পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ এর উদ্যেগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোগাং গণহত্যা দিবস পালিত
সতেজ চাকমা: পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে লোগাং গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও সংক্ষিপ্ত আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে ।
শুরুতেই ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল সেনা-সেটলার কর্তৃক সংঘটিত লোগাং গণহত্যায় শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয় । পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি লিপেন চাকমার সভাপতিত্বে পিসিপি ঢাবি শাখার তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সতেজ চাকমার সঞ্চালনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের বুদ্ধ মূর্তির সামনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভা ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় অংশ নেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অর্থ সম্পাদক ধুদুক দেওয়ান । এছাড়া আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া জুম্ম শিক্ষার্থীদের টিএসসি ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম লিটারেচার এন্ড কালচারাল সোসাইটির সভাপতি কিংশুক চাকমা প্রমুখ ।
ধুদুক দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগনের যে সংস্কৃতি ও জীবনধারা রয়েছে তার উপর আঘাত করার জন্য শাসকগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । তার নগ্ন বহি:প্রকাশ দেখতে পেয়েছি ১৯৯২ সালে পাহাড়ের আদিবাসী জুম্মদের সামাজিক উৎসব বিজু,বৈসু,সাংগ্রাই, বিহু, চাংক্রান এর ঠিক কয়েকদিন পূর্বে ১০ এপ্রিল লোগাং এ সেনা-সেটলার কর্তৃক সংগঠিত গণহত্যায় ।
পিসিপি ঢাবি শাখাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জুম লিটারেচার এন্ড কালচারাল সোসাইটির সভাপতি কিংশুক চাকমা বলেন, পাহাড়ে সংঘটিত ১৩টির অধিক গণহত্যা সম্পর্কে বর্তমান তরুণ জুম্ম প্রজন্মকে জানানোর জন্য এ উদ্যোগগুলোর বিকল্প নেই । পাহাড়ে আদৌ সেনা-সেটলার কর্তৃত ধর্ষন,নির্যাতন,নিপীড়ন চলমান রয়েছে । এগুলোর বিরুদ্ধে জুম্ম ছাত্র সমাজকে সংগঠিত হওয়ার বিকল্প নেই ।
সভাপতির বক্তব্যে পিসিপি ঢাবি শাখার সিনিয়র সহ-সভিপতি লিপেন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান লড়াই সংগ্রামে পাহাড়ের তরুণদের আরো সংগঠিত করতে লোগাং গণহত্যার বিভিষীকা থেকে শিক্ষা নিতে হবে ।শাসকেরা যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লোগাং গণহত্যা চালিয়েছিল সে দৃষ্টিভঙ্গি আদৌ পাল্টাতে পারেনি ।
তিনি লোগাং গণহত্যায় শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং এ গণহত্যার সাথে জড়িতদের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আইনের আওতাই নিয়ে আসার দাবী জানিয়ে তার বক্তব্যের মাধ্যমে এ আয়োজনের সমাপ্তি ঘোষনা করেন ।
১৯৯২ সালের এই দিন সেনা-বিজিবি (তৎকালীন বিডিআর), আনসার-ভিডিপি’র সহযোগিতায় সেটলার বাঙালিরা খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার লোগাঙ গুচ্ছগ্রামে এই বর্বর গণহত্যা চালায়।তৎকালীন শান্তিবাহিনী কর্তৃক এক বাঙালি রাখাল বালককে হত্যার মিথ্যা অভিযোগে তারা এ লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। সেটলাররা দা, বটি, কুড়াল দিয়ে পাহাড়িদের উপর আক্রমণ করে এবং সেনাবাহিনী ও বিডিআর(বিজিবি) নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে প্রায় ১১০০ এর অধিক পাহাড়ি শহীদ হয়। অনেকে নিঁখোজ হয়ে যায়। সেদিন শিশু, বৃদ্ধ, নারী কেউই রেহাই পায়নি। অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয় ৭ শতাধিক ঘরবাড়ি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব বিজু,বৈসু,সাংগ্রাই, বিহু, চাংক্রান উৎসবের ৩দিন আগে সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পাহাড়িরা । বিজু,বৈসু,সাংগ্রাই, বিহু, চাংক্রান বর্জন করা হয়
এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের ফলে বিজু,বৈসু,সাংগ্রাই, বিহু, চাংক্রান এর আনন্দ উৎসব শোক সাগরে পরিণত হয়। ১৩ এপ্রিল’৯২ উৎসবের মূল দিন (মূল বিঝু) খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে হাজার হাজার লোকের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।সেসময় ঢাকা থেকে আগত রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, আইনজীবী,মানবাধিকার কর্মী, লেখক-সাংবাদিকরাও আনন্দ উৎসবের পরিবর্তে আপামর জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সামিল হয়। খাগড়াছড়িতে হাজার হাজার মানুষ সেদিন রাজপথে নেমে এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানান। স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিজু,বৈসু,সাংগ্রাই, বিহু, চাংক্রান উৎসব বর্জন করা হয়। নিহতদের সম্মান জানাতে রান্না করা পাজন (মূল উৎসবের দিন হরেক রকমের সবজি দিয়ে তৈরি খাদ্য বিশেষ) চেঙ্গী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।