নড়াইলে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুন্ঠনের প্রতিবাদে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের মানববন্ধন
আজ ১৮ জুলাই বিকাল সাড়ে ৪টায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের উদ্যোগে গত ১৬ জুলাই সন্ধ্যায় নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানার দিঘলিয়া গ্রামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথিত পোস্টে ধর্ম অবমাননার অজুহাতে বাড়িঘর, দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
সংগঠনের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য এড. এস.এম.এ সবুর, জয়ন্তী রায়, ডা: অসিত বরণ রায়, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অলোক দাস গুপ্ত, ঢাকা মহানগর নেতা বেলায়েত হোসেন, শামসুল আলম জুলফিকার, জুবায়ের আলম, জাতীয় শ্রমিক জোটের কার্যকরী সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ, ঐক্য ন্যাপ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশীদ ভূইয়া, বাংলাদেশ জাসদ নেত্রী তানিমা সিদ্দিকী, গৌরব ৭১ এর সাধারণ সম্পাদক এফ.এম শাহীন, মুক্তিযুদ্ধ সংহতি পরিষদের নেতা এম.এ রব, আদিবাসী নেতা অনন্ত বিকাশ ধামাই প্রমুখ।
মানববন্ধনে ঘোষণা পাঠ করেন সংগঠনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এড. পারভেজ হাসেম।
সভায় অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খার স্বদেশ পরাহত করতে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি সবসময়ই সক্রিয় রয়েছে। এই অপশক্তিসমূহ সুযোগ পেলেই ছোবল মারতে উদ্যত্ত হয়। এরা সংবিধান বোঝে না, আইনের শাসন মানে না, এই অপশক্তি দেশের রাজনৈতিক দলসমূহের ভেতরে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে বসে আছে। এদের নির্দিষ্ট কোন দল নেই। বিগত কয়েক বছরের সাম্প্রদায়িক হামলার তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এই অপশক্তিসমূহ বর্ণচোরা। এরা সুযোগ সন্ধানী। এদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক চেতনার সকল বিবেকবান রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক শক্তির রুখে দাঁড়াতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ধর্মের নামে যারা মানুষের উপর অত্যাচার-জুলুম-নিপীড়ন চালায় তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নড়াইলের ঘটনায় জড়িত সকল অপশক্তিকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।
এস.এম.এ সবুর বলেন, সাম্প্রদায়িকতার বিশ দাঁত ভেঙে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূলধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ফেসবুকে যদি ধর্ম অবমাননার ঘটনা ঘটে তার জন্য প্রচলিত আইন রয়েছে। যারা ধর্মের নামে মানুষের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ ভাংচুর করে এরা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছে। এরা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের শত্রু এদের বিচার দ্রুততম সময়ে করতে হবে।
সালেহ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন যারা চায়না তারাই সময় সময় দেশের হাজার বছরের সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। ২০০১ সাল থেকে অদ্যাবধি এরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উস্কানী দিয়ে মানুষের বাড়িঘর-বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়ন, নির্যাতন, লুন্ঠন-অত্যাচারে মেতে উঠেছে। আমরা বিগত সময়ে ঘটে যাওয়ায় সকল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিচার দাবি করছি। নড়াইলের ঘটনার সাথে জড়িত সকল অপরাধীদের গ্রেফতার দাবি করছি।
সনাতন ধর্মালম্বীদের উপর ধারাবাহিক হামলা, লুন্ঠন ও নির্যাতনের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবীতে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সমাবেশের ঘোষণা
১৬ জুলাই, ২০২২, শতাধিক দুর্বৃত্ত নড়াইলের লোহাগড়া থানার দিঘলিয়া গ্রামে সনাতন ধর্মের অনুসারী হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, দোকান, বাড়ি ও সাধারণ মানুষের উপর হামলা করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘুদের হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন, ধর্মীয় উপাসনালয়ে অগ্নিসংযোগ, বাড়ীঘরে হামলা-লুন্ঠন বাংলাদেশে একটি প্রবণতা হয়ে দাড়িয়েছে। কক্সবাজারের রামু, যশোরের মালোপাড়া, ঠাকুরগাঁও এর গড়েয়া, ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগর, গাইবান্ধার সাঁওতালপল্লী, রংপুরের ঠাকুরপাড়া, ভোলার বোরহানউদ্দিন, কুমিল্লার মুরাদনগর, সুনামগঞ্জের শাল্লা, নড়াইলের লোহাগড়া সর্বত্র একই প্রবণতা, সহিংসতা ও ঘটনা দৃশ্যমান। এর আগেও সংখ্যালঘুদের উপর সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় অনেক মামলা হয়েছে, কিন্তু কোন মামলা নিস্পত্তি হয়েছে কিংবা অপরাধীদের শাস্তি হয়েছে এমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
স্বাধীন বাংলাদেশ সংঘ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ দেশ গড়তে পারেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সালেই সাম্প্রদায়িক সংহিসতার ঘটনা ঘটে। এরপর ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন ও নির্যাতন চলছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সব ধর্মালম্বীর সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাস করার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ত্রæমশ কমছে। ১৯৭৫ সালে প্রথম আদমশুমারীতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ছিল ১৩.৫ শতাংশ, ২০১১ সালের আদমশুমারীতে তা দাঁড়িয়েছে মোট জনসংখ্যার ৮.৫ শতাংশ।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন মনে করে সংখ্যালঘু জনগণের উপর সহিংসতার ঘটনা গুলোর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হওয়ায় এধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে, যা তাদেরকে ভীতি, নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চিয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বিশ্বাস কিংবা ধর্মপালনের স্বাধীনতা একটি অধিকার। সকল নাগরিকের বিশ্বাস, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতা সংবিধান পরিপন্থি। সর্বোপরি স্বাধীনতার পর থেকেই রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
আজকের এই প্রতিবাদী মানববন্ধনে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের দাবিসমূহ:
১. সনাতন ধর্মালম্বীদের হত্যা-নির্যাতন, প্রতিমা-মন্দির ভাঙ্গচুর, বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুন্ঠন একটি ধারাবাহিক পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এই সকল ষড়যন্ত্রের মূল রহস্য উৎঘাটনে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
২. সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতার সকল মামলা দ্রুত বিচার আইনে এবং সর্বোচ্চ ৬ মাসের মধ্যে নিস্পত্তি করতে হবে।
৩. সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় আক্রান্ত সকলকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৪. রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।
৫. জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে।