আঞ্চলিক সংবাদ
সরকারের সদিচ্ছার অভাবে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হচ্ছে না: চট্টগ্রামের সমাবেশে বক্তারা
দ্রুত চুক্তি বাস্তবায়নের আহ্বান বক্তাদের
আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): সরকারের সদিচ্ছার অভাবের কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। গতকাল ২ ডিসেম্বর ২০২২, বিকাল ৩:০০ ঘটিকায় চট্টগ্রামের জেএম সেন হল প্রাঙ্গনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছর উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এই অভিযোগ করেন।
‘জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব, সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশ এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চাই’ শ্লোগান নিয়ে বিকাল ৩:০০ টায় জে এম সেন হলে ‘চুক্তির রজতজয়ন্তী উদযাপন কমিটি’র আহ্বায়ক তাপস হোড়ের সভাপতিত্বে উক্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভা ছাড়াও চট্টগ্রাম শহরে র্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত এবং প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলা উদ্দিন।
আলোচনা সভায় আরো সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি চট্টগ্রামের সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান, প্রমা আবৃত্তি সংঘের সভাপতি রাশেদ হাসান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিতাই প্রসাদ ঘোষ, ঐক্য ন্যাপ, চট্টগ্রামের যুগ্ম সম্পাদক পাহাড়ী ভট্টাচার্য, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, সীতাকুণ্ডের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্র ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা প্রমুখ।
আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সহ-সভাপতি অনিল বিকাশ চাকমা এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক বিনিময় চাকমা ও অনিল বিকাশ চাকমা।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েক দশক আগে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা নানা সময়ে শাসকগোষ্ঠীর বাধার সম্মুখীন হয়। এই আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে অপপ্রচার চালানো হয়। বর্তমানে আমরা এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে রাজনৈতিকভাবে সাম্প্রদায়িকতা বিদ্যমান। পার্বত্য এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সেনাবাহিনী মিলে পাহাড়ের আদিবাসীদের শোষণ করছে।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য জনগণের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কঠোর আন্দোলনের ফলে অর্জিত হয়েছিল পার্বত্য চুক্তি, কারোর দয়ায় নয়। সেই চুক্তির ২৫ বছর পরেও পার্বত্যবাসীর মৌলিক কোনো কিছুর পরিবর্তন হয়নি। সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। তাই আজকের এই চুক্তির দিনকে আমরা উৎসবে পালন করতে পারছি না। বাংলাদেশের সবাই আজ এক গলায় বলতে চাই, পার্বত্যবাসীর স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে এই চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরী।
অধ্যাপক ড. আলা উদ্দিন বলেন, চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্যবাসীর মনে অসন্তোষ বিরাজ করছে। চুক্তির ২৫ বছর পরে এসে আশংকা জাগে এই চুক্তি বাস্তবায়ন হবে কিনা। চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পাহাড়ে নানা উপদলের সৃষ্টি হচ্ছে। চুক্তির বাস্তবায়ন সংখ্যায় নির্ধারণ করার বিষয় নয় বরং পাহাড়ের মানুষ নিরাপদে আছে কিনা, মৌলিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারছে কিনা সেদিকে নজর দিতে হবে। পাহাড়ের উন্নয়ন প্রকল্প যেন এক একটা প্রহসন। পাহাড়িরা ক্রমশ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে, স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে। আদিবাসীদের ভূমি সমস্যার সমাধান সহ মৌলিক ধারাগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ নিজদেশে পরবাসী। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার বাঙালি পুনর্বাসন করার উদ্দেশ্য হলো পাহাড়িদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা। রাষ্ট্রীয় বাহিনী পাহাড়িদের প্রতিনিয়ত নিপীড়ন চালায়। মুক্তিযুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থাকলেও বাংলাদেশে এখনো সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে।
শরীফ চৌহান বলেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাবের কারণেই পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয় নি। তিনি আরো বলেন, যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে ২৫ বছর আগে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই শান্তি এখনো স্থাপিত হয়নি। ২৫ বছর আগে যে লড়াই সংগ্রাম ফেলে আসা হয়েছে সরকার আবার সেই সংগ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য করছে। অধিকার আদায় করার জন্য আমাদের লড়াই করতে হবে। সরকার পাহাড়িদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করছে যা চুক্তি বিরোধিতার সামিল।
অ্যাডভোকেট নিতাই প্রসাদ ঘোষ বলেন, পাহাড়ের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে বাংলাদেশের বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে।
পাহাড়ী ভট্টাচার্য বলেন, পাহাড়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান সমস্যা সমাধান হবে এমন আশা নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু ২৫ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পাহাড়ে সমস্যার সমাধান হয়নি। শাসকগোষ্ঠী পাহাড়িদের উপর দমন-পীড়নের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে ভয়ভীতির সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।
অ্যাডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। বাংলাদেশে আদিবাসী সহ সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পাহাড়িরা দীর্ঘকাল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এখনো চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি।
রুমেন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা ভূমি সমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির ২২,০০০ আবেদন জমা পড়লেও একটিরও নিষ্পত্তি হয়নি। পাহাড়ে উন্নয়নের নামে প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের পায়তারা চালানো হয়।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে আমরা স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা করেছিলাম কিন্তু সেই শান্তি আজও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের যৌক্তিক আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য শাসকগোষ্ঠী চুক্তি বিরোধী শক্তি সৃষ্টি করেছে। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় যার যার অবস্থান থেকে সংগ্রাম জোরদার করতে হবে।
এর আগে অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী পর্ব চট্টগ্রামের নন্দনকানন বৌদ্ধ মন্দির চত্বরে অনুষ্ঠিত হয়। এসময় উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক প্রফেসর ড. রনজিত কুমার দে। তিনি বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
এসময় তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছরে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পাহাড়ে উন্নয়নের ফলে ভূমি উচ্ছেদ করা হচ্ছে, বন-প্রকৃতি উজাড় হচ্ছে। নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেম নির্ধারণ করে চুক্তি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে।
উদ্বোধনী পর্ব শেষে একটি র্যালি নন্দনকানন থেকে প্রধান প্রধান সড়ক হয়ে প্রেসক্লাব ঘুরে জেএম সেন হলে শেষ হয়। এরপরে জেএম সেন হল প্রাঙ্গণে গণসংগীত ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় গণসংগীত পরিবেশনা করেন রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীবৃন্দ।