জাতিসংঘে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়নের সুপারিশ
বিশেষ প্রতিনিধি: জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ১৭তম এই অধিবেশনে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে রোডম্যাপ ঘোষণা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে ক্ষমতা ও কার্যাবলী হস্তান্তর এবং ভূমি কমিশনের কার্যবিধিমালা প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় অর্থ ও জনবল বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়েছে।
গৃহীত সুপারিশমালায় বলা হয় যে, “১০. ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের অবস্থার উপর গবেষণার জন্য নিযুক্ত স্পেশাল র্যাপোটিয়র কর্তৃক সুপারিশমালার প্রতি স্মরণ করে, নি¤েœাক্ত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নের জন্য স্থায়ী ফোরাম বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহিত করছে যে, (১) পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট কর্তৃত্ব হস্তান্তরসহ চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য সময়সূচি নির্ধারণ করা; ২) পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের কার্যবিধিমালা গ্রহণ করা এবং কমিশনের জন্য পর্যাপ্ত জনবল ও অর্থসম্পদ বরাদ্দ করা।”
গত ১৬ এপ্রিল হতে ২৭ এপ্রিল ২০১৮ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ১৭তম অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এই সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। উল্লেখ্য যে, এবারের অধিবেশনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল “Indigenous peoples’ collective rights to lands, territories and natural resources” অর্থাৎ ‘ভূমি, ভূখন্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সমষ্টিগত অধিকার’। ১৬ এপ্রিল ২০১৮ সকাল ১১:০০ টায় অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মালি থেকে আগত টুয়ারেগ জনগোষ্ঠীর এক প্রতিনিধি মিস মারিয়াম ওয়ালেট এ্যাবাউবাকরাইন-কে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের চেয়ারপারসন হিসেবে পুননির্বাচিত করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য প্রদান করেন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি মি: মিরোস্লাভ লাজচাক, বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সহকারী মহাসচিব ইলিয়ট হ্যারিস।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি মি: মিরোস্লাভ লাজচাক অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বলেন যে, জাতিসংঘ যখন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামসমূহে প্রবেশাধিকারে সক্ষম করতে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিল-সংগঠনটি তখন ‘ইহার দরজা ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত’ করেনি এবং অধিকতর উচ্চাকাক্সক্ষী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস, যিনি নিজেই আদিবাসী আইমারা জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য, তাঁর বক্তব্যে বলেন যে, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী তাদের পরিবেশ ও স্থায়ীত্বশীল জীবিকা সুরক্ষার পুরোভাগে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী এবং তাদের মত অন্যান্য যারা রয়েছেন তাদেরকে সামান্য লাভজনক একটি ব্যবস্থার জন্য আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে মা পৃথিবীর অধিকারকে সুরক্ষার জন্য সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন।
জাতিসংঘের এই সভায় সারা বিশ্বের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী, সদস্য-রাষ্ট্র, জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা, শিক্ষক-গবেষক, মানবাধিকার সংগঠনের প্রায় ১২০০ প্রতিনিধি যোগদান করেন। এতে বাংলাদেশের আদিবাসীদের পক্ষে ১৩ জন আদিবাসী প্রতিনিধি এবং সরকারের পক্ষে ৭-৮ জনের প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের আদিবাসীদের পক্ষে প্রতিনিধিরা হলেনÑ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা, জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামের সাবেক বিশেষজ্ঞ সদস্য ও চাকমা সার্কেলের চীফ রাজা দেবাশীষ রায়, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা বকুল, রাণী ইয়ান ইয়ান, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের প্রতিনিধি লিনা জে লুসাই, জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি অগাস্টিনা চাকমা, সিএইচটি ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি কৃষ্ণ আর চাকমা, বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের প্রতিনিধি সমরজিৎ সিনহা, মালেয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি মৃণাল কান্তি