জাতীয়

আদিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট ও অংশগ্রহণমূলক বাজেটের দাবি

সোহেল চন্দ্র হাজং, ঢাকা: আদিবাসীদের জন্য বাজেট সুনির্দিষ্ট করা হোক এবং প্রয়োজনীয় জায়গায় বাজেট বাড়ানো হোক। সমতলের আদিবাসীদের অবস্থা খুবই খারাপ। তারা গ্রাম কে গ্রাম উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। সমতলের আদিবাসীদের বিষয়টি দেখার জন্য একটি আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করার দাবি ওঠেছে। হয়তো এটি চাইলে এখনি হবে না কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি বিভাগ যুক্ত করে তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ প্রদান করা যায়। ১৫ মে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত বাজেট বিষয়ক গোল টেবিল আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি এসব কথা বলেন। কাপেং ফাউন্ডেশন ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর যৌথ উদ্যোগে ঢাকার ডেইলি স্টার ভবনে “আদিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট ও অন্তর্ভূক্তিমূলক বাজেট চাই” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে রাশেদ খান মেনন এমপি আরো বলেন, এখন জাতীয় দারিদ্র্য সীমার হার ২১ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্য সীমার হার ১১ শতাংশের নিচে চলে এসেছে। কিন্তু আদিবাসীদের মাঝে দারিদ্র্যসীমা যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬৫ শতাংশ এবং সমতলে ৮০ শতাংশ হয় তাহলে তাদের মাঝ থেকে দারিদ্র্য মোচন কর্মসূচিকে আগে গুরুত্ব দেয়া উচিত। আদিবাসীদের অগ্রাধিকার দিয়ে সামনের কাতারে নিয়ে আসার জন্য বাজেট দেয়া প্রয়োজন। দেশের জাতীয় গড় আয় বাড়লেও প্রান্তিক ও আদিবাসী মানুষের আয় এখনও বাড়েনি। একই দেশে অসম উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলতে থাকলে টেকসই উন্নয়ন কার্যক্রমকে ব্যাহত করবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আগে বাজেট বক্তৃতায় একটি প্যারা বা পাঁচলাইন লিখা ছিল কিন্তু গতবছরের বাজেটগুলোতে আদিবাসীদের নিয়ে একটি লাইনও লেখা নেই যা দুঃখজনক।

রাশেদ খান মেনন আরো বলেন, “পাহাড়ে আদিবাসীদের ভাতৃসংঘাতের সুযোগ নিয়ে সেখানে অশান্তি আরো বৃদ্ধি পাবে। সেখানে আরো সেনা নিয়োগের কথা ওঠেছে। তাই পাহাড়ে আদিবাসীদের ঐক্য ও সংগ্রামকে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। পাহাড়ের সমস্যা সমাধানে আদিবাসী-বাঙালি একসাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।” তিনি বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা সমাধানে সেখানে ভূমি কমিশন গঠন করা হলো, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন সংশোধন করা হলো। কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হলো কিন্তু তবুও ভূমি কমিশন কাজ করতে পারছে না। ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান অভিযোগ করে বলেন পাহাড়ী সদস্যদের ডাকা হলে আসেন না আবার আদিবাসীরা বলেন ভূমি কমিশনের প্রবিধান প্রণয়ন করা হয়নি। প্রবিধান না হলে প্রবিধান করতে হবে । এতো কিছু করে ভূমি কমিশন অর্জন করা হলো এখন যদি কাজ না করে তাহলে লাভ কী হবে?”

আলোচনায় প্রধান বক্তা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন আদিবাসীরা ন্যায়সঙ্গতভাবে বাজেটে যা প্রাপ্য তা তারা পাচ্ছে না। তিনি বলেন, চলতি বাজেটে একজনের পেছনে গড়ে মাথাপিছু ব্যয় ধরা হয়েছে সাতাশ থেকে ঊনত্রিশ হাজার টাকা কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যে বাজেট আছে তাতে মাথাপিছু গড়ে ব্যয় হচ্ছে ছয় থেকে সাতহাজার টাকা করে। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে আদিবাসীদের জন্য বাজেট কত তা বের করতে হলে প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়ে আদিবাসী শাখা থাকতে হবে। তাহলে আদিবাসীদের মাথাপিছু ব্যয় বাজেটে কত রাখা হয় তা নির্ধারণ করা যাবে। এম এম আকাশ আরো বলেন, সমতলের আদিবাসীদের বিষয়টি আরো লজ্জাজনক। বাজেটে তাদের মাথাপিছু ব্যয় গড়ে মাত্র ২০০ টাকা। এটা ছাড়া সমতলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আদিবাসীদের জন্য কত ব্যয় হয় তা বের করা উচিত। তিনি বলেন, সংগ্রাম করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এখন আরেকটা সংগ্রাম করে সমতলের জন্য একটি মন্ত্রণালয় বা শাখা করতে পারলে সমতলের আদিবাসীরা কিছুটা বরাদ্দ পেতে পারে। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো নির্বাচন। এ নির্বাচন করতে হলে পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত আদিবাসী ও স্থায়ী অআাদিবাসীদের তালিকা করে ভোটার বানাতে হবে। এবং সেই জেলা পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত এটা করা না হবে ততদিন পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেটের চুঁইয়ে পড়া কিছু অংশ আদিবাসীরা পাবে। তিনি জেলা বাজেট প্রণয়ণের পক্ষেও কথা বলেন যেটি সরকার বাবার অঙ্গীকার হরেও আর জেলা বাজেট বাস্তবায়ন করছে না।

