্থান ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করেন। ১৯৬০ সনে পাহাড়ি ছাত্র সমাজের নেতৃত্বদানের পাশাপাশি ১৯৬১ সনেই কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬২ সনে সংগঠিত করেন এক বিশাল পাহাড়ি ছাত্র সম্মেলন। চট্টগ্রামের পাথরঘাটাস্থ পাহাড়ি ছাত্রাবাস থেকে ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্র“য়ারি তাকে বিশেষ নিবর্তনমূলক আইনে আটক করে সরকার। ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ বিশেষ শর্তসাপেক্ষে তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৭০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠনে দায়িত্বপালন করেন এবং এই সনেই পূর্ব পাকিস্থান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট পার্বত্য অঞ্চলের আঞ্চলিক সায়ত্ত্বশাসনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে চার দফা দাবী পেশ করেন। ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করেন এবং সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে দেশের সকল জাতিদের একত্রে ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রতিবাদে গণপরিষদ অধিবেশন বর্জন করেন। ১৯৭৩ সনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। ১৯৭৪ সালে সরকারের পালামেন্টারি প্রতিনিধি হিসেবে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষ্যে লন্ডন সফর করেন। ১৯৭৪ সালে বাকশালে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকে আত্মগোপন করেন। ১৯৭৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রথম সম্মেলনের মাধ্যমেও পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দ্বিতীয় সম্মেলনের মাধ্যমেও সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর ভোররাতে অতর্কিত আক্রমণে নিহত হন ‘মঞ্জু’। মেহনতি নিপীড়িত জনতার প্রিয় এই নেতা ‘মঞ্জুই’ ইতিহাস কাঁপানো ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’। রাষ্ট্রের তথাকথিত মূলধারার ইতিহাসে যাকে বারবার অবহেলিত, উদ্বাস্তু আর প্রান্তিক করে রাখা হয়েছে। কারণটি নি:সন্দেহে রাজনৈতিক এবং বাঙালি জাত্যাভিমানের সাথেও জড়িত।
লারমার প্রশ্ন কেন আড়াল হয়?
কারণ রাষ্ট্রের অধিপতি মনস্তত্ব মানবেন্দ্রর ন্যায়পরায়ণতা নয়, প্রশ্রয় দেয় সাহেদ কী সাবরীনাদের দুর্নীতির। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাই দেশের পয়লা জনপ্রতিনিধি যিনি রাষ্ট্রের জনগণের ন্যায্যতা, বৈষম্য ও আইনী অধিকার, জনগণের সম্পর্কের সীমা ও উৎপাদন সম্পর্কের রাজনীতিসহ জীবনযাপনের নানান উচ্চারন ও আহাজারিকে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক সভায় তুলে ধরেছেন। প্রশ্ন করেছেন। লড়াই করেছেন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মত একজন জননেতা সম্পর্কে জানার জন্য মূদ্রিত দলিলের যেমন অভাব তেমনি ইতিহাসহীন করা হয়েছে তাঁকে রাষ্ট্রের বিস্তৃতি থেকেই। কারন তিনি রাষ্ট্রের সংবিধান, রাষ্ট্রের চরিত্র, নিপীড়িত-উপনিবেশিত জনগণের মুক্তি এবং মুক্তিপ্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন রাষ্ট্রসভায়, গণপরিষদে। আজো রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর চিন্তা, দর্শন ও স্মৃতি সংরক্ষণ ও চর্চার কোনো উদ্যোগ নেই। বেসরকারি পর্যায়ে কিছু স্মরণিকা আর স্মরণ অনুষ্ঠান পালিত হলেও তাঁর সংগ্রামী জীবন এখনো পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভ’ক্ত হয়নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি সড়ক, স্থাপনা বা কোনো পদকও হয়নি তাঁর নামে। এ যেন অস্বীকারের নিদারুণ সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটাতে হবে। গণমানুষের চোখেই দেখতে হবে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁর চিন্তা দর্শনে এটিই জানিয়েছেন বারবার। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সকল নিপীড়িত মানুষের অধিকারের পক্ষে লড়েছেন। আজ পাহাড়, সমতল দেশজুড়ে খুন, ধর্ষণ, নিপীড়ন, দখল, দুনীর্তি লাগাতার চরমে পৌঁছেছে। বিচারহীনতার এক দীর্ঘকাল। আজ প্রিয় ফুল খেলবার দিন নেই চারধারে। কিন্তু আমরা তো সবাই মিলে সবাইকে নিয়ে প্রিয় ফুল খেলবার ময়দান তৈরি করতে চাই। এর জন্য দরকার এক কঠোর সংবেদনশীল প্রস্তুতি। বিপ্লবী এম এন লারমার পথ ও নীতি আমাদের সেই প্রস্তুতিকে আরো সজাগ ও সোচ্চার করতে পারে।
কাকে দরকার?
করোনাকাল প্রমাণ করেছে রিজেন্ট সাহেব বা ডা. সাবরীনা নয়, বাংলাদেশ মেহনতি ন্যায়পরায়ণ জনতার। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কর্ম ও প্রেরণায় সেই বাংলাদেশের আওয়াজ টগবগ করে ওঠে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানবেন্দ্র রাষ্ট্রকে যে প্রশ্ন করেছেন তা আজও জনমনের অমীমাংসিত প্রশ্ন। এই প্রশ্নের ভেতরেই লুকিয়ে আছে রিজেন্ট সাহেদ কী ডা. সাবরীনাদের দুর্নীতিবাজ হওয়ার কাহিনি। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে এসব প্রশ্নের সুরাহা হওয়া জরুরি। আয়তনে ছোট হলেও বাংলাদেশ বৈচিত্র্য বৈভবে অনন্য। এই বৈভব ম্লান হতে পারে না কোনো সাহেদ কী সাবরীনাদের মিথ্যাচারে। আমাদের চারধারে এখনো জীবন্ত অযুতনিযুত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। আসুন সেই জীবন পাঠ করি, চর্চা করি, তরতাজা রাখি।
লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: [email protected]