পার্বত্যাঞ্চলের তথাকথিত ভ্রাতৃঘাতী প্রসঙ্গ ও লারমা দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে লড়াই-সংগ্রাম: বাচ্চু চাকমা
কাউকে বা কোন পক্ষকে প্রশংসার জন্য কিংবা স্রেফ সমালোচনার জন্য বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আমার এ লেখা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের তথাকথিত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত, নানা বিভক্তির প্রসঙ্গে বাস্তব সত্যটাকে জনগণের সম্মুখে উপস্থাপন করার জন্যে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। প্রথমে বলে রাখা শ্রেয় মনে করছি যে, পাহাড়ের জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার জন্যে শাসকশ্রেণির ষড়যন্ত্রের কোন শেষ নেই। বিভক্তি মানে কি? অভিধানের ভাষায় যদি বলি বিভক্তি মানে হল ভাগ বা বিভাজন! আমি যদি রাজনৈতিক গ্রামারে চলে যাই তাহলে দেখবো যে, বিভক্তি মানে পার্থক্য আর পার্থক্য মানেই হল দ্বন্দ্ব। পার্থক্যটা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করা হবে, চিন্তা-চেতনা বা নীতি, আদর্শগত পার্থক্য ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, মতাদর্শগত পার্থক্য একই সমাজের মানুষের চিন্তা-চেতনা তথা দৃষ্টিভঙ্গির অমিল। অপরদিকে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের দিকে যদি একটু ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো কোন স্তর থেকে বিভক্তির শুরু হয়েছে। তীর ছুঁড়তে গেলে আগে পেছনে টেনেই ছুঁড়লে তখন গতি বেশি হয় এবং কার্যকরী হয়। ঠিক তেমনিভাবে পাহাড়ের এই বিভক্তি ও বিপরীতের সংগ্রাম আলোচনা করতে হলে আমারও ইতিহাসের পেছনের অধ্যায়ে ফিরে যেতে হবে।
মানবসমাজের ক্রমবিকাশের এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা ব্যক্তিগত মালিকানা যখনই উদ্ভব হয়েছে তখন থেকে সমাজের মধ্যে বিভক্তি শুরু হয়েছিল। সেখান হতে শুরু হল মানবসমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব আর সংঘাত। শুরু হল শাসক আর শোষিতের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব যাকে রাজনীতির ভাষায় বলা হয় শ্রেণীসংগ্রাম, একশ্রেণি আর আরেক শ্রেণির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও অবশেষে রাষ্ট্রযন্ত্রের পীড়ন। তাহলে আসল কথায় চলে যাই, বিভক্তি মানেই হল ভাগ, ভাগ মানেই হল পার্থক্য আর পার্থক্য মানেই হল দ্বন্দ্ব। আবার এখানে আরও কথা আছে, দ্বন্দ্ব কিসের উপর ভিত্তি করে পরিচিহ্নিত করা হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, নীতি ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে দ্বন্দ্ব পরিমাপ করতে হবে। কিন্তু অতীব দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এখনও অনেকেই মনে করেন জেএসএস ও ইউপিডিএফ এর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব-সংঘাত, জেএসএস ও সংস্কারপন্থী মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব, জেএসএস ও ইউপিডিএফ গনতান্ত্রিক দলের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব, জেএসএস ও জুম্মলীগ-জুম্মদল মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব ও সংঘাত।
আমি আবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই জেএসএস ও অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব-ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব-সংঘাত নয়, এটা হল আদর্শগত দ্বন্দ্ব, আদর্শের লড়াই। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলা হবে, এই দ্বন্দ্ব হল প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল এর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। এই লড়াই ভাইয়ে-ভাইয়ে লড়াই নয়, এই দ্বন্দ্ব ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্ব নয়; এটা আদর্শের লড়াই, নীতি-আদর্শগত দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত বুঝতে হলে অধ্যয়ন করতে হবে প্রয়াতনেতার চিন্তাধারা এবং তাঁর গোটা জীবন ও সংগ্রাম। অধ্যয়ন করতে হবে তিনি লাম্বা আর বাদীর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব কিভাবে নিরসন করতে চেয়েছিলেন? ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে কিভাবে আমরা আমাদের প্রিয়নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে হারালাম। জুম্ম সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে শিকড়গড়া সেই গুণেধরা সামন্তীয় সমাজের ভুল চিন্তাধারাগুলো পরিচিহ্নিত করে সেই ভুল চিন্তাধারার বিরুদ্ধে তিনি কিভাবে আমৃত্যু সংগ্রাম চালিয়েছেন। পৃথিবীর বুকে এধরনের মহা মানবের আবির্ভাব ক্ষণস্থায়ী হয়। কিন্তু তিনি যে আদর্শকে লালন করেছিলেন সেই আদর্শের কোন মৃত্যু নেই। জুম্মজাতির সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ও বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের প্রতি তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস, গভীর মহানুভবতা আর ভালবাসা। যার কারণে হাজারো ভুল করার পরেও জুম্ম জাতীয় স্বার্থে, সামগ্রিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে “ক্ষমা করা-ভুলে যাওয়ার” নীতির ভিত্তিতে চক্রদের সকল প্রকার ভুলচিন্তাধারার পরিবর্তনের সুযোগ দিয়ে একেবারেই ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। বিপরীতে বিভেদপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল ও চরম সুবিধাবাদীরা জেএসএস ও গোটা জুম্ম জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করল এম এন লারমাকে হত্যা করে এবং সৃষ্টি করল জুম্ম জাতির ইতিহাসে এক কলংকজনক অধ্যায়। ইতিহাসের এই বাস্তব ঘটনা হতে শিক্ষা নিতে হবে এই ভেবে যে, “প্রতিক্রিয়াশীলরা জুম্মজাতির জন্য কখনও কোনদিন আপন ও মঙ্গলদায়ক হতে পারেনি, পারবেও না”।
যদিও আমার আলোচনার বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল তারপরও গভীরভাবে আলোচনার দাবী রাখে। জেএসএস তাঁর জন্মলগ্ন থেকে বিভক্তি, শোষণ, বৈষম্য, মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ ও পীড়নের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিল। নিশ্চয়ই মনের গভীরে গেঁথে নেওয়া দরকার এম এন লারমার হাতে গড়া জুম্ম জনগণের প্রাণের সংগঠন জনসংহতি সমিতি তাঁর গঠনতন্ত্রে পরিষ্কারভাবে বলা আছে যে, জেএসএস হল শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত জাতি ও মানুষের পার্টি। তাহলে আমাদের পিসিজেএসএস এর নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখাটা নিশ্চয়ই সমীচীন হবে। পিসিজেএসএস এর নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন একদিন লারমা দুই ভাই ও তাঁদের সাথে একই পথের পথিক বিপ্লবী বীর সেনানীরা। বিপ্লবী দুই লারমার হাত ধরে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে প্রাণের সংগঠন জনসংহতি সমিতি তাঁর সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বের গতিধারা। দীর্ঘ প্রায় ৪৭ বছর ধরে চলা জুম্ম জনগনের প্রাণের সংগঠন নানা চরাই উৎরাই পেরিয়ে, হাজারো বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে এখনও তার ন্যায়সঙ্গত দাবী দাওয়া থেকে এক পাও পিছপা হয়নি। পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হলে সংগ্রাম ছাড়া কোন বিকল্প পথ নেই। সেজন্য অসংখ্য বীর সেনানী প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে জুম্মজাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সামিল হয়েছিলেন।
এম এন লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমা ক্রিয়াকর্মের মধ্যে “শত ফুল ফুটুক ও শত রকমের মতবাদ পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করুক” এই চিন্তাধারাদ্বয় স্পষ্ট করে ফুটে উঠে। কিন্তু যারা ক্ষমতালোভী, প্রতিক্রিয়াশীল ও সুবিধাবাদীদের মুখে নেতার বিরুদ্ধে অকারণে নিন্দার প্রলাপ ভুগতে শুনবেন। সেই দালাল চক্রের মুখে মিথ্যার বেসাতি ও গোয়েবলসীয় প্রোপাগাণ্ডাকেও হার মানায় এমনই ভিত্তিহীন বক্তব্য শুনবেন ভুরিভুরি। জুম্ম জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীকরুপে আবির্ভূত হওয়া এই প্রাণপ্রিয় সংগঠনের বিরুদ্ধে যতই অপলাপ চড়াও না কেন, যতই বিভক্তির প্রসঙ্গ হাজির করে শাসকশ্রেণির গুনগান করে চলো না কেন, একদিন সত্যের সন্ধানে চলা আদর্শের কাছে ধরা দিয়ে জুম্ম জাতির নিকট প্রতারণা ও বেঈমানের চরম খেসারত দিতে হবে। সেই দিনের অপেক্ষায় থাকবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের সামগ্রিক অধিকারের স্বার্থে ও জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্যে অসমশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা দুই লারমার আদর্শ ও চেতনার বিশ্বাসী পাহাড়ের অসংখ্য বীর সেনানী। যে আদর্শ ও চেতনার কোনকালে মৃত্যু হয়নি, হবেও না। মনে রাখবেন, এই আদর্শকে শুধুমাত্র কিছু সময় পর্যন্ত নিশ্চুপ করে রাখা যায়, কিন্তু সমূলে উৎপাটন করা যায় না।