ত্রিপুরা, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সংক্রান্ত জাতিসংঘ স্বেচ্ছাসেবী তহবিলের প্রতিনিধি বিনোতাময় ধামাই, বাংলাদেশের পটুয়াখালীর অধিবাসী (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থানকারী) নওয়ে ওউ এবং রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ের অধিবাসী কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিলের ছাত্র চিপামং চৌধুরী (রেবোতা ভান্তে)। সরকারের প্রতিনিধি দলের পক্ষে ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: নুরুল আমিন, অতিরিক্ত সচিব সুদত্ত চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল হক, পিএমডি’র পরিচালক লে. কর্ণেল তানভির আহমেদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নন্দ দুলাল ভৌমিক। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার ২/৩ জন লোক অংশগ্রহণ করেন বলে জানা গেছে।
বক্তব্য উপস্থাপন
সরকারের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: নুরুল আমিন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল হক বক্তব্য প্রদান করেন। মো: নুরুল আমিন এজেন্ডা আইটেম-৮ এর মূল প্রতিপাদ্য ‘ভূমি, ভূখন্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সমষ্টিগত অধিকার’ বিষয়ে প্রদত্ত তার বিবৃতিতে ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী’ সম্পর্কে অভিমত বিষয়ে সরকারের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন এবং বিষয়টি বিভিন্ন ঐতিহাসিক, ঔপনিবেশিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপটের আওতায় সুবিবেচনাপূর্ণভাবে প্রয়োগ হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন যে, বর্তমান সরকার সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে সক্রিয় সম্পৃক্ততা ও পরামর্শের মাধ্যমে শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রতি দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ রয়েছে।
অপর এক পৃথক বিবৃতিতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল হক বলেন, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ব্যতীত কমিশনের অন্যান্য সকল সদস্যরা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সদস্য। তিনি আরও বলেন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে সংশ্লিষ্ট সকলের পূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন, যে সহযোগিতা পার্বত্য জনগণের ভূমি মালিকানা প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত।
আদিবাসী প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বিবৃতি উপস্থাপন করেন জনসংহতি সমিতির মঙ্গল কুমার চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির সন্তোষিত চাকমা, কাপেং ফাউন্ডেশনের পল্লব চাকমা ও জনসংহতি সমিতির অগাস্টিনা চাকমা।
মঙ্গল কুমার চাকমা ‘এজেন্ডা আইটেম-৪: জাতিসংঘের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র বিষয়ে স্থায়ী ফোরামের ম্যান্ডেটভুক্ত ছয় কর্মক্ষেত্র বাস্তবায়ন’ বিষয়ে তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি স্থায়ী ফোরামের ম্যান্ডেটভুক্ত ছয় কর্মক্ষেত্র বাস্তবায়নের সাথে সম্পর্কিত। তিনি বলেন, বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতি অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে প্রবর্তিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতায় আইন অনুযায়ী সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব কার্যকর করতে হবে। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি অধিকতর অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। আদিবাসী জুম্ম জনগণকে তাদের পিতৃভূমিতে সংখ্যালঘু করার নীল নকশা দ্রুত বাস্তবায়িত করা হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, সরকার উন্নয়ন কার্যক্রম হতে সামরিকায়ন, সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ, রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, নির্বিচারে বহিরাগতদের নিকট ভূমি ইজারা প্রদান, পর্যটন শিল্প সম্প্রসারণ ইত্যাদি সকল প্রকার কৌশল ব্যবহার করে চলেছে।
পল্লব চাকমা ‘এজেন্ডা আইটেম ১০: আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক স্পেশাল রেপোটিয়ার এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক এক্সপার্ট মেকানিজম এর চেয়ারপারসনের সাথে সংলাপ’ বিষয়ে তার বিবৃতিতে বলেন, খনিজ নিষ্কাশন, কৃষিজ ব্যবসা ও জলবিদ্যুৎকে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী কর্তৃক বিরোধীতার সম্মুখীন হওয়া সর্বোচ্চ প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেগুলো তাদেরকে অপরাধীকরণের দিকে নিয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রসমূহের উচিত, বিশেষত শান্তি সমঝোতার আওতায় অন্তর্বর্তীকালে ও অঞ্চলে দেশসমূহের জন্য চুক্তি ও সমঝোতাসমূহ (যেমন পার্বত্য চুক্তি) এবং অন্যান্য গঠনমূলক ব্যবস্থাবলীর বাস্তবায়নসহ, আদিবাসীদের প্রভাবিত করছে এমন সামরিকায়নকে তুলে ধরার জন্য একটি অর্থপূর্ণ সংলাপে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার সংস্থা ও অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সাথে সহযোগিতার ক্ষেত্রে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা।
