সীতাকুন্ডে দুই আদিবাসী কিশোরী হত্যার আদিবাসী ফোরামসহ কয়েকটি সংগঠনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন
এস জে চাকমা, সীতাকুন্ডঃ ১৮ মে ২০১৮ শুক্রবার সকাল ১১.০০ ঘটিকায় সীতাকুন্ড পৌর এলাকায় জঙ্গল মহাদেব পুর ত্রিপুরা পাড়ায় আবুল হোসেন ও তার সাঙ্গ পাঙ্গরা মিলে দুই আদিবাসী কন্যা শিশুকে ধর্ষণ এবং হত্যা করেছে। নিহত দুই জনকে একই রশিতে ঝুলিয়ে রেখে দুস্কৃতকারীরা পালিয়ে যায়। পর দিন ১৯ মে ২০১৮ ঘটনার প্রতিবাদে সিতাকুন্ড সদরে মানববন্ধন করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এবং মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশন। আদিবাসী দুই কন্যা শিশু শুক লতি ত্রিপুরা ও ছবি রানী ত্রিপুরা ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে বখাটে আবুল হোসেন, পিতা- মো. ইসমাইল,সাং চৌধুরি পাড়া,সীতাকুন্ড পৌরসভা,৫ নং ওর্য়াড,থানা- সীতাকুন্ডকে প্রধান আসামী করে অজ্ঞাতনামা তিন জনের বিরুদ্ধে সীতাকুন্ড থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। নিহত ছবি রানী ত্রিপুরার পিতা সুমন ত্রিপুরা (৩৫) বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং ২৮/১৯৮ ধারা-৩০২/৩৪ দ:বি: একই উদ্দেশ্যে হত্যা করার অপরাধ।
ঘটনা বিস্তারিত জানতে ২১ মে ২০১৮ সোমবার বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, কাপেং ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বিশিষ্ট আইনজীবী বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ ক্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত। প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হলেন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের জাতীয় কমিটির সদস্য এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি,কাপেং ফাউন্ডেশনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়কারী শরৎ জ্যোতি চাকমা, পূজা উদযাপন পরিষদের চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি শ্যামল পালিত,ত্রিপুরা কর্যাণ পরিষদের সভাপতি ফুল কুমার ত্রিপুরা,বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি ইঞ্জিয়ার পরিমল কান্তি চৌধুরি,দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক তাপস হোড়,সাগর মিত্র,তাপস কুমার দে,উত্তম শর্মা,কল্লোল সেন,পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সভাপতি অমর কৃঞ্চ চাকমা বাবু,সাধারণ সম্পাদক ডিসান তনচংগ্যা,সন্তোষ চাকমা,পাহাড়ী বৈদ্য সমিতির সভাপতি রবি বৈদ্য,বাংলাদেশ ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফ্রন্ট এর সুমন ত্রিপুরা এবং নয়ন ত্রিপুরা।
প্রতিনিধি দলের উদ্যোগে সিতাকুন্ড সদরে মহান্ত আস্তানায় নোনী গোপাল সাহা যাত্রী নিবাসে এক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ইঞ্জিয়ার পরিমল কান্তি চৌধুরির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন এ্যাড. রানা দাশ গুপ্ত। ঘটনার চার দিন পরও স্থানীয় সাংসদ,মেয়র,উপজেলা চেয়ারম্যানসহ কোন জন প্রতিনিধি ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে না যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন রানা দাশগুপ্ত । সাংসদ দিদারুল আলমের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপনি আমার ছোট ভাইয়ের মত। আপনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত। আজকে চার দিন হয়ে গেলো আপনি অসহায় মানুষের পাশে দাড়ালেন না। এলাকার মেয়র তিনিও আসার সময় পেলেন না।তাই স্থানীয় মানুষের মনে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। আপনার যদি দেশের সংখ্যালঘুদের ভোট ব্যাংক মনে করে তাদের স্বার্থকে বিবেচনায় না রেখে রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তাহলে চরম ভুল করবেন। প্রতিনিধি দলের সমন্বয়কারী,বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম,চট্টগ্রামের সভাপতি এবং কাপেং ফাউন্ডশনের বিভাগীয় সমন্বয়কারী শরৎ জ্যোতি চাকমা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানিয়ে সমাবেশে বলেন, আমরা যাতে পুলিশ প্রশাসনের উপর আস্থা রাখতে পারি । পুলিশ মুল আসামীকে গ্রেপ্তার করেছে। দ্রুত বাকীদদেরও গ্রেপ্তার করবে। তারা ময়নাতদন্ত রির্পোট ঠিক রাখবে। সকলে মিলে যাতে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার বিচার চাইতে পারি এবং সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি নিশ্চিত করতে পারি। কোন দলের কিংবা ব্যক্তির প্রভাব খাতিয়ে যেন বখাটেরা পার পেয়ে না যায়।
স্থানীয় কমিশনারের সমাবেশে বাধা প্রদান
প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দিতে আসা স্থানীয় আদিবাসীদের বাধা দেন ৫ নং ওর্য়াডের কমিশনার মো.শফিউল আলম মুরাদ। তিনি (মুরাদ) প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি শ্যামল পালিত এর সাথে বাগবিদন্তায় লিপ্ত হন এবং রানা দাশগুপ্তসহ সবাইকে কেউ ফিরতে পারবেনা বলে হুমকি দেন। স্থানীয় আদিবাসী- বাঙালিদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে ধর্ষণ ও হত্যা কান্ডে জড়িতরা সবাই কমিশনার মুরাদের ক্যাডার। সন্ত্রাসী আবুল হোসেনের নেতৃত্বে তারা বিভিন্ন সময় আদিবাসী পাড়ায় গিয়ে জঞ্জাল করতো। বখাটে আবুল হোসেন পুলিন ত্রিপুরার মেয়ে শুকলতি ত্রিপুরাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে উত্যক্ত করতো। মুলত সিতাকুন্ডে আদিবাসীরা দিন মজুরি করে সংসারের খরচ চালায়। তারা ভূমিহীন,গরীব,দুর্বল এবং অসহায়। তাদেরকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না। এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় বখাটেরা যা ইচ্ছা তাই করে । প্রতিবাদ করলে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। প্রতিনিয়ত লাঞ্চনা বঞ্চনা,মা বোনেরা নিরাপত্তাহীনতায় থাকে। দুবেলা খাওয়ার তাগিদে জুমে কিংবা অন্যের বাগানে কাজ করতে গেলে ছেলে মেয়েরা নিরাপত্তাহীন থাকে। ত্রিপুরা আদিবাসীরা প্রতিনিধি দলকে বলেন, আমাদের দেখার যেন কেউ নেই। আমাদের এই বঞ্চনাময় জীবনের কি শেষ হবেনা? অত্যাচার নির্যাতনের ধারাবাহিক অংশ হিসেবে ছবি রানী ত্রিপুরা (১১) এবং শুক লতি ত্রিপুরা (১৫) নির্মম এই হত্যার শিকার হলো। তারা বলেন, পার্শ্চবর্তী চৌধুরি পাড়ার আবুল হোসেন দীর্ঘ দিন ধরে শুক লতি ত্রিপরাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছে। বিষয়টি শুক লতি বাবা মাকে জানালে পাড়ার লোকেরা মিটিং করে তার নিরাপত্তার জন্য আবুল হোসেনকে আদিবাসী পল্লিতে আসতে বারণ করে দেয়। ১৮ মে ২০১৮ শুক্রবার তাদের বাবা মা জুমে কাজ করতে যায়। এই সুযোগে আবুল হোসেন তার সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং শুক লতি ত্রিপুরা ও ছবি রানী ত্রিপুরাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের পর হত্যা করে একই রশিতে দুই জনকে ঝুলিলে রেখে চলে যায় বলে জানা গেছে। তখন সেখানে শিশু রাজন ত্রিপুরা (৫) ছাড়া কেউ ছিলনা। রাজনই হত্যাকারীকে ছিনিয়ে দেয়। বখাটে আবুল হোসেনদের বিকৃত লালসা পূরণে রাজী না হওয়ায় শুক লতি ত্রিপুরাদের এমন পরিনতির শিকার হতে হলো। এমন নিষ্ঠুর ও বর্বর ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, কাপেং ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ,বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ পরিষদ,বাংলাদেশ পূজা উদযাপন কমিটি। বখাটে আবুল হোসেন আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে বলে পত্র পত্রিকার মাধ্যমে জানা গেছে। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে বাকী আসামিদেরও গ্রেপ্তার করার দাবি জানানো হয়। ঘটনায় জড়িত সকল আসামিদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রশাসনের প্রতি দাবি জানিয়েছেন প্রতিনিধি দলের বক্তারা। প্রতিনিধি দলের সমাবেশে উপস্থিত থেকে সংহতি জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি থেকে বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ, সীতাকুন্ড ¯্রাইন কমিটি,স্থানীয় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ও চট্টগ্রাম জেলা পূজা উদযাপন কমিটি,আদিবাসী ফোরাম,সীতাকুন্ড,মিরসরাই ও ফথিকছড়ি শাখার নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত শুক লতি ত্রিপুরা ও ছবি রানী ত্রিপুরার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান, ধর্ষক ও হত্যাকারী বাবুল হোসেন এবং তার সাঙ্গ পাঙ্গদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি ফাঁসি নিশ্চিত করা, সীতাকুন্ডে আদিবাসী পাড়ায় নিরাপত্তাসহ আদিবাসীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।