অনেককেই হতাশা প্রকাশ করে বলতে শুনেছি জুম্মরা অনেক ভাগে বিভক্ত। আমি বলি আমার প্রিয় জুম পাহাড়ের মানুষ বিভক্ত হয়নি, বরং শাসকশ্রেণিরা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে “ভাগ কর, শাসন কর” এই ব্রিটিশদের নীতির ভিত্তিতে জুম্মদের শাসন, শোষণ করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রাণের সংগঠন জনসংহতি সমিতি জন্মলগ্ন থেকেই সেই বিভক্তি আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছে। যারা আজ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত নিয়ে তালমাতাল তাদেরকে আমি আহ্বান করতে চাই যে, আপনারা জুম্ম সমাজ ব্যবস্থা এবং জুম্ম সমাজের শ্রেণি বিশ্লেষণে চলে আসুন। বিষয়টি সম্পর্কে তখন আরো বেশি পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে পারবেন। অন্যদিকে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের স্তরগুলোতে আরও একটু করে জানার চেষ্টা করলে তো ক্ষতি নেই। আমরা মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় দেখতে পেয়েছি, বিকাশের এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উদ্ভব হল, সাথে সাথে উদ্ভব হল শ্রেণি এবং বিষয়টা আরও দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে উঠলো ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু, শাসক-শাসিত, শোষক-শোষিত মধ্যেকার বিভক্তি ও বৈষম্যের অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। সেই আদিম সাম্যবাদী সমাজের পরবর্তী স্তর দাস সমাজ হতে শুরু হল এই বিভক্তির অগ্রযাত্রা। সেই থেকে আজো পর্যন্ত চলছে মানবসমাজের শোষক ও শোষিত শ্রেণির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব আর সংঘাত।
শাসকশ্রেণি আমাদের মধ্যেকার “ভাগ কর, দুর্বল কর তারপর শাসন কর” এই নীতির উপর ভিত্তি করে জানান দেয় আমি সকল দুর্বল জাতি সবাইকে শাসন শোষণ করতে জন্মলাভ করেছি। সেদিন হতে সে ধরে নেই যে, শাসন-শোষন করাটাই তার জন্মসিদ্ধ। কিন্তু এই শাসকেরা জানেনা অত্যাচারীরা চিরদিনই ভীরু হয়। অত্যাচারীর একদিন নয় একদিন পতন হবে, বস্তুর লয় বা ধ্বংসের অনিবার্য পরিণতি সেই অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীকে ভোগ করতে হবে। প্রতিটি শাসকই তো চক্রব্যুহ রচনা করেন। শাসকশ্রেণির এই চক্রব্যুহ ভাঙা এতোই সহজ নয়, মহাভারতের সেই দীর্ঘ কাহিনীতেও স্বয়ং কৃষ্ণের নির্দেশনায় একমাত্র পান্ডু্পুত্র অর্জুনই চক্রব্যুহ ভাঙতে সক্ষম হয়েছে। শাসকশ্রেণির এই ব্যুহচক্রের ভেতর যারা ঢুকেছে তারা সেখান হতে বেরিয়ে আসতে পারেনি, ফলে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত কেন? ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি কেন করতে যাবো? এই জাতীয় সস্তা স্লোগানে জনগণের সমর্থন আদায় করে নিয়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে চলে। শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট সংস্কারপন্থী, ইউপিডিএফ, জুম্মলীগ, জুম্মদলের শ্রেণিচরিত্রও ঠিক তাই এবং তাদের সাথে সুর মেলায় কিছু তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত একদল মানুষ, যারা মানবতার নামে মুখে ফেনা তুলেন কিন্তু কার্যকরের ক্ষেত্রে দোদুল্যমান, সুবিধাবাদীতার মুখোশ পরে ভদ্র সেজেগুজে চুপসে যান। এই দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত বিচার-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে যথোপযুক্ত পন্থা পদ্ধতির মাধ্যমেই সমাধানের পথ খুঁজে নিতে অনেকেই জীবন যৌবন দিয়ে চলেছেন। যেমনি খুঁজে নিয়ে যথাযথভাবে সমাধান করতে চেয়েছিলেন প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং বর্তমান নেতা সন্তু লারমার এখনো চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেনি। কিন্তু যারা প্রতিক্রিয়াশীল, বিভেদপন্থী ও সুবিধাবাদী তারাই সন্তু লারমার সেই যথোপযুক্ত বাস্তব সম্মত প্রক্রিয়াকে ভেস্তে দেওয়ার জন্যে বারেবারে ষড়যন্ত্র করে থাকেন।
আরো উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিকভাবে জুম্মরা অনেকে বলেন আমরা নাকি চার ভাগ, আবার অনেকেই বলতে শুনেছি ৭ ভাগে বিভক্ত! যেমন; পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, সংস্কারপন্থী দল, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-গণতান্ত্রিক, আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে যুক্ত জুম্ম, বিএনপি’র রাজনীতির সাথে যুক্ত জুম্ম, জাতীয় পার্টি রাজনীতির সাথে যুক্ত জুম্ম এভাবে বিভক্তি ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের কথা উপস্থাপন করার চেষ্টা করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ মাত্র দুই ভাগে বিভক্ত; শাসক বনাম শোষিত। শাসকশ্রেণির পক্ষে ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থী দল, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দল, জুম্মলীগ, জুম্মদল, জাতীয় পার্টি ও সমাজের কিছু সুবিধাবাদী মানুষ। এরা সবাই হল শাসকশ্রেণির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, সেজন্য তারা চেহারার দিক থেকে জুম্ম হলেও মন ও চেতনার দিক থেকে প্রকৃত জুম্ম হতে পারেনি। কারণ জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব সংরক্ষণের বিপরীতে ওরা শাসকশ্রেণির গুণগান করে এবং জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে চিরতরে ধ্বংস করতে সব সময় সোচ্চার থাকেন। আর বিপরীতে সমগ্র জুম্ম জনগণ যারা অধিকার নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে বেঁচে থাকতে চায় তারাই হল আসল শোষিতশ্রেণি জুম্ম জনগণ। সেই জুম্ম জনগণের সামগ্রিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে জনসংহতি সমিতি তার জন্মলগ্ন থেকেই জুম্ম জনগণের জন্য লড়াই চালিয়েছিলো যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তাহলে সেই তথাকথিত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের নামে যে বিভক্তির কথা যারা বলেন, এবার তাদের নিশ্চয় পরিষ্কার হতে পারে যে, জুম্ম জনগণের আন্দোলন বা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতির আন্দোলন কোনদিনই ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত নয়, ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব নয়, এটা হলো নীতি, আদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং আদর্শের লড়াই ছাড়া কিছুই নয়। আরও পরিষ্কার করতে চাই আমাদের লড়াই হল শাসক আর শোষিতের লড়াই, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যেকার লড়াই। চুড়ান্ত পর্যায়ে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে যারা সংগ্রাম করে তারাই জয়ী হয়।
বিভিন্ন দেশের আভ্যন্তরীন চলমান লড়াইয়ের সময় তাদের মধ্যেকার কি বিভক্তি, বৈষম্য আর দ্বন্দ্ব ছিলো না? নিশ্চয়ই ছিলো এবং সেই দ্বন্দ্বকে কিভাবে নিয়েছিল, কিভাবে সমাধান করেছিলো, শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের পক্ষে লড়াই করা সেই সংগঠন। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলনের বাস্তব ঘটনাগুলো একটি একটি করে কি মনে পড়বে, স্মরণে আসবে কি সেই সময় যে সময় আমেরিকার বুকেও তাদের মধ্যেকার আভ্যন্তরীন যুদ্ধ হয়েছিল। আমেরিকার দক্ষিণের জনগণ দাস প্রথার বিলোপ এবং দাসদের সমঅধিকারের বিষয়টি কিছুতেই মানতে রাজি ছিল না। আর সে কারণে এ বিষয়ে বারবার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল দাস প্রথার বিলোপ দক্ষিণের জনগণের অধিকারের ওপর অযথা হস্তক্ষেপ এবং দক্ষিণের অর্থনীতি দুর্বল করার জন্য উত্তরের রাজ্যগুলোর চক্রান্ত করছে। আর এজন্যই দক্ষিণের রাজ্যগুলো আভ্যন্তরীন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৮৬১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণের এই ১১টি রাজ্য একত্র হয়ে ঠিক করলো, তারা এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। নতুন এক যুক্তপ্রদেশ বা কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা গঠন করবে। বিপরীতে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর এই হাঁকডাকের জবাবে উত্তরের রাজ্যগুলোও নির্দ্বিধায় জানালো, কোনোমতেই এই যুক্তরাষ্ট্রকে ভাঙা চলবে না। এভাবে আমেরিকার আব্রাহাম লিংকনের নেতৃত্বে অভ্যন্তরীন যুদ্ধের মাধ্যমে দাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটান।
চীনের আন্দোলনের সময় তো অনেক দল ছিলো, রাশিয়ায় অনেক বিভক্তি ছিলো কিন্তু সেখানকার জনগণ বা নিপীড়িত মানুষেরা আসল সংগঠনের সাথে ছিলেন বিধায় চীনে মাওসেতুং এর নেতৃত্বে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে অনেক সংগঠনের জন্ম হতেই পারে! কিন্তু নিপীড়িত জুম্ম জনগণের একটা সংগঠনকে আগলিয়ে শক্ত করে ধরে রাখতে হবে। যে সংগঠনের মৃত্যু নেই, তাঁর মানে হল আদর্শের মৃত্যু হয় না। কোন আদর্শের মৃত্যু নেই? নিশ্চয়ই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আদর্শের মৃত্যু নেই, সেই এম এন লারমার আদর্শেই আদর্শিত সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিরও কোনদিন মৃত্যু হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, জেএসএস আর ব্রাকেটে এম এন লারমার নামকে কালিমালিপ্ত করার চক্রান্তের কোন শেষ নেই। প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন জনসংহতি সমিতির মূলস্রোতধারা হতে চ্যূত হয়ে শাসকশ্রেণির লেজুড়বৃত্তি করে এম এন লারমার নামকে বিজ্ঞাপনপত্র বানিয়ে শাসকগোষ্ঠীর গোলামী হয়ে প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আদর্শকে বিকিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। যারা এম এন লারমার আদর্শকে শাসকশ্রেণির কাছে বিকিয়ে দেয় নিজেদের স্বার্থে তারাই তো জাতিদ্রোহী সংস্কারপন্থী নামধারী সন্ত্রাসী ও জুম্ম রাজাকার। অস্ত্রের মুখে নিপীড়িত জুম্ম জনগণকে জিম্মি করে বুঝাতে চাও কি তুমি অত্যাচারীর পক্ষে? হ্যাঁ, তোমরা যে অত্যাচারী, প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী ও বিভেদপন্থী তা সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
উল্লেখ্য যে, চীনা যুদ্ধ হল চীনের জাতীয়তাবাদী পার্টি বা কুওমিনতাং দল এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে অনুষ্ঠিত চীনের এক আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ। ১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে উত্তরের অভিযানের মধ্যেই এই যুদ্ধের সূচনা হয়। এই যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে ছিল পাশ্চাত্য বিশ্বের সমর্থনপুষ্ট চীনের জাতীয়তাবাদী দল কুওমিনতাং এবং সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে এক মতাদর্শগত সংগ্রাম। গণপ্রজাতান্ত্রিক চীনে সাধারণত এই যুদ্ধ “মুক্তিযুদ্ধ” হিসেবে অভিহিত হয়েছিল। নিরবচ্ছিন্নভাবে এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকে দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ পর্যন্ত। এক পর্যায়ে চীনের জাতীয়তাবাদী দল, কুওমিনতাং এবং কমিউনিস্ট পার্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করে যুক্ত ফ্রন্ট। আমরা জানি ১৯৪৫ সালে জাপানের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপরই ১৯৪৬ সালে চীনে পুনরায় পূর্ণমাত্রায় গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়। চার বছর পরে চীন প্রত্যক্ষ করে এক বিশাল রাজনৈতিক উত্তেজনার অবসান, যখন নবগঠিত গণপ্রজাতান্ত্রিক চীন সম্পূর্ণভাবে চিনের মূল ভূখণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে এবং প্রজাতান্ত্রিক চীনের নিয়ন্ত্রণ কেবলমাত্র তাইওয়ান, পেংঘু, কিনমেন, মাৎসু এবং অন্যান্য সংলগ্ন দ্বীপসমূহে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। যেহেতু এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দু’পক্ষের মধ্যে কোন যুদ্ধবিরতি অথবা কোন শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি সেহেতু এই যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ইতি নিয়ে বিতর্ক রয়ে গিয়েছিল। এই যুদ্ধকেও তো কোনদিন চীনা জাতি ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত হিসেবে আখ্যায়িত করেনি।
