জাতীয়

সুরক্ষাসহ বিশেষ সরকারী প্রণোদনা দিতে হবেঃ আদিবাসী ফোরামের সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা

আসন্ন আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের আদিবাসীদের সুরক্ষাসহ সরকারী প্রণোদনার দাবী জানিয়েছেন বক্তারা। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের আয়োজনে আজ (৬ আগষ্ট-২০২০) বৃহষ্পতিবার অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। উক্ত অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি অজয় এ মৃ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনে মিডিয়া পার্টনার ছিল আইপি নিউজ এবং এটি ফেসবুক লাইভেও কাভার করা হয়।

ঐক্য ন্যাপ সভাপতি ও প্রবীন রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য আদিবাসীদের সকল দাবির সাথে সংহতি প্রকাশ করে এ করোনাকালীন সময়ে আদিবাসীদের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতাভুক্ত করার দাবী জানান।তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৩ বছরের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে এবং সমতলের আদিবাসীরাও পৃথক ভূমি কমিশন দাবীতে সংগ্রাম করছে। নাগরিক সমাজ সবসময় আদিবাসীদের সাথে রয়েছে বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।
আদিবাসীদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ঐতিহ্য তুলে ধরে এ বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আরো বলেন, এদেশ বহুজাতির দেশ। সাওতাল বিদ্রোহ, উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ এদেশে যত সংগ্রাম হয়েছে আদিবাসীরা বাঙালীদের সাথে পাশে থেকে লড়াই করেছে। আদিবাসীদের সমতাভিক্তিক অধিকার দিতে পারলে তখনি বাঙালী গর্বিত হতে পারে বলেও মত দেন তিনি।রাষ্ট্র কর্তৃক আদিবাসী দিবস পালনে রাষ্ট্রের সম্মাান বাড়বে বৈ কমবে না বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।তিনি আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘনের চির অবসান দাবী করেন।
উক্ত সংবাদ সম্মেলনে বিশিষ্ট আদিবাসী গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়ার ফলে আদিবাসীদের প্রোডাক্টগুলো অবিক্রিত অবস্থায় রয়ে যাচ্ছে যার ফলে আদিবাসীরা বেকায়দায় পড়েছে। আদিবাসীদের জীবন খুবই সংকটনাপন্ন বলেও উদ্বেগ জানান তিনি।
বিশিষ্ট এ ইতিহাসবিদ আরো জানান,গারো গৃহকর্মী ও বিউটিশিয়ানদের কর্ম সংকুচিত হওয়ায় তাদেরকে গ্রামে ফিরে যেতে হয়েছ্।ে কিন্তু গ্রামে তাদের কর্মসংস্থান নেই বলে করোনাকালীন দুঃসময়ে আদিবাসীদের অবশ্যই প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে বলে সরকারের কাঝে জোর দাবী জানান তিনি।
এয়াড়া পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী অধিকারকর্মীদের অপরাধীকরণ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, তাদেরকে নিপীড়ন-নির্যাতন, জেল-জুলুম ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে যাতে তারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে না পারে। অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করা এবং অপরাধীকরণ থামানোর জন্য সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণও করেন এ আদিবাসী গবেষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস সুইডিশ তরুণী গ্রেথা থুনবার্গের কথা তুলে ধরে তথাকথিত নরমালে ফিরে না গিয়ে প্রাণ-প্রকৃতি তথা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করার আবশ্যকতা তুলে ধরে বলেন, আমরা আগের নরমালে ফিরে যেতে চাইনা যেখানে মধুপুরের চলেশ রিছিলকে জীবন দিতে হয় কিংবা গাইবান্ধায় আদিবাসীদের ঘর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। প্রাণ প্রকৃতির আধিপত্য যায়গা থেকে বেড়িয়ে এসে মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক, ভাষা নিরপেক্ষ, জাতি নিরপেক্ষ, অসম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে আদিবাসী বাঙালী সবার সমান অধিকার নিশ্চিতের আহ্বান জানান তিনি।

উক্ত সংবাদ সম্মেলনের মূল বক্তব্যে সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসী জনগণ দরিদ্রদের মধ্যেও প্রান্তিক। তারা ঐতিহাসিকভাবে শোষণ, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। এখন করোনার কারণে আদিবাসীদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়েছে। আদিবাসী সংগঠনসমূহের সাম্প্রডুশ গবেষণা বলছে, এরই মধ্যে আমাদের দেশে সমতলের আদিবাসীরা শতকরা ৭০ভাগ দারিদ্রসীমার নীচে চলে গেছে। অনেক আদিবাসী চাকুরি হারিয়ে শহরের আদিবাসী গার্মেন্টস কর্মী, হোটেল কর্মী, বিউটি পার্লারের নারী কর্মী, গাড়ি চালক, গৃহকর্মী, সিকিরিটি গার্ড ও অন্যান্য ইনফরমাল সেক্টরের আদিবাসীরা অনেকেই গ্রামে ফিরে গেছেন বলেও উদ্বেগ জানান তিনি।এই ধরনের চাকুরি হারানো আদিবাসী মানুষের সংখ্যা অন্তত কয়েকহাজার হবে বলেও হতাশা ব্যক্ত করেন এ আদিবাসী নেতা।

তিনি আরো বলেন, সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আদিবাসী ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ক্রমাগতভাবে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এক সময় যেসব অঞ্চলে আদিবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, সেখানে ‘পপুলেশন ট্রান্সফারের’ ফলে আদিবাসী জনগণ নিজভূমিতে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

আদিবাসীদের সাম্প্রতিক মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, এই করোনাকালেও আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নয় । দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার হীন উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হুমকি, আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, আদিবাসী নারী ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ নৃশংস সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে উল্লেক করে তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২২ বছর অতিবাহিত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এখন থমকে আছে আর পাহাড়ের মানুষ সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যে দুর্বিষহ জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে।
এছাড়া চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনকর্মীদের দমানোর জন্য তাদের ঘরে ঘরে তল্লাশি, হয়রানি, অমানুষিক নিপীড়ণ-নির্যাতন, ধর-পাকড়, চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িতকরণ, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে অপরাধীকরণ, জেলে প্রেরণ ও এলাকাছাড়া করা হচ্ছে বলেও উদ্বেগ জানান তিনি। এছাড়াও সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য সরকার বার বার সমতলের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন করেনি। এই বিষয়ে ন্যূনতম পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো লক্ষণ নেই বলেও জানান তিনি।

আদিবাসীদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার,সাংবিধানিক স্বীকৃতির, পার্বত্য চুক্তির পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠন ও করোনাকালে আদিবাসীদের প্রণোদনা প্রদান, পাহাড়ের আদিবাসী অধিকার কর্মীদের উপর অব্যাহত দমন বন্ধ করা ও আদিবাসী দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনসহ ১৪ দফা দাবী নামা তুলে ধরেন আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক।
এছাড়া কোভিড এর কারণে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও সহযোগী বন্ধুদের কর্মসূচীও তুলে ধরেন তাঁর মূল বক্তব্যে। উক্ত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন ভিডিও লিংক:
https://www.facebook.com/ipnewsbd/videos/2678486099075750/?__tn__=%2Cd%2CP-R&eid=ARDWRhFCTReJFoaPDhr7JDPYfzu60ut3sPC3cHTSq9iR8rzdHV276LX5u8NSbVDv9x-pa_8adDhPMnC1

Back to top button