জাতীয়

বিবর্ণ পাহাড় বইয়ে ফুটে উঠেছে পাহাড়ের কান্নাঃ মোড়ক উন্মোচনে বক্তাগণ

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে লেখক ও আদিবাসী অধিকার আন্দোলনকর্মী মঙ্গল কুমার চাকমার লেখা ‘বিবর্ণ পাহাড়: পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও সমাধান’ শিরোনামে গ্রন্থটির ‘মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা সভা’ ১১ মে ২০১৯ ঢাকার ধানমন্ডিস্থ ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। উক্ত আলোচনা সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, বইটির প্রকাশক বটেশ্বর বর্ণন-এর পক্ষে বিলু কবীর প্রমুখ। এছাড়াও বিভিন্ন মানবাধিকারকর্মী, সুশীল সমাজ, শিক্ষক, সাংবাদিক, নারীনেত্রী, সংগঠক ও যুব নেতৃবৃন্দ উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।

বইটির মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা সভায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান বলেন-দেশে যেরকম সংখ্যালঘুরা দেশ থেকে বিতাড়িত হচ্ছেন কিংবা দেশ ত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন তারই একটি প্রভাব পাহাড়ে রয়েছে, সেখানেও যার যেভাবে সুযোগ হচ্ছে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। একজন আদিবাসী কেন দেশ ত্যাগ কওে, সে কারণগুলো জানা এবং পাহাড়ের কান্না বোঝার জন্য এই বইটি পড়া জরুরি বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, “মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশ আবারো সদস্য হিসেবে পুননির্বাচিত হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মহলে আমরা গর্ববোধ ও অহংকার করি কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে মানবাধিকারের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করব এরকম বিঘিœত আচরণ রাষ্ট্রের কাছ থেকে কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এরকম বিঘিœত আচরণ যে প্রতিনিয়ত হচ্ছে তা আমরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পারি।”

তিনি আরো বলেন, ‘রাষ্ট্র যদি কোন নাগরিককে সাহায্য করতে আসে তখন রাষ্ট্রকেই তার ভদ্র বেশে উপস্থিত হয়ে নাগরিককে সাহায্য করতে হয়। কিন্তু সেখানে যদি সামরিক পোশাক পড়ে সামরিক অস্ত্র নিয়ে দরিদ্র্যদের সাহায্যের জন্য বা কোন হাসপাতালে গিয়ে চেক হস্তান্তর করে তাহলে সেটি কোন সভ্য রাষ্ট্রের চিত্র প্রমাণ করে না। সভ্য রাষ্ট্র বেসামরিকভাবে বেসামরিক নাগরিকের সাথে আদান প্রদান করে, আলাপ-আলোচনা করে।’ তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন তখনই হয় যখন এটি অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন হয়। আবার মানব উন্নয়ন ব্যতিরেকে কোন উন্নয়নই টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না। দালান কোঠার উন্নয়নই প্রকৃত উন্নয়ন নয় সেটা আমাদের বুঝতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যমান সমস্যা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, কোন সমস্যার চরিত্র যদি হয় রাজনৈতিক তাহলে সেটা রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। সেটি কখনো অর্থনৈতিক বা সামরিকভাবে সমাধান হতে পারে না। পাহাড়ে মূল সমস্যা হচ্ছে ভূমি মালিকানার সমস্যা। ভূমি মালিকানার সমস্যা যদি সমাধান না হয় তাহলে অন্য কোন সমস্যা সমাধান হতে পারে না। আর ভূমি সমস্যা যদি সমাধান করা যায় তাহলে অন্য সমস্যাগুলো এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে একটি টেবিলে এনে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। এর জন্য তিনি জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা, সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি, সামরিক গোয়েন্দা, সরকারের আমলাদের সাথেও আলোচনা করেছেন কিন্তু তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ায় এটি সম্পন্ন করে যেতে পারেননি বলে দু:খ প্রকাশ করেন। কিন্তু তার এ অর্ধ-সমাপ্ত কাজ পরবর্তীতে যারা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্বে রয়েছেন তারাও এটিকে এগিয়ে নিতে পেরেছে বলে তার কাছে কোন তথ্য নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন ড. সাদেকা হালিম বিবর্ণ পাহাড় বইয়ের শিরোণাম ধরে বলেন, আসলে পাহাড় তো বিবর্ণ ছিল না। সেটাকে বিবর্ণ করা হয়েছে। পাহাড়ে বিভিন্ন সংস্কৃতি দ্বারা আদিবাসী মানুষের জীবন বৈচিত্র্যময়। কিন্তু তাদের জীবন ব্যবস্থাকে আজ বিবর্ণ করে তোলা হয়েছে। ড. সাদেকা হালিম বলেন, এই বইটির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হলে আরো বেশি করে সঠিকভাবে পাঠকদের কাছে বইটি গ্রহণযোগ্যতা পেতো।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর একটি জায়গায় সকল নাগরিকদের বাঙালী বলা হয়েছে আবার ২৩ এর ক ধারায় আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন নামে অবহিত করা হয়েছে। এর বিশ্লেষণ লেখক এ বইটিতে করেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কী করে বাঙালি বলে পরিচিত হবে এটি তার কাছেও পরিস্কার না। তাই যখন সংশোধনী আসবে তখন যেন নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে সরকারের একটি যুগাস্তকারী উদ্যোগ হিসেবে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে আদিবাসীদের কৃতজ্ঞতা জানানোর কথা বলেন। তিনি পার্বত্য ভূমি সমস্যা সম্পর্কে বলেন, ‘মূল ধারার ভূমি ব্যবস্থাপনার আদলে যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা সমাধানের চিন্তা করা হয় তাহলে সেটা ঠিক হবে না কারণ পাহাড়ে এখনও প্রথাগত আইন ও ১৯০০ সালের রেগুলেশন বিদ্যমান রয়েছে যার আলোকেই পার্বত্য চুক্তি করা হয়েছিল। অতএব চুক্তি বাস্তবায়নে গিয়ে ভূমি কমিশন এর দ্বৈততা কেন দেখাবে?’