এম এম আকাশ বলেন, বলা হচ্ছে বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭% অতিক্রম করে ৮% এর পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। ৮% প্রবৃদ্ধি মানে হলো পৃথিবীর ছয়টি দেশের মধ্যে একটি। এতো উন্নয়ন হচ্ছে দেখে তিনি অর্থমন্ত্রীর প্রতি পাঁচটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, ৫টি প্রশ্ন হলো, ১. দেশে উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু এ উন্নয়নে প্রান্তিকরা অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে কী? ‘না’ কারণ তারা আরো উৎখাত বা নেগিটিভ অবস্থায় চলে যাচ্ছে, যেমন আদিবাসীরা প্রান্তিক থেকে আরো প্রান্তিকতর হচ্ছে। ২. উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ছে কেন? ৩. উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু কর্তৃত্ববাদ বাড়ছে কেন, গণতন্ত্র সংকোচিত হচ্ছে কেন? ৪. বৃহৎ শিল্পপতিরা ঋণখেলাপী হচ্ছেন, সুবিধা পাচ্ছেন, কিন্তু ক্ষুদ্র ঋণগ্রহিতরা ৯৯% ঋণ পরিশোধ করছে কেন? ৫. প্রবাসী দরিদ্ররা দেশে টাকা পাঠাচ্ছে আর দেশী বড় ধনীরা বাইরে টাকা পাচার করছে কেন?
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, আদিবাসীরা শুধু দরিদ্র না তারা সবদিক থেকে প্রান্তিকতার শিকার। আমাদের দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার কিন্তু মানবিক উন্নয়নে আরো বেশি উদ্যোগ নিতে হবে। সংবিধানেই আমাদের প্রান্তিক মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। তিনি এবারের বাজেটে আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য ভালো কিছু প্রত্যাশা করেন।

সাংবাদিক গোলাম মোর্তজা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে মূল সমস্যা হলো ভূমি সমস্যা। ভূমি সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ আগে নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পুলিশ বাহিনীর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গেলেও আসলে সেখানে পুলিশ শাসন চলছে না, এর অন্তরালে অন্য কেউ পার্বত্য চট্টগ্রামকে চালাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় আসলেই আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য কাজ করছে কীনা তা খতিয়ে দেখতে হবে।” তিনি বলেন দেশ থেকে এখন ‘আদিবাসী’ শব্দটিই ওঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আদিবাসীদেরকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা অন্য নামে সম্বোধন না করে ‘আদিবাসী’ নামটিই ব্যবহার করার জন্য তিনি বলেন । বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন আদিবাসীদের রাষ্ট্র নাগরিক হিসেবে পূর্ণ মর্যাদা না দিয়ে তাদের জন্য বাজেটে করুণা করে একটি থোক বরাদ্দ দেয়া হয়। যা অপর্যাপ্ত। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি বা সুবর্ণ জয়ন্তী পালনে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে। হয়তো অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য বাড়াতে আদিবাসী নৃত্যশিল্পীদের পারফর্ম করার জন্য ডাকা হবে। আদিবাসীরা যে দুর্দশার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছে তারা কীকরে এ অবস্থায় এ সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে অংশ নিবে! এছাড়া এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এর সমন্বয়ক আনিসাতুল ফাতেমা ইফসুফ বলেন, এসডিজি’র মূল মন্ত্র হলো কাউকে পেছনে ফেলে না রাখা। জাতীয় বাজেট এসডিজি অনুবর্তী না হলে সেটা বড় দুঃখজনক হবে। আদিবাসীরা পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠী তাদের জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে বলে তিনি দাবি জানান। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান ও অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা। আলোচনায় আরো অংশ নেন হরেন্দ্রনাথ সিং, শান্তিবিজয় চাকমা, সেকান্দার আলী, তামলিমন বাড়ৈ, সুভাষ হেমব্রম, শশাঙ্ক রিছিল, মাহবুব আলম, সিফাত রৌফ, মংমংসিং, এভিলিনা চাকমা প্রমুখ।

গোলটেবিল আলোচনায় “আদিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট ও অন্তর্ভূক্তিমূলক বাজেট চাই” শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাপেং ফাউন্ডেশন-এর কর্মকর্তা সোহেল হাজং ও খোকন সুইটেন মুরমু। তারা প্রবন্ধে তোলে ধরেন, আদিবাসীরা তাদের সংখ্যা অনুপাতে বাজেট বরাদ্দ হতে বঞ্চিত হচ্ছে। বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তাদের কোন সরাসরি অংশগ্রহণ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি মন্ত্রণালয় হওয়ার ফলে সেখানে বাজেট বরাদ্দ রাখা হলেও সেটি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং শুধুমাত্র আদিবাসীরা এর উপকারভোগী নয়। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ পার্বত্যচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, ভূমি সমস্যা সমাধান, আদিবাসী উদ্বাস্তদের পুনর্বাসন-এসব মূল সমস্যা সমাধানে বরাদ্দ থাকে না। গত অর্থবছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বাজেট বরাদ্দ ছিল ১৩০৯ কোটি টাকা। আর সমতলের আদিবাসীদের বাজেট বরাদ্দের জন্য কোন একটি নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর এখনও নেই। তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে “বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত)” নামে একটি কর্মসূচিতে যে থোক বরাদ্দ দেয়া হয় তা অতি নগণ্য। চলতি অর্থবছরে এ থোক বরাদ্দের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪০ কোটি টাকা। তাতে সমতলের ২০ লক্ষ আদিবাসীদের জন্য হিসেব কষলে মাথাপিছু ব্যয় পড়ে মাত্র ২০০ টাকা। আবার এর বন্টন বা বিভাজনে নানা অনিয়ম রয়েছে। যার ফলে, সমতলের বিশ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাজেটের সুবিধা থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কার্যক্রম সমতলে থাকলেও বিভিন্ন কারণে আদিবাসীরা এ সেবালাভ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে বলে তারা প্রবন্ধে আলোচনা করেন।

Back to top button