জাতীয়

পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন দাবিনামা নিয়ে টাস্কফোর্স চেয়ারম্যানের কাছে বিশিষ্টজন ও বিভিন্ন সংগঠনের স্মারকলিপি প্রদান

পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন দাবিনামা নিয়ে গতকাল ৪ অক্টোবর ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও নাগরিক সমাজের ১০৭ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ও খাগড়াছড়ির সাংসদ কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরার কাছে প্রদান করা হয়।

স্মারকলিপির প্রারম্ভে করোনা মোকাবিলায় খাদ্য দ্রব্যের ত্রাণ ও পরিবার পিছু ২৫০০ টাকার বিশেষ প্যাকেজ সম্বলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানায় বিশিষ্টজনরা। কিন্তু সরকারের প্রশংসনীয় ত্রাণ কার্যক্রম সত্ত্বেও মাঠ পর্যায়ের কিছু সমস্যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের খাদ্য নিরাপত্তার চাহিদাপূরণ হতে পারেনি বলেও উল্লেখ করা হয় স্মারকলিপিতে।

স্মারকলিপিতে আরো বলা হয় যে, দুর্গম পাহাড়ের অধিকাংশ পরিবার দিন-মজুর ও জুমচাষী হওয়ায় তাদের অধিকাংশের এক সপ্তাহ কিংবা তারও কম দিন চলার মতো খাদ্য মজুদ থাকে। এসময়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিতরণকৃত ত্রাণ ও আর্থিক সাহায্য কদাচিৎ এ সব এলাকায় পৌঁছাতে পেরেছে।
এছাড়া এই সব এলাকা পানীয় জল, যোগাযোগের জন্য রাস্তা ও যানবাহন, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত বলে তুলে ধরা হয়। এ প্রেক্ষাপটে, পাহাড়ে যে সব অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তু রয়েছেন (আনুমানিক ৮৬০০০-৯৬০০০) তাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয় বলে জানান বিশষ্টজন ও সংগঠনসমূহ। এছাড়া বিগত আশির দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসিত বাঙালি পরিবার এবং ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির আওতায় ভারত প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থীদের মতো এইসব আভ্যন্তরীণ উদ্ভাস্তু পরিবারসমূহ নিয়মিত কোনো রেশনও পান না বলে জানানো হয় উক্ত স্মারক লিপিতে।

করোনাকালীন এই দুর্যোগ এবং অন্যান্যভাবে অভ্যন্তরীণ পাহাড়ী উদ্বাস্তুদের দুর্দশার কথা সরকার ও অন্যান্য প্রযোজ্য কর্তৃপক্ষের বরাবরে উত্থাপন করে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ও র্কাযকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য টাস্কফোর্স চেয়ারম্যানের নিকট অনুরোধ জানান বিশিষ্টজনরা। এ বিষয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও উক্ত স্মারক লিপিতে উল্লেখ করেন উক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
স্বারক লিপিতে স্বাক্ষর করা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হলেন চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়,পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, শিক্ষাবিদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি সদস্য প্রফেসর মংসানু চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান, পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন এর সাধারণ সম্পাদক সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন এর বান্দরবান চ্যাপ্টার প্রধান জুয়ামলিয়ান আমলাই, খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সুধীন কুমার চাকমা, একই কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও সনাক এর খাগড়াছড়ির সভাপতি প্রফেসর বোধিসত্ত্ব চাকমা, খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক মধু মঙ্গল চাকমা, সাবেক যুগ্ম সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এর সাবেক মহাপরিচালক উক্য জেন।
এছাড়া উক্ত স্মারকলিপি দেশের ও বিদেশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সমর্থন প্রদান করেছেন বলে জানানো হয়।উক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের মধ্যে আছেন- মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, খুশী কবির, বিশিষ্ট আইনজীবি ব্যারিষ্টার সারা হোসেন, বিশিষ্ট গবেষক ড. স্বপন আদনান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব অস্ট্রেলিয়ার অধ্যাপক ড. বীণা ডি’কস্টা প্রমুখ।

এছাড়া উক্ত স্মারকলিপিতে স্বাক্ষরকরা ব্যক্তিরা ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব সংগঠন সম্পৃক্ত রয়েছেন সেগুলো হল- পার্বত্য চট্টগ্রাম হেডম্যান নেটওয়ার্ক, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী হেডম্যান ও কার্বারি নেটওয়ার্ক, খাগড়াছড়ি জেলা কার্বারি এসোসিয়েশন, সাজেক ইউনিয়ন কার্বারি এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ইন্ডিজেনাস পিপলস নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড বায়োডাইভার্সিটি (বিপনেট), বম সোশ্যাল কাউন্সিল, মালেইয়া ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস্ কাউন্সিল (বি.এম.এস.সি.), ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, (টি.এস.এফ.)।

স্মারকলিপিতে উক্ত ব্যক্তি ও সংগঠনসমূহ ছয় দফা দাবীনামা তুলে ধরেন। উক্ত দাবীনামাগুলো হল-
১. সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদেরকে জরুরি ভিত্তিতে খাবার ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।
২. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি-১৯৯৭ মোতাবেক অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদেরকে দীর্ঘমেয়াদি ত্রাণ ও যথাযথ পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা। অন্যান্যের মধ্যে তাঁদের মধ্য থেকে, বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী, নারী-প্রধান পরিবার, ভারত প্রত্যাগত কিন্তু সরকারী তালিকা থেকে বহির্ভূত পরিবারসহ অন্যান্যভাবে সুযোগ বঞ্চিত পরিবার সমূহকে ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে ভিজিডি ও ভিজিএফ এর আওতায় আনা।
৩. ভারত প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থী ও পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসিত বাঙালি পরিবারদের ন্যায় অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়মিত মাসিক রেশনিং এর আওতায় আনা ।
৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন যাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে এতদুদ্দেশ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা ।
৫. ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুনির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্সের কর্মপরিধিকে বিস্তৃতি পূর্বক, এবং উদ্বাস্তুদের নিকট অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে খাদ্য, পানীয় জল,বিদ্যুৎ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান যোগানের লক্ষ্যে প্রকল্প-ভিত্তিক ও থোক হিসাবে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করে টাস্কফোর্সকে আরো শক্তিশালী করা ।
৬. বৎসরে একবার অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন কার্যক্রম সম্পর্কিত অগ্রগতির প্রতিবেদন প্রকাশ করা।

উল্লেখ্য যে, ১৯৮০ ও ১৯৯০ দশকে তৎকালীন বিরাজমান অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে যে সমস্ত পাহাড়ি পরিবার অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছিলেন এবং বর্তমান বাস্তবতায় এখনো যাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক নিজ বসতভিটায় ফেরত যেতে পারেননি, তাঁরা বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে এই অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পরিবারের সংখ্যা ৮০,০০০ – ৯৬,০০০ এর মত, যাঁদের বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনতিবিলম্বে আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা জরুরি।

উপরোক্ত উদ্বাস্তুদের একটা বড় অংশ রয়েছে রাঙ্গামাটি জেলার সাজেক, বাঘাইছড়ি, আইমাছড়া, মইদং, দুমুদুম্যা, ফরুয়া ও বরথলী ইউনিয়নে, খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা ও রামগড় উপজেলায়, এবং বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়।

Back to top button