সন্তোষিত চাকমা বকুল ‘এজেন্ডা আইটেম-১২: অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ কর্তৃক বিবেচিত বিষয় ও উদীয়মান বিষয়সহ, স্থায়ী ফোরামের ভবিষ্যত কার্যক্রম’ বিষয়ে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তি
ও পার্বত্য চুক্তির বিধানাবলী কার্যকর ও দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন; জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের ভূমি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য বাঙালি সেটেলারদের সম্মানজনকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে কার্যত সামরিক শাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ ৪ শতাধিক অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে প্রভাবিত করতে স্থায়ী ফোরামের প্রতি আবেদন জানান।
অগাস্টিনা চাকমা ‘এজেন্ডা আইটেম-৫: আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সাথে সংলাপ’ বিষয়ে আলোচনায় বলেন, স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছেÑ কাউকে পেছনে ফেলে না রাখা। অথচ ২০১৭ সালের জুলাইয়ে উপস্থাপিত বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবামূলক জাতীয় পর্যালোচনা প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, সরকার তার ‘কাউকে পেছনে ফেলে না রাখা’র লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকেনি। তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী ও শিশু কর্তৃক সম্মুখীন প্রধান বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করা ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
উল্লেখ্য যে, এজেন্ডা আইটেম-৮ বিষয়ে আলোচনার সময় রাজা দেবাশীষ রায় অন্যতম প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এসময় বিনোতাময় ধামাইও জাতিসংঘের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সংক্রান্ত স্বেচ্ছাসেবামূলক তহবিলের চেয়ারপারসন হিসেবে বক্তব্য রাখেন।
এশিয়া ইন্টার-এ্যাকটিভ ডায়লগ
স্থায়ী ফোরাম এবারই প্রথম ‘ভূমি, ভূখন্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদ’ বিষয়ে সদস্য-রাষ্ট্র ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে পরস্পরের মধ্যে সংলাপের (ইন্টার-এ্যাকটিভ ডায়লগ) আয়োজন করে। সেই অনুযায়ী ২৪ এপ্রিল ২০১৮ বিকেলের অধিবেশনে এশিয়া অঞ্চলের ইন্টার-এ্যাকটিভ ডায়লগ অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দল ও বাংলাদেশের আদিবাসী প্রতিনিধিদের মধ্যকার সংলাপটি উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। সংলাপ অনুষ্ঠানে তিন প্যানেল আলোচক যথাক্রমে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক স্পেশাল র্যাপোটিয়ার, এআইপিপি’র সেক্রেটারি জেনারেল ও নেপাল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক সদস্য কর্তৃক বক্তব্য দেয়ার পরপরই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব একটি লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন এবং তাতে বলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠন করে, যে কমিশনে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ব্যতীত সকল সদস্যগণ সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী।
এরপর পল্লব চাকমা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমেই স্থায়ী ফোরামের সাথে অব্যাহতভাবে সম্পৃক্ত থাকার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানান। তিনি সরকার আদিবাসীদের জন্য আদিবাসী ৫টি ভাষায় পাঠবই প্রকাশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট আইন প্রণয়ন ইত্যাদি কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে উল্লেখ করেন। এতে তিনি আরও বলেন, সরকার যদিও ভূমি কমিশন গঠন করেছে, কিন্তু এই আইনের বিরোধাত্মক ধারাসমূহ সংশোধন করতে ১৬ বছর ব্যয় করা হয়েছে এবং পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২০ বছরেও একটি ভূমি বিরোধও নিষ্পত্তি করা হয়নি। বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয়ে কমিশনের কার্যবিধিমালার অনুমোদন ঝুলিয়ে রাখার কারণে ভূমি কমিশনের কাজ স্থবির অবস্থায় রয়েছে।
