কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আদিবাসী নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও নারী প্রগতি সংঘ

আজ ২০ আগষ্ট ২০২০ তারিখে বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসকে কেন্দ্র করে কোভিড-১৯ এর নতুন বাস্তবতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী ও কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিএনপিএস কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সভায় প্যানেল আলোচক হিসেবে অংশ নেন রাঙামাটির মেডিকেল অফিসার ডা. মো: মোস্তফা কামাল,বান্দরবনের মেডিকেল অফিসার ডা. ক্য থোয়্যাই প্রু প্রিন্স, খাগড়াছড়ির মেডিকেল অফিসার ডা. মিটন চাকমা , জেন্ডার ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. জুলিয়া আহমেদ ও দীপ্ত ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জাকিয়া কে হাসান, সিমাভি’র ব্যবস্থাপক মাহবুব হক, বিএনপিএস-র পরিচালক খোন্দকার আরিফুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা। সভা পরিচালনা করেন বিএনপিএস-এর উপ-পরিচালক শাহনাজ সুমী। এছাড়া আরও বক্তব্য রাখেন নমিতা চাকমা, ডনাই প্রু নেলী, শেফালিকা ত্রিপুরা, ডা. নিলু তঞ্চগ্যা,ডনাই প্রু মেরী, হরেন সিং, মাহবুব আলম,ধনরঞ্জন ত্রিপুরা, ফাল্পুনী ত্রিপুরা প্রমুখ।
মূল বক্তব্য উপস্থাপনকালে চঞ্চনা চাকমা বলেন- বাংলাদেশের সর্বত্র যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের অব্যবস্থাপনা একটি চিরাচরিত চিত্র হলেও তিন পার্বত্য জেলায় এই চিত্রটি আরো করুণ। প্রজননস্বাস্থ্য সমস্যার সাথে এই অঞ্চলে যুক্ত আছে ভৌগোলিক অবস্থা, অপ্রতুল স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতা, সামাজিক প্রথা, আদিবাসীদের প্রথাগত নিয়মনীতি, জীবনযাত্রার মান এবং অর্থনৈতিক অবস্থা। যাতায়াত ব্যবস্থাসহ নানা প্রান্তিকতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী ও কিশোরীদের জন্যে পরিস্থিতি সবসময়ই কঠিন, করোনা পরিস্থিতিতে তা আরও সংকটপূর্ণ হয়ে উঠে। এই অঞ্চলে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্যে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা এখনও সম্ভব হয়নি। প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান কেন্দ্র এবং ওয়ার্ড ভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক এখনও প্রতিষ্ঠা হয়নি।
সিমাভি’র ব্যবস্থাপক মাহবুবা হক বলেন- করোনাকালীন জীবিকার সঙ্কটে নারীর মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশী। যাতায়াত ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারনে দূর্গম এলাকাগুলোতে মাসিককালীন প্রয়োজনীয় স্যানিটারি উপকরন , নিরাপদ পানির সরবরাহ, অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবায় সীমিত প্রবেশাধিকার এবং প্রয়োজনীয় ঔষধগুলো আগেও সহজলভ্য ছিলনা, আর লকডাউনের ফলে এসব উপকরন আরো বেশী দূর্লভ হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিশোরী এবং নারীরা তাদের মাসিককালীন সময়ে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ উপকরণ ব্যবহার করছে। যার কারণে যৌন ও প্রজনন অঙ্গের বিভিন্ন সংক্রমনের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
ডা. জুলিয়া আহমেদ বলেন- করোনা মহামারী নারীর জন্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা পরিস্থিতি ব্যাহত করছে। একটি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধ করা। বিভিন্ন বয়সী নারীদের চাহিদা ও প্রেক্ষিতের উপর নির্ভর করে কার জন্য কোন ধরণের পদ্ধতি প্রয়োজন, যেমন- সদ্য বিবাহিত কিশোরীদের পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারনা খুবই সীমিত। এই সময়কালে তাদের যথাযথ তথ্য ও জন্ম নিরোধক সরঞ্জামের অভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং স্বাস্থ্য ঝুকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জাকিয়া কে হাসান বলেন- করোনা মহামারীর মত একটি নতুন অভিজ্ঞতা অর্থাৎ কোয়ারেন্টাইন, শারীরিক দূরত্ব, গণপরিবহণ ব্যবহার ও চলাচলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কভিড-১৯ মোকাবিলার প্রস্তুতিহীনতা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে জনবল, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশের অপারাপর অংশের মতই পার্বত্য এলাকায় একদিকে যেমন নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে, ঠিক একইভাবে বাল্য বিবাহের সংখ্যাও বাড়ছে।’
আলোচনায় বক্তারা নিম্নোক্ত সুপারিশমালা তুলে ধরেন- পার্বত্য চট্টগ্রামে অনলাইনভিত্তিক স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার জন্য প্রতিটি পাড়ায় মোবাইল সার্ভিসের দোকানগুলোকে সার্ভিস পয়েন্ট বানানো যেতে পারে যেখানে প্রান্তিক ও দরিদ্র নারীরা (যাদের বাড়িতে স্মার্ট মোবাইল নেই) মোবাইল ফি দিয়ে অনলাইনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারে। ওয়ার্ড পর্যায়ে কমপক্ষে একজন করে নারীকে স্বাস্থ্য ও ধাত্রী বিদ্যায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে যে পরবর্তীতে বাড়ী বাড়ী যেয়ে গর্ভবতী ও প্রসূতী মায়েদের বিভিন্ন সেবা দিবে, পাশাপশি কিশোরীদের মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ দিবে। প্রতিটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় ঔষধ, অপারেশনের যন্ত্রপাতি ও অনান্য উপকরনের যোগানের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। দুর্গম এলাকা বিবেচনায় অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা বাড়াতে হবে। জীবিকা সংকটে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় এককালীন আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদান করতে হবে।