সভাপতির বক্তব্যে সঞ্জীব দ্রং বলেন, পাহাড়ের অবস্থা ভালো নয় সেখানে যারা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে তাদের অবস্থাও আজ ভাল নয়। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ যদি নষ্ট হয়, বন যদি উজাড় হয়ে যায় তাহলে সেটি শুধু পার্বত্যবাসীর নয় আমাদের কারোরই জন্য ভালো খবর নয়। রাষ্ট্রকে এটি দেখতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্র দিনদিন হৃদয়হীন হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারছে না। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কতখানি ভালবাসেন, নাগরিকদের কতটা মর্যাদা করেন সে বিষয়ে চিত্র তোলে ধরা হয়েছে এই বইটিতে। রাষ্ট্র যেন এই বইটিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।

কবি সোহরাব হাসান বলেন, পাহাড় বিবর্ণতার দায় যেমন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আবার পাহাড়ে যে শান্তি আসেনি সেটিরও দায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। যেসব পাহাড়ী লোকজন তাদের বসতভিটা থেকে উদ্বাস্তু হয়েছিল তাদের এখনো ফেরত আনা হয়নি এবং সেখানে ভূমি হারানো আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ফেরত দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হওয়ার পর সরকার দেখাতে চাচ্ছে যে চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে পাহাড়ের মূল সমস্যা ভূমি সমস্যা সমাধানে কাজ হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠিত হলেও এ কমিশনের কাজ ত্বরান্বিত হচ্ছে না। পাহাড়ে এখনো আধা-সেনা শাসন চালু রয়েছে। তিনি আরো বলেন, সরকার যেমন বাধ্য হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করার এখন আবারো সময় এসেছে সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে বাধ্য করতে। এজন্য পার্বত্যবাসীকে এক ও ঐক্যবদ্ধহয়ে এ চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করতে হবে।

প্রকাশক বটেশ্বর বর্ণন এর পক্ষে বিলু কবীর বলেন বাণিজ্যিক কারণে নয়, দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা, আদিবাসীদের সমস্যা এবং আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায় থেকেই বটেশ্বর বর্ণন এই বই প্রকাশ করেছে। আদিবাসী জীবন, চেতনা ও তাদের সমস্যা সম্পর্কে মূল ধারার মানুষ বেশি বেশি জানতে পারলেই বইটি প্রকাশের সার্থকতা পাবে।

“বিবর্ণ পাহাড় : পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও সমাধান”, শিরোণামে বইটির রচনায় মঙ্গল কুমার চাকমা এবং প্রকাশক বটেশ্বর বর্ণন, এবারের একুশে বইমেলায় এটি প্রকাশিত হয়েছিল। শনিবার এ বইটির মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা সভার শুরুতে পূর্ণা দেওয়ান লেখক মঙ্গল কুমার চাকমা’র সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাঠ কওে শোনান। বইটির সারাংশ আলোচনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তর্থ ও প্রচার বিষয়ক সম্পাদক দীপায়ন খীসা। বইটি সম্পকে আরো আলোচনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদেও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখি দাস পুরকায়স্থ ও বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কেও সদস্য সজিব চঞ্চনা চাকমা।

দীপায়ন খীসা বলেন, আসলে পাহাড় আজ বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সেদিক থেকে আক্ষরিক, প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়েও বইটির নামকরণ সত্য। বইটি মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যু ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অবস্থা ও প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে লেখকের বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রায় ২৮টি প্রবন্ধগুলোর সংকলন। লেখকের মতে, মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার ঐতিহাসিক দিক, সমস্যার অন্তর্নিহিত বাস্তবতা, শাসকশ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ও তার ব্যাখ্যা, সম্ভাবনা ও সমাধানের উপায় নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলো এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। বইটির মুখবন্ধ লিখেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। বইটি সম্পর্কে তাঁর মুখবন্ধে তিনি বলেছেন, বইটিতে “পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার ঐতিহাসিক দিক, সমস্যার অন্তর্নিহিত কার্যকারণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা ও প্রতিবন্ধকতা, সমস্যা সমাধানের উপায় সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরা” হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও এ সমস্যা সমাধান সম্পর্কে সম্যকভাবে বুঝতে এই বইটি সহায়ক হবে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

Back to top button