এরপর মঙ্গল কুমার চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যানসহ বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদলকে সম্ভাষণ জানিয়ে সংলাপে অংশগ্রহণ করেন। তিনি তার আলোচনায় বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইন ও শৃঙ্খলা, পুলিশ, বন ও পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়সমূহ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দিলেও এইসব বিষয়সমূহ এই পরিষদগুলোকে হস্তান্তর করা হয়নি। এমনকি সরকার পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে ভূমি হস্তান্তর, বন্দোবস্তী, ভূমি অধিগ্রহণ অব্যাহত রেখেছে এবং ভূমি-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের এখতিয়ারে আনে না। তিনি স্পেশাল রেপোটিয়ারকে প্রশ্ন রেখে বলেন, তার দপ্তর চুক্তির এইসব গুরুত্বপূর্ণ ধারাসমূহ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহিতকরণে কিভাবে সহযোগিতা করতে পারে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের কাছেও জানতে চান, এইসব বিষয়সমূহ সমাধানের ক্ষেত্রে সরকারের কোন পরিকল্পনা রয়েছে কিনা।
এরপর সন্তোষিত চাকমা বকুল বলেন, ডজনখানেক গণহত্যার পাশাপাশি, ১৯৮০ ও ’৯০ দশকে ভারতে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার জুম্ম আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল, যারা ১৯৯৪ সালে ১৬ দফা প্যাকেজ চুক্তি, ১৯৯৭ সালে ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তি এবং সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী দেশে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দেয়া হয়নি এবং তাদের ভূমি ফিরিয়ে দেয়া হয়নি।
ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা যায় যে, বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে কিছু লিখিত কাগজ সরবরাহ করেন। এরপর সচিব নুরুল আমিন ঐ লিখিত কাগজ পাঠ করে শোনান। সচিবের ঐ লিখিত বক্তব্যে বলা হয় যে, সরকার চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করেছে এবং চুক্তিটি বাস্তবায়নে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। সচিব তার বক্তব্য শেষ করার সাথে সাথে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যানকে কিছু বলার অনুরোধ জানান। ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল হক এসময় বলেন যে, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার বাদে ভূমি কমিশনের সকল সদস্যগণ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। সুতরাং প্রত্যেকেই ধারণা করতে পারেন যে, একটিও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব না হওয়ার জন্য কারা দায়ী। এছাড়া তিনি আরও বলেন যে, বাংলাদেশের সংবিধান দেশের সকল নাগরিককে সমান মর্যাদা দিয়েছে। বাংলাদেশে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আদৌ কোন বৈষম্য নেই।
ভূমি কমিশন চেয়ারম্যানের বক্তব্যের পরপরই স্পেশাল রেপোটিয়ার মিস ভিক্টোরিয়া টওলি-কর্পুজ তার বক্তব্য প্রদান করেন। মিস ভিক্টোরিয়া তার বক্তব্যে বলেন, সারা বিশ্বে এমন কোন দেশ নেই যেখানে বৈষম্য নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে আদিবাসীদের সন্ত্রাসী/অপরাধী হিসেবে চিহ্নিতকরণ, আদিবাসী নারী ও শিশুর উপর যৌন সহিংসতা, ভূমি বেদখল, সামরিকায়ন ইত্যাদি সংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ বেরিয়ে আসছে।
পরে কাপেং ফাউন্ডেশনের পল্লব চাকমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সুদত্ত চাকমা এসডিজির বাস্তবায়ন এবং এই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অদৃশ্যমানতা বিষয়ে আলোচনা করেন।
বিভিন্ন সাইড ইভেন্টে অংশগ্রহণ
মূল অধিবেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন সাইড ইভেন্ট তথা সেমিনারেও আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন পিসিজেএসএস’র তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, রাণী ইয়ান ইয়ান ও রাজা দেবাশীষ রায়। তন্মধ্যে ১৭ এপ্রিল ২০১৮ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব হিউম্যান রাইটস ও টেবটেবা ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার ও সংগ্রাম বিষয়ক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও সেমিনারে এবং ১৯ এপ্রিল ২০১৮ ইন্ডিজেনাস উইমেন্স নোলেজ কর্তৃক আয়োজিত ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা’ শীর্ষক অপর এক সেমিনারে প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মঙ্গল কুমার চাকমা। এছাড়া ১৮ এপ্রিল ২০১৮ মঙ্গল কুমার চাকমা ও পল্লব চাকমা জাতিসংঘে অস্ট্রেলিয়া মিশন ও টিবিসি কর্তৃক আয়োজিত ‘জাতিসংঘের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র বাস্তবায়িতকরণ এবং আদিবাসী প্রতিকূলতার ক্ষেত্রে ব্যবধান হ্রাসকরণ’ শীর্ষক এক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ২০ এপ্রিল ২০১৮ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর কাজের পরিবেশ’ শীর্ষক অপর এক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন পল্লব চাকমা।