পৃথিবীর বুকে রাশিয়ার যুদ্ধটি ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাশিয়ান সাম্রাজ্য পতনের পর সংঘটিত হয়। যুদ্ধটি মূলত ‘বলশেভিক রেড আর্মি’ এবং ‘হোয়াইট আর্মি’র মধ্যে সংঘটিত হলেও বহু বিদেশি আর্মি এ যুদ্ধে রেড আর্মির বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছিল। দক্ষিণ রাশিয়ার ইউক্রেনে রেড অ্যালেকসান্ডার কোলচ্যাকের নেতৃত্বে হোয়াইট আর্মিদের পরাজিত হয়। এ ছাড়াও ১৯১৯ সালে সাইবেরিয়াতে রেড আর্মিরা হোয়াইট আর্মিদের পরাজিত করে। পরবর্তীতে অনেক স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকারী দল এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ড মিলে সোভিয়েত স্টেট করেছিল। আর অন্যরা আগের রাশিয়ান সাম্রাজ্যের ধ্যান-ধারণা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পক্ষেই ছিল। ভয়াবহতম এ যুদ্ধটি ১৯১৭ থেকে শুরু করে ১৯২১ সাল পর্যন্ত চলছিল। এ যুদ্ধে আনুমানিক ৯০ লাখ লোক প্রাণ হারান। এই যুদ্ধটিও ছিল মূলত শাসক বনাম শোষিত শ্রেণির মধ্যেকার যুদ্ধ। এই যুদ্ধকেও তো কোনদিন রাশিয়ার জনসাধারণ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত হিসেবে মনে করেনি।
মহাভারতের মধ্যেও নানা বিভক্তি, বৈষম্য, সংঘাত ও সংঘর্ষ তাদের একই পরিবারের ভেতরে ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। যার কারণে অর্জুনের তাত শ্রী মহামহিম ভীস্ম আর ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র ও দুর্য্যধনরা অর্জুনের ভাই, পাণ্ডুপুত্র অর্জুন দুষ্চিন্তায় পড়েছে তাদের ভাইদের কিভাবে হত্যা করবে? যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পান্ডুপুত্র অর্জুন এসব চিন্তা করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়ল। কিন্তু যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হতে কারোর পক্ষে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। সেকারণে শ্রী কৃঞ্চ পাণ্ডুপুত্র অর্জুনকে স্বয়ং তাঁর কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দিলেন বস্তু উৎপত্তি সম্পর্কে, ন্যায় আর অন্যায় পার্থক্য বিচার-বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিলেন যুদ্ধই অনিবার্য। সুতরাং দুর্বলতা ত্যাগ করে যুদ্ধ করতে থাকো, লাভ-ক্ষতি হিসাব না করে যদি যুদ্ধ কর তাহলে ন্যায়ের পক্ষে জয় সুনিশ্চিত হবে। সেই মহাভারতের যুদ্ধকেও ভাইয়ে-ভাইয়ের মধ্যে সংঘাত হিসেবে আখ্যা দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল, কিন্তু বাসুদেব শ্রী কৃষ্ণ পাণ্ডুপুত্র অর্জুনকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন যে, এই যুদ্ধ ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘাত নয়, এটা ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যেকার লড়াই।
ঠিক তেমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের তথাকথিত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের জিগির তুলেই ন্যায়ের পক্ষে লড়াই সংগ্রামকে বাঁধাগ্রস্ত করে শাসকশ্রেণীর নীলনকশা বাস্তবায়ন করেন যারা, তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে চাই যে জেএসএস ও অন্যান্য দলগুলোর মধ্যেকার সংঘাত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত নয়, এটা নীতি ও আদর্শের লড়াই। ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যেকার লড়াই যা প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমা এই দুই ভাইয়ের সুদক্ষ নেতৃত্বে এই লড়াই পাকিস্তান আমলের শেষে ও অধুনা বাংলাদেশ আমলের প্রথমার্ধে শুরু হয়েছিল সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলমান রয়েছে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান সংঘাতকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের লেবাস দিয়ে ন্যায়ের পক্ষে লড়াই সংগ্রামকে চিরতরে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র ছাড়া তেমন কিছুই হতে পারে না। যুগে যুগে ন্যায়ের পক্ষে লড়াই চলমান থাকবে ও নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মুক্তির সংগ্রাম দীর্ঘজীবী হোক।
………………………………………………
বাচ্চু চাকমা, সাবেক সভাপতি, পিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটি।