সাজেকের পথে পথে: যেখানে অনেকগুলো সম্ভাবনাময়ী স্বপ্নের অপমৃত্যু হয়

জিকো চাকমা, রাঙ্গামাটি থেকে পাকুজ্যা চুগ: এপ্রিলের ১০ তারিখ। চারদিকে বিজুর আমেজ ছড়িয়েছে তখন। খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পৌনে সাতটা বাজে ব্যাগ আর কাপড়-চোপড় গুছিয়ে রওনা দিলাম। প্রিয় রাংগামাটি শহরটা ছেড়ে গেলে কেন জানি খুব অসহায় মনে হয়। এবারও তাই হলো। মনে মনে বলতে লাগলাম, সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি সাজেক যাবো, তবে যাবোই। রিজার্ভ বাজারের পূর্ব দিকে অর্থাৎ নাপ্পি ঘাট থেকে ইন্জিন চালিত বোটে করে রওনা দিলাম। দুপুর বারোটা বেজে গেছে। তখন মাইনী বাজার। মাইনী বাজার অতিক্রম করার পর মাহিল্ল্যা পৌছতে না পৌছতেই কয়েক দফা রোদ-বৃষ্টি-রোদ-বৃষ্টি-রোদ এভাবে প্রকৃতি যেন খেলা করছিল। এভাবে কাচালং নদীর উজানে আমাদের বোটটা চলছিল। নদীর দুপাশেই বাঙালি বসতি। অথচ কয়েক দশক আগেই এ জায়গাগুলো জুম্মদের ছিল। জিয়াউর রহমানের আমলে এ জায়গাগুলো বহিরাগত সমতল থেকে আসা বাঙালিরা দখল করে নেয়। এরপর আর জায়গাগুলি ফেরত পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিগত নোট খাতাটা বাহির করে কিছু লেখার চেষ্টা করলাম। কাচালং নদীর উজানের ডান দিকে অর্থাৎ পূর্ব -উত্তর দিকে নীল নীল পাহাড়ের সারিগুলি দেখা যাচ্ছিল এবং সেগুলো ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছিল। আমাদের গন্তব্য সেই নীল পাহাড়ের সারিগুলোর ওপাশের এলাকায়। হুট করে ডায়েরিতে লিখে ফেললাম “কাচালং নদীর উজানের ডান দিকে অর্থাৎ পূর্ব -উত্তর দিকে মাথা উচু করে দাড়িয়ে থাকা নীল সবুজে আচ্ছাদিত পাহাড়ের সারিগুলোর ওপাশে থাকা ভূমিপুত্রদের দেখতে যাচ্ছি। তাদের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছি। কেমন আছে তারা?”
মনের ভিতর অনেক কথা লুকোচুরি খেলছিল। কিন্তু প্রকাশ করতে গিয়েও পারছিলাম না।
সে যাহোক অবশেষে বিকাল সাড়ে তিনটা বাজে সিজোক খাগড়াছড়ি ঘাটে পৌছালাম। তারপর একটা সিএনজি নিয়ে বাঘেইছুড়ি গ্রামের দিকে রওনা দিলাম। আধা ঘন্টা নাগাদ চলার পর তলে বাঘেইছুড়ি গ্রামে পৌছালাম। সেখান থেকে মোটরসাইকেল যোগে এক ঘন্টার পর দজর বাজারে পৌছলাম।
তখন সন্ধা নেমেছে। এরপর থেকে আবার হাটা শুরু। দীর্ঘ ঢেড় ঘন্টা হাটার পর পদাছড়া লুম নামক স্থানে পৌছালাম। পথে ছোট্ট একটা স্কুলঘর চোখে পড়লো। শণের ছাউনি আর বাঁশের বেড়া দেওয়া ঘরটার ভিতরে হাতে থাকা টর্চ লাইটটা জ্বেলে ভিতরটা এক চোখের পলকে দেখলাম। দেখলাম গাছের তক্তা দিয়ে বানানো চারটা বেঞ্চ আর একটা চেয়ার এবং ছোট্ট একটা টেবিল। বুঝলাম, এখানে খুব ছোট্ট বাচ্ছারা পড়ালেখা করে। এরপর সেখানে আমার এক পিসিতো বোনের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। গন্তব্যে পৌছাতে আরো অনেক পথ বাকি।
১১ এপ্রিল খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাজেক লংকর নতুন পাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমরা সংখ্যায় বেশ কয়েকজন ছিলাম। তাদের বাড়ি লংকর নতুন পাড়ায়। রাংগামাটি সদরের রাঙাপান্ন্যে এলাকার মোনঘর স্কুলে পড়ে তারা। সবাই খোশগল্প করে এ পাহাড় থেকে ও পাহাড় পাড়ি দিচ্ছিলাম। এরপর সদ্য পোড়ানো একটা জুমে গিয়ে পৌছালাম। মনে পড়ে গেল আজ থেকে প্রায় উনিশ বছর আগে ঠিক এ জায়গায় আমার বাবা আর দাদু মিলে বড় একটা জুম কেটেছিল। সেবছর প্রায় ২০০ আড়ি (১২ কেজি ধান = ১ আড়ি ধান) ধান পেয়েছিলাম আমরা। তখন এ পাহাড় খুব উর্বর ছিলো। ধান, সুতা, গোচ্ছে, মরিচ, মাম্মারা, সিন্দিরেসহ জুমের অনেক ফসলের ফলন সেবছর অনেক হয়েছিল। এ জুমকে ঘিরে ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। দেখলাম আমাদের ছোটবেলার সেই জুমঘরের সামনে থাকা ছোট্ট গামারি গাছটা অনেক বড় হয়েছে। জুমের দক্ষিন দিকে একটা ঝিরি ছিলো। সে ঝিরিতে বাবা একটা তাগলক (তাগলক= ঝিরিতে বাঁশ দিয়ে তৈরী কৃত্রিম ঝর্ণা) তৈরী করে দিয়েছিল। সে কৃত্রিম ঝর্নায় দুপুরে কত যে গোসল করেছি, দাদুর সাথে জুমের দক্ষিন-পশ্চিম দিকে থাকা পাহাড়ি ছড়াগুলোতে চিংড়ি, মাছ আর কাকড়া ধরতে যাওয়া, জুমে পাকা সিন্দিরের গন্ধ নাক দিয়ে খুঁজে পাকা সিন্দিরেগুলো হন্য হয়ে খুজে বের করে আনা, দজর বাজারের হাটের দিন বিস্কুটের প্যাকেট গুলো দখল নেয়ার জন্য বাবার অপেক্ষায় থাকা, পাকা সিন্দিরের বাকল দিয়ে সিম পুকদের (সিমপুক=এক ধরনের শিংওয়ালা পোকা, যেগুলো খেতে অনেক সুস্বাদু) ধরার জন্য ফাঁদ পাঁতা ছিলো আমার অন্যতম কাজ। যেবছর আমরা সে পাহাড়ে জুম চাষ করেছিলাম সেসময় আমি বাল্যশিক্ষা পড়তাম। বাবা পড়াতো। প্রতিদিন সন্ধায় বাবা পড়া নিতো। চেরাগ জ্বালিয়ে অনেকটা বড় বড় আওয়াজ করে সুর করে পড়াগুলো পড়তাম। আর পড়া না পারলে মাঝে মাঝে পিঠে দুয়েকটা বেত পড়তো।
এসব দৃশ্যগুলো যেন চোখে ভাঁসছিল। আবেগ ধরে রাখতে পারছিলাম না ছোট্টবেলায় কাটানো এ জুমভূমির রুপ দেখে। এরপর সে পাহাড়টা ডিঙালাম এবং খানিকটা সামনে দাড়িয়ে দেখলাম বিশাল এক পাহাড়। নাম তার পাগোজ্জে চুগ। ঠিক কি কারনে এ পাহাড়টার নাম পাগোজ্জে চুগ সেটা আমার আদৌ অজানা। এ পাহাড়ের ঠিক চূড়ার একটু নিচে একটা পানির কুয়ো রয়েছে। খুব ঠান্ডা পানিটা। সেখান থেকে পানি খেয়ে রওনা দিলাম। তখন সকাল সাড়ে আটটা বোধহয়। পথিমধ্যে দেখা পেলাম ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর দুই জন মহিলা আর একজন পুরুষ হলুদের বস্তা মাথায় নিয়ে পাহাড় উঠছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সবার শার্ট ভিজে গিয়েছিল ঘামে। হলুদের বস্তাগুলোর প্রতিটার ওজন কম করে হলেও ৪৫/৫০ কেজি হবে।
যেখানে আমরা খালি গায়ে এ পাহাড় থেকে ও পাহাড় ডিঙাতে হিমছিম খাচ্ছিলাম, ঘামে সাড়া শরীর ভিজে যাচ্ছিল, পাগুলো ব্যাথায় ছটপট করছিল, ঠিক সেসময় তারা ৪৫/৫০ কেজি হলুদের বস্তা মাথায় নিয়ে কোনোরকম হা-হুতাশ ছাড়াই এ পাহাড় থেকে ও পাহাড় ডিঙাচ্ছিল। এভাবে হলুদের বস্তা মাথায় করে আনা অনেক জনের সাথে দেখা হলো।
আমি অবাক এবং বিস্মিত হয়ে যাচ্ছিলাম এখানকার মানুষদের ধৈর্য্য এবং কষ্টসহিঞ্চুতা দেখে। যখন পাহাড় ডিঙাচ্ছিলাম, তখন সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছিল। কপাল বেয়ে ঝরঝর করে ঘাম ঝরছিল, পরানটা ছটপট করছিল, বুকের ভিতর যখন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল আর যখন এখানকার মানুষদের এ প্রতিকুল পরিবেশে প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করার দৃশ্য যতই দেখছিলাম এবং ভাবছিলাম, ততই তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ-সম্মানবোধ এবং ভালোবাসা ততই বেড়ে যাচ্ছিল।
আমরা দুইভাই অতুল দা আর আমি বলাবলি করছিলাম একজন শহুরে থাকা মানুষ যখন এখানে প্রথম আসবে হয়তো অনেকটা অবাক আর তাচ্ছিল্যর সুরে বলবে, এখানকার মানুষজন কিভাবে থাকে!! নেই নেটওয়ার্ক, টু জি, থ্রি জির কথা নাহয় বাদ দিলাম… নেই হসপিটাল, নেই ভালো যাতায়াত ব্যাবস্থা… সবখানে নেই নেই। আমি আর আসবোনা এ পাহাড়ে, অনেক কষ্টরে… আরো কত কি! হয়তো কান্নাও জুড়ে দিবে। কিন্তু যারা সত্যিকার অর্থে জুম্ম, যারা জুম পাহাড়কে ভালোবাসে, যারা এ জুম পাহাড়ের দুঃখী মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে, তারা কখনো হতাশ হবে না। বরং তারা বলবে, আমাকে আবারো এ পাহাড়ে আসতে হবে। এ দুঃখী মানুষদের মননে রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের বীজ বুনে দিতে হবে। তারা যেন এ পাহাড়ে নিরাপদে, নিজেদের স্বকীয়তা নিয়ে মাথা উচু করে গর্বের সহিত বেচে থাকতে পারে। আরো অনেক কথা হলো।
পাকুজ্যা চুগ থেকে লংকর নতুন পাড়া গ্রাম:
যে পাকুজ্যা চুগের কথা বলেছিলাম, সে পাকুজ্যা চুগের চুড়ায় থাকা পানির কুয়োটি চৈত্র মাস এলেই শুকিয়ে যায়। এতে দূর দুরান্ত থেকে আসা যাওয়া করা মানুষদের পানি পেতে যথারীতি বেগ পেতে হয়। অনুসন্ধান করে জানতে পারি, এ পথ দিয়ে প্রায় ৩৫ টি গ্রামের মানুষ আসা যাওয়া করে। এদিকে দজর পদাছড়া লুম থেকে পাকুজ্যা চুগে আসতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘন্টা এবং বিপরীত দিক তথা লংকর পাংকোয়া পাড়া থেকে আসতে সময় লাগে দুই ঘন্টা। পথিমধ্য কোনো খাবার পানির সুব্যাবস্থা না থাকায় পাকুজ্যা চুগের ছোট্ট কুয়োটি পয়ত্রিশটির অধিক গ্রামের অধিবাসীদের আসা যাওয়ার পথে একমাত্র পানির তৃঞ্চা মেটানোর প্রানকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ ছোট্ট কুয়োটি সংস্কারের অভাবে দিন দিন ব্যাবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। সেখানকার অধিবাসীরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিষয়টি তথা কুয়োটি সংস্কারের আবেদন জানালেও বিষয়টি কেউ কর্ণপাত করেনি।
অবশেষে বড় দুইটি পাহাড় পেরোনোর পর লংকর বিজিবি ক্যাম্পে পৌছালাম। একটা বড় বটগাছ। বটগাছটা অনেক দূরে ঢাল পালা ছড়িয়েছে। চারদিক থেকে আসা অগনিত বাতাস এসে আমাদের হাটার দীর্ঘ ক্লান্তি দূর করে দিল। আমরা ক্যাম্পে পৌছার কিছুক্ষন পরেই কয়েকজন বিজিবি সদস্য লুঙ্গি-প্যান্ট পড়া অবস্থায় সেখানে উপস্থিত হল। একজন লম্বা বিজিবির জওয়ান এসে কোথা থেকে আসছি, কোথায় যাবো… ইত্যাদি প্রশ্নসহ কুশল বিনিময় করতে লাগলো। লোকটা জামালপুরের। আমিও কুশল বিনিময় করতে লাগলাম। একপর্যায়ে একজন বিজিবি সদস্যর প্রশ্নের উত্তরে বললাম “আমরা ভালো নেই ভাই… আমার জন্মভূমি ভালো নেই। কেন ভালো নেই এ প্রশ্নের উত্তরে বললাম “সরকার তথা আমাদের দেশের সেনাবাহিনী আমাদের ভালো রেখেছে কি?
পাল্টা প্রশ্ন শুনে উপস্থিত বিজিবি সদস্যরা অনেকটা থটমট খেয়ে গেল। বললাম, আজ আমাদের মাতৃভূমির ভিবিন্ন জায়গা দখল করে পর্যটন কেন্দ্র বানাচ্ছেন, দিঘীনালায় স্কুল ঘর এবং ২১ টি পরিবারকে উচ্ছেদ করে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন করছেন, বান্দরবানে ম্রো আদিবাসীদের জায়গা দখল করে, তাদের চিরায়িত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে, পর্যটন কেন্দ্র বানাচ্ছেন, বরকল উপজেলা সদরের জোনে দূর-দূরান্ত থেকে আসা বোট থামিয়ে তল্লাসি তথা নিরাপত্তার নামে হয়রানি অব্যাহত রেখেছেন…অনেকগুলো অভিযোগের তীর ছুড়ে দিলাম। রুলোই পর্যটনটার ব্যাপারে আপনার কি অভিমত জানতে চাইলে উনি বললেন, ভালোই তো হয়েছে.. সমতল থেকে লোকজন এসে পাহাড় দেখছে। পিচ পথ হয়েছে..ইত্যাদি আরো অনেক কিছু বলতে লাগলেন। আমি বললাম, আগে তো পর্যটনকেন্দ্রের জায়গায় ত্রিপুরা আর পাংকোয়া আদিবাসী লোকজনের ঘরবাড়ি ছিল। তারা এখন কোথায়? তারা কিভাবে আছে.. কেমন আছে… এসব খবর সেনাবাহিনী রেখেছে কি?
আমি আবারও বলতে লাগমাম, আমরা তো সরকারের কাছে বেশি কিছু চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার করতে, যেখানে আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবো। বিজয় দিবসের প্রভাতে নানিয়ারচর পুড়ে ছাই হয়ে যাবে না, সেটেলাররা দলে দলে খাগড়াছড়ি, রাংগামটি, বান্দরবানে পাহাড়ের বন-ভূমি দখল করে নেবে না, বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক-বিহু উৎসবে তথা যেকোনো সময় লোগাংয়ে সংগঠিত গণহত্যার মতো কোনো গণহত্যা আর হবেনা, জুম ক্ষেতের মাচাং ঘর থেকে কোনো জুম্মবীকে আর অপমানিত হতে হবে না, লংগদুতে সেটেলারদের দেওয়া আগুনে কোনো পাহাড়ির ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যাবে না…..ইত্যাদি।
উনি প্রতিটা প্রশ্নে যেন ধরা খাচ্ছিলেন। উনার ভ্যাবাচ্যাকা মুখটা দেখে আমরা দুই ভাই চোখাচোখি করে মুচকি হাসলাম। অতুল দার মুখখানার ভাবটা দেখে বুঝতে পারছিলাম, ও যেন বলতে চাইছে, থাক ভাই! আর বলিস না। একপর্যায়ে দেখলাম, একজন পাংকোয়া জনগোষ্ঠীর মহিলা বিজিবি ক্যাম্পে লাকড়ি সরবরাহ করছেন। জানতে পারলাম, ওই মহিলা মাসিক ৬০০০ টাকায় কাজটা নিয়েছিলেন। সবশেষে অনেকক্ষন কথা বলে সে স্থানটা পরিত্যাগ করলাম।
এরপর ৫ মিনিট হাটার পর পাংকোয়া পাড়ায় পৌছলাম। আগের মতো আর কোলাহল নেই। অথচ ৬ বছর আগেও এ পাংকোয়া পাড়ায় সারাক্ষন লোকজনের কোলাহলে পূর্ণ থাকত। বাড়ি ঘর থেকে গান বাজনার আওয়াজ ভেসে আসত। জানতে পারলাম, এ পাড়ায় লোকজন কমে গেছে। কেউ জুমে গেছে মাচাং ঘর করবে বলে, কেউ আবার এদেশে নেই। বাঁচার তাগিদে অনেকেই মিজোরামে পাড়ি জমিয়েছে। আশেপাশে চাষযোগ্য জুমভূমি না থাকায় এরা এ পাড়া থেকে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। বাড়ির পাশের সমাধিগুলোর চারপাশ খড়-খুটোয় ভরে গেছে। এগুলোর অবহেলায় অযত্নে পড়ে আছে। অনেকগুলো বাড়ির আশপাশ দেখে বুঝলাম, এ বাড়িগুলোতে অনেক দিন হলো লোকের পা পড়েনি। বাড়ির চালগুলো আগাছা আর বুনো লতাগুলো দখলে নিয়েছে।
এরপর আরেকটা পাহাড় বেয়ে উঠলাম এবং নিচে নেমে সোজা ছড়ায় পৌছলাম। একি! এখানে তো কোনো ছড়া নেই। কিন্তু কয়েকবছর আগেও এখানে ছড়া ছিল। ছড়ায় পানিতে ছলছল করতো। ছোট ছোট মাছ, চিংড়ি আর কাকড়ায় এ ছোট্ট ছড়াটা ভর্তি ছিল। ছোট্ট একটা ঠান্ডা পানির ঝর্ণাও ছিল, যে ঝর্ণা পথে আসা যাওয়া করা লোকদের পানির পিপাসা মেটাতো। চারপাশে এখন শুধুই হাহাকার। নির্জীব পাথর গুলোর ওপর হাঁটতে গিয়ে পাথরগুলো নড়েচড়ে উঠল আর শব্দ করতে লাগলো। পাথরগুলোর এমন শব্দ শুনে মনটা বেশ খারাপ হতে লাগল। গত বছরের ১২/১৩ জুন পাহাড় ধসে ছড়ার বুকগুলো বালি আর কাদায় ভরে গেছে। পানি চলাচলে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় ছড়াগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। আর এমনিতেই এখন বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে। হরেক রকমের পাখির ডাক, তাদের চেঁচিয়ে উঠবার শব্দ উচ্চারিত হতে লাগল পাহাড়ের এপাশ-ওপাশ । কিছুক্ষণ পরেই দেখা মিলল বড় একটা পাহাড়ি ছড়ার। ছড়ার নাম লংকর।
প্রায় একনাগাড়ে ঢেড় ঘণ্টা ছড়া বেয়ে হাটার পর পৌঁছে গেলাম লংকর নতুন পাড়া গ্রামে।
বিজিবি কার্যক্রমের কারণে পরিবেশগত প্রভাব:
লংকর নতুন পাড়া পৌঁছেই একটু বিশ্রাম নেওয়ার পর দুপুরের খাবার খেতে বসলাম। ভাত খাওয়ার সময় প্রতিময় দার সঙ্গে এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল এবং জিজ্ঞাসা করলাম আগের মতো ছড়ায় চিংড়ি, মাছ আর ব্যাঙেচি পাওয়া যায় কিনা? অনেক দিন ধরে ছড়ার চিংড়ি, মাছ আর ব্যাঙেচি খাওয়া হয় না।
উনি যা বললেন তা শুনে আমার খুব খারাপ লাগছিল এবং রেগে গেলাম। ওনাদের ভাষ্যমতে, গত বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুই কি তিনদিন পরের তারিখে লংকর বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা বিএসএফের সাথে পতাকা বৈঠকে যোগদানের জন্য ভূইয়োছড়া গ্রামে এসে হাজির হয়। তখন বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা সাথে করে কয়েক কেজি চিংড়ি মাছ নিয়ে যায় এবং ওগুলো নিজেরাই শিকার করেছেন বলে স্থানীয় মুরুব্বিদের জানায়।
অথচ, মুরুব্বিদের ভাষ্য অনুযায়ী সেদিন বিজিবি সদস্যরা বিএসএফের সদস্যদের সাথে পতাকা বৈঠকে যোগদানের জন্য ভুয়োছড়া এলাকায় আসে। আসার পথে লংকর ছড়ায় বিষ দিয়ে চিংড়ি মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। সেদিনের বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যদের দেওয়া বিষে লংকর ছড়ায় বিষক্রিয়ায় প্রায় ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় নির্বিচারে মৃত চিংড়ি, মাছ পুরো ছড়াতে ভেসে ওঠে। এমনকি শামুকগুলো পর্যন্ত নির্বিচারে মারা যায়। বিজিবির সদস্যরা ছড়ার যে জায়গা বিষ দিয়েছিল, সে ছড়ার নিচের দিকে তিনটি আদিবাসীদের গ্রাম রয়েছে। এ তিনটি গ্রাম হচ্ছে নতুন পাড়া, লাম্বাছড়া এবং তারাবন্যা। বিজিবির সদস্যরা লংকর ছড়ায় বিষ প্রয়োগের তিন দিন পর্যন্ত সেখানকার পানি ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে গ্রামবাসীরা বিজিবির সদস্যদের নিকট বিষয়টি জানালে এবং প্রতিবাদ করলে বিজিবির সদস্যরা বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যায় এবং অস্বীকার করে। তথাপি তারা উক্ত বিষ প্রয়োগের ঘটনায় উল্টো অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়। পরবর্তিতে লংকর নতুন পাড়া গ্রামের কার্বারী প্রতিময় চাকমা তীব্র প্রতিবাদ করলে বিষয়টি লংকর… নং ব্যাটালিয়নের সুবেদার বিষয়টি স্বীকার করে নেয়। উক্ত ঘটনার মত ঘটনা আর হবেনা বলে প্রতিশ্রুতি দেয়।
এরপর বিকালে গ্রামটি ঘুরে দেখার জন্য বাহির হলাম। দীর্ঘ ৬ বছর পর আবার এখানে আসা। লংকর ছড়ার এপার ওপার করেই বসতঘর স্থাপন করেছে এ গ্রামের অধিবাসীরা। গ্রামের সব ঘরই মাচাং ঘর। এগ্রামটি ১৯৯৩ সালে স্থাপিত হয়। প্রথম দিকে এ গ্রামে প্রায় ৪০ থেকে ৬০টির অধিক পরিবার ছিল বলে জানা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরেই গ্রামের মানুষগুলো শিজোক মন্দিরাছড়া, ওলোদহদা আদাম এবং পদাছড়া লুম সহ ভিবিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। বর্তমানে এ গ্রামে মোট ১৮ কি ২০ পরিবার রয়েছে। গ্রামের সবাই জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। মৌলিক চাহিদা গুলো মেটাতে গিয়ে তাদের চলে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম। গ্রামের প্রত্যেকটি ঘরে ঘরে আমরা ঘুরে ঘুরে কুশল বিনিময় করলাম।
দেখলাম এ গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি সুন্দর খেলার মাঠ রয়েছে। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৩ সালে। তিনটি কক্ষ বিশিষ্ট বিদ্যালয়টিতে বেঞ্চ নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীদের মাদুরের উপর বসিয়েই পাঠদান করা হয়।
রাত পেরিয়ে সকাল হলেই ফুল বিজু।
অন্য রকম বিজুর দিন:
১২ এবং ১৩ এপ্রিল। ১২ তারিখ ছিল ফুল বিজু। সেদিন খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠলাম বাচ্ছাদের কোলাহলের শব্দ শুনে। খুব ভোরে উঠে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্ছাদের কলাপাতায় ফুল তুলে ছড়ায় ফুল ভাসানোর দৃশ্যগুলো খুব উপভোগ করেছিলাম। ফুল ভাসানোর পরপরই গ্রামের স্কুল মাঠে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা উপস্থিত হল। আশে পাশের গ্রাম থেকেও মানুষ এল। প্রথমে বাচ্চাদের খেলাগুলো দিয়ে শুরু হল, বিজু খেলার উৎসব। ছোটদের বিস্কুট দৌড় প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই শুরু হলো। এরপর দৌড় প্রতিযোগিতা, স্মৃতি শক্তি পরীক্ষা, মার্বেল খেলা, নাদেং খেলা। এরপর শুরু হলো বাচ্ছাদের বলি খেলা। টান টান উত্তেজনা চোখেমুখে বিরাজ করছিল ছোট্ট বলিদের মধ্য। ফাইনালে হেরে গিয়ে ছোট্ট এক বলি তো কান্না জুড়ে দিল!
এরপর বড়দের খেলা শুরু হলো। প্রথমে ফোর খেলা উপভোগ করলাম আমরা। সে পরপরই পত্তি খেলা, চিকুদকুদ খেলা, পাক্কোন খেলা, ঘিলে খেলা, বালিস বদল সহ বিকালে ঢেবাছড়ি বনাম লংকর নতুন পাড়ার যুবকদের মধ্য ফুটবল এবং ভলিবল খেলা অনুষ্ঠিত হলো। দুটো খেলায় লংকর নতুন পাড়া বিজয়ী হয়। এভাবেই সেদিনটা বেশ আনন্দের মধ্য দিয়েই চলে গেল। সেদিন সবার চোখে মুখে যে আনন্দটা দেখেছি, তা কখনো ভুলবার নয়। কেউ বিশ্বাস করবেনা এ মানুষগুলো এক বেলা খাবারের জন্য কতটা কষ্ট সহ্য করে। তাদের জীবন কতটা কষ্টে পরিপূর্ণ। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসার খরচ যোগাতে কতটা সংগ্রাম করে তারা। রাত পেরোলেই মূল বিজু।
আমরা সচরাচর মুল বিজুর দিন বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয়-স্বজনদের বাড়িতে ঝাঁক বেঁধে গিয়ে বিজু উৎসব পালন করি। অনেক হৈ-হুল্লোড় করেই নিজ নিজ বন্ধু-বান্ধবদের সাথে নিয়ে কাটিয়ে দিই। কিন্তু এখানে এসে যা দেখলাম, ঠিক তার বিপরীত। মূল বিজুর ঠিক কয়েকদিন আগে ঢেবাছড়ি, লংকর নতুন পাড়া, ভুইয়োছড়া, লাম্বাছড়া এ চার গ্রামের কার্বারী এবং স্থানীয় মুরুব্বিরা মিলে আলোচনা করে ঠিক করে নেয়, চার গ্রামের সবাই মিলে মূল বিজু উদযাপন করবে। সবাই একে অপরকে দাওয়াত দিল। তাদের এ ব্যতিক্রমধর্মী বিজু উদযাপনের প্রস্তুতি দেখে খুবই ভালো লাগল। তাদের বিজু উদযাপনের বৈশিষ্ট্যটা ঠিক এরকম ছিল: চার গ্রামের মানুষজন সবাই একসাথে একত্র হয়ে ভিন্ন ভিন্ন দিনে বিজু অনুষ্টান করবে। যেদিন লংকর নতুন পাড়ায় বিজু অনুষ্টান করবে সেদিন অপর তিন গ্রামের মানুষ সেখানে গিয়ে উপস্থিত থাকবে। সবাই একসাথে আলোচনা সভা করবে এবং ভাত খাবে।
প্রথমে আমরা গিয়েছিলাম লাম্বাছড়া গ্রামে। সেদিন সে গ্রামে বড় বড় দুইটি শুকর জবাই করা হয়েছিল আগত অথিতিদের খাওয়ানোর জন্য। অনুষ্টান স্থলে পৌছানোর পর সবাইকে লেবুর শরবত খাওয়ানো হলো। এরপর পান, সুপারি। তারপর ভাত দেওয়া হলো। একজন বুড়ো মানুষ আপ্যায়নকারীদের কাছে এসে বলতে লাগল, “গরবা উনোরে গমে রেনি চ সি। ভাত হম দিনেই সুগোর এরা শাস অত্তুন বেই বেই দো”। প্রথমে তিন গ্রামের মানুষদের খাওয়ানোর পর তারা খেল। তাদের আতিথেয়তা কখনো ভুলবার নয়। এভাবে ১৩ তারিখ লাম্বাছড়া গ্রামে, ১৪ তারিখ ভুইয়োছড়া, ১৫ তারিখ লংকর নতুন পাড়া আর ১৬ তারিখ ঢেবাছড়ি গ্রামে একই নিয়মে বিজু অনুষ্টান উদযাপন করা হয়।
ভিন্নধর্মী এরকম বিজু উদযাপনের মর্মার্থতা কি জিজ্ঞেস করলে স্থানীয় মুরুব্বীরা বলেন, চার গ্রামের মানুষদের মধ্য পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে, ভ্রাতৃত্ববোধ, সম্মানবোধ, বোঝাপড়া, আন্তরিকতা, ভালোবাসা, সহযোগীতাপূর্ণ মনোভাব বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে এ আয়োজন। তাছাড়া এভাবে বিজু উদযাপন বহু বছর আগে থেকেই এ এলাকায় চলে আসছে। ভবিষ্যতে আরো অনেক গ্রামের সমন্বয়ে এরকম উদযাপন করা হবে বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করেন তারা।
সবচেয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এ চার গ্রামের মানুষেরা বিজুর দিনে কেউ মদ্যপান করেনি। কোনো যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ তথা কোনো মানুষকে মাতাল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়নি। তাদের জবাব ছিল, মদ কখনো আমাদের সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না। যে মদ পরিবারে কলহের সৃষ্টি করে, যে মদ মানুষের মস্তিস্কের চিন্তা শক্তিকে বিকৃত করে, ভালো চিন্তা-চেতনা করতে দেয় না, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, সে মদকে কখনো তারা গ্রহন করবে না।
যাদের আমরা (সবাই নয়) কথায় কথায় অনেকটা তাচ্ছিল্যর সূরে বলি “সাজেক হুল্লে। দ্বি-গাজ্অ পাঘাত্তুন আগন গুরি.. ” সে সাজেকের মানুষদের আমি মদ খেয়ে পড়ে থাকতে দেখিনি। সারা বছর জুমে পরিশ্রম করে কষ্টে উপার্জন করা শস্য বিক্রি করে তাদের জুয়ায় আসক্ত হতে আমি দেখিনি এবং শুনিনি। বরং মদ খেয়ে মাতলামি করে মারামারি করার ঘটনা আমি শহর, উপজেলা সদর বা তার কাছাকাছি অনেক স্থানে হয়েছে বলে শুনেছি এবং রাংগামাটি শহরের ক্লাবগুলোতে তথাকথিত শিক্ষিত দাবী করা মানুষদের মদ ও জুয়ায় পড়ে থাকতে আমি দেখেছি।
১৪ এপ্রিল নতুন বছর। নতুন বছরের শুরুর দিন সকালে সেখানকার শিশুদের ৮/৯ জনের একটি দলকে দেখলাম বাড়ি বাড়ি গিয়ে বড় জনদের প্রণাম করছে এবং তাদের কাছ থেকে আশীর্বাদ নিচ্ছে। সন্ধায় লংকর ছড়ার পাড়ে কাউকে কাউকে প্রদীপ জ্বালাতেও দেখলাম।
এ পাহাড়, অরণ্য, জুমক্ষেত, জুমের মাচাংঘর, পাহাড়ি ছড়া, পায়ে চলা পথ…..আমি কোনোদিন হারাতে চাইনা:
১৬ তারিখ সোমবার। ঢেবাছুড়ি গ্রামে বিজু অনুষ্টান শেষে হাগাড়াছুড়ি গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। তখন দুপুর ১২ টা বাজে। প্রচন্ড রোদ। ঠান্ডা বাতাসের ঢেউয়ের ঝলকানিগুলো যেন এক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। গাছের পাতাগুলো নড়াচড়া বন্ধ করে দিল। চিন্তায় পড়ে গেলাম সবাই। এ গরমে কিভাবে এতদুর পথ পাড়ি দেবো। ঢেবাছুড়ি গ্রাম থেকে হাগাড়াছুড়ি গ্রামে হেটে যেতে লাগে প্রায় আড়াই ঘন্টার বেশি। প্রথমে আমরা একটা উঁচু পাহাড় উঠলাম। পাহাড়ের পিট বেয়ে উত্তরদিকে এগোতে লাগলাম। কারো মুখে কথা নেই। সবার শার্ট ইতিমধ্যে ঘামে ভিজে গেছে। চলার পথে পুরোনো জুম ক্ষেত চোখে পড়লো। পুরানো জরাজীর্ণ জুমঘরগুলো দাড়িয়ে আছে। এ জুম ঘরগুলো এখন বুনো-লতাপাতা, বন্য ইদুর, টিকটিকি আর পিপড়ারা দখলে নিয়েছে। জুম ঘরটির ভিতরটা উঁকি মেরে দেখলাম, পুরোনো জামা কাপড়, ভাঙাচোরা একটা বারেং, ছোট্ট দুয়েকটা ঝুড়ি, একটা প্লাস্টিকের পুতুল আর দুয়েকটা লাউয়ের খোল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
জুম ঘরের ঈজোরের সামনে একটা বড় হামারাং গাছ (বাংলা অর্থ জানিনা) দাড়িয়ে আছে। সৌভাগ্যক্রমে হামারাং গাছটির ছড়িয়ে থাকা বিশাল ঝোপের ছায়াটা জুম ঘরের ঈজোরে ছায়াটি ঈজোরে পড়ছিল। ঢেবাছড়ি গ্রাম থেকে আনা দুই লিটারের বোতলের লেবুর শরবতটি সবাই খেয়ে নিলাম। আমরা সংখ্যায় ৬ জন ছিলাম। সবাই তালছড়া গ্রামে যাবে। ১০ মিনিট বিশ্রাম নেওয়ার পর আবার হাটা শুরু করে দিলাম। হাটার পথে পূর্ব দিকে চোখ ফেরাতেই চোখে পড়লো মিজোরাম রাজ্যর পুগজিম পাহাড়টা। মাথা উঁচু করে দাড়ানো এ পাহাড়টি এতই কাছে লাগছিল যে, মনে হচ্ছিল হাত বাড়ালেই পুগজিম পাহাড়ের চূড়োয় থাকা মোবাইল অপারেটরের টাওয়ারটা ছোয়া যাবে। মনে মনে হাতটা বাড়িয়েই দিলাম! নিজের এমন বালকসুলভ আচরন দেখে অজান্তেই হেসে উঠলাম। পুগজিম পাহাড়ের কোল গেঁছে থাকা বিএসএফের সীমান্ত ক্যাম্পগুলি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
কিছুক্ষন যাওয়ার পর সামনে দেখলাম মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে আরেকটি সুউচ্চ পাহাড়। চাকমা ভাষায় “নাক অত বাচ্চে মুড়ো”। সামনে থাকা লোকটি বাম হাত দিয়ে ইশারা করেই দেখিয়ে বললো, “দা, ইন্দি যেবংগে। ছড়া লামোনি গেলে বজমান আরামে যেই পারিবোং। মুড়োবু ইন্দি ন যেবং। মুই ছড়া পত্থান সুগ পাং” বলে বাম দিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামতে লাগল। সবাই সস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আমরাও সবাই তাকে অনুসরন করলাম। ১০ মিনিট পাহাড় বেয়ে নামার পর অবশেষে ছড়ায় পৌছলাম। ছড়ার উপর দিকটা বাঁশ ঝাড়ে ঢাকা। ছড়ায় নেমে যেন মনে হলো নরক থেকে স্বর্গে নেমে এসেছি। কলকল ধ্বন্নিতে বয়ে চলা ছোট্ট ছড়াটির ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। ব্যাগে থাকা পানির বোতলটিতে ঠান্ডা পানি ভরে নিলাম।
বড়-ছোট পাথরে ভরে আছে ছড়ার বুক। এ পাথরগুলোর ফাঁক দিয়েই ছড়ার পানি বয়ে গেছে। ছড়ায় প্রচুর পরিমানে মাছ, চিংড়ি, শামুক আর ব্যাঙাচি চোখে পড়লো। আশেপাশে জনবসতি না থাকায় ছড়াগুলো চিংড়ি আর মাছে ভরে গেছে। ছড়া বেয়ে নিচে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম এইমাত্র কেউ যেন হালচাষ করে চলে গেছে। পরে ভুল ভাঙল। এটা বুনো শুকরের কাজ। অপর একজন বলে উঠল, এ ছড়ার বাম আর ডান পাশে থাকা বিশাল অরণ্যে ভালুক, সজারু, শিয়াল, বুনো মোষ, বুনো কুকুর আর চিতাবাঘ রয়েছে। অনেকে অনেকবার বুনো শুকর শিকার করতে এসে চিতাবাঘটিকে দেখেছে। এ পথে সচরাচর দিনের বেলায়ও কেউ একা আসেনা।
ছড়া বেয়ে নিচে নামছি তখন বেশ বড় আকারের একটা বড় গুইসাপকে পানির মরঙে (ডুডুক) ঝাঁপ দিতে দেখলাম। প্রায় ঢেড় ঘন্টা ছড়া বেয়ে আসার পর হাগাড়াছুড়ি গ্রামে পৌছালাম। গ্রামে বিশ্রাম না করে সোজা তালছড়ার উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। এখান থেকে তালছড়া প্রায় দু ঘন্টার পথ। অনেক পাহাড় উঠানামার পর অবশেষে বিকাল পৌনে পাঁচটা বাজে তালছড়া পৌঁছালাম।
তালছড়া পৌঁছেই একটা বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। আপাতত সেদিনের রাতটা সেখানেই কাটাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। বাড়িটার উঠোনে একটা চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। খুব ক্লান্তি লাগছিল। পা গুলো ব্যাথায় যন্ত্রনা করছে। এরপর বুড়ো এক মহিলা দাবা টানতে টানতে আমার সামনে এগিয়ে এল। বলল, দাবা খাই কিনা। আমিও মাঝে মাঝে খাই বলে দাবাটা নিলাম। অভ্যাস না থাকায় কয়েক টান দেওয়ার পরই মনে হচ্ছিল পৃথিবী নয়, আমিই ঘুরছি, খুব দ্রুত গতিতে। এরপর গ্রামটা ঘুরে দেখবো বলে আমার সাথে আসা একজনকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। গ্রামটা বেশি বড় নয়। ২০ কি ২৫ পরিবার মানুষ আছে। সাজেকের এই প্রথম কোনো এক জায়গায় দেখলাম ধানক্ষেত। এ গ্রামের মানুষেরা জুমের পাশাপাশি ধান্যজমিতেও চাষাবাদ করে। ধানের ক্ষেতগুলি সবুজ রং ধারন করেছিল। গ্রামের এক পাশে ছোট্ট একটা মাঠে সেখানকার কিছু ছেলেকে ভলিবল খেলতে দেখলাম।
ছ টা বাজে। সন্ধা হতে ঢেড় সময় বাকি। সদ্য সূর্য লাল রং ধারন করেছে পশ্চিমের আকাশে। ঘুরতে ঘুরতে পথিমধ্য একটা ছোট্ট জুমঘর (মাচাং ঘর) চোখে পড়লো। সেখানে গিয়ে দেখলাম, একটা চৌদ্ধ কি পনের বছর বয়সী একটা মেয়ে পোদোনা বাচ্ছুরি কেটে কুটে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। “চিজি, এক্কা পানি হেই পেব নি? বলার পর পানির হোত্তিটা ধরে ঈজোরের দিকে এগিয়ে এল। পানি খেলাম। তারপর পড়ালেখা করো কিনা জিজ্ঞেস করাতেই করিনা বলে হোত্তিটা নিয়ে ঘরের ভিতরে চলে গেল।
এরপর আমরা সেখান থেকে চলে আসলাম। সন্ধা ক্রমেই ঘনিয়ে আসছিল। আসার পথে আমার সাথে থাকা ছেলেটি বললো, ওই মেয়েটি বিবাহিতা। সাত কি আট মাস হলো বিয়ে হয়েছে। সে ছোট্ট ঘরটাতে সে আর জামাই থাকে। আমি আশ্চর্য বনে গেলাম। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। এত কম বয়সে কেউ এরকম মেয়েকে বিয়ে দেয়? ও বলল, এ গ্রামের মানুষেরা এতটা সচেতন নয়। একটু বড় হলেই এখানকার মেয়েদের বিয়ে হয়, ছেলেরা বিয়ে করে। এতে অভিবাবক মহলে কোনো মাথা ব্যাথা নেই বললেই চলে।
এরপর রাত হলো। রাতের খাবার খেলাম সন্ধা সাতটা বাজে। রাতের খাবারে নতুন একটা আইটেম লক্ষ্য করলাম। নাম “শাকগন্দ”। লেলম পাতা, বাতবাত্তে শাক, জাঙাল্লে শাক, ঢিঙি শাক, হুধুগুলো শাক, সুগুরিগুলো শাক, আমিলে পাতা, ওজোন শাক সহ অনেক জাতের শাক একসাথে রান্না করা হয়েছিল। বেশ তৃপ্তি সহকারে খেলাম। জীবনের প্রথমবারের মতোই এরকম তরকারি খাওয়ার অভিজ্ঞতা হলো। ভাত খাওয়ার কিছুক্ষন পরে স্থানীয় ৭ জন মানুষ ওখানে আসলো। এদের মধ্য একদম বয়স্ক দুইজন, অর্ধ বয়সী দুইজন, তরুন তিন জন। তরুনরা কলেজে পড়ছে। তাদের সাথে প্রায় সাড়ে ১০ টা নাগাদ কথা হলো। সমাজের ভিবিন্ন অবস্থা, শিক্ষা ব্যাবস্থা, পার্বত্য চট্টগ্রামের, দেশের এবং আন্তর্জাতিক বর্তমান পরিস্থিতিসহ চুক্তি বিষয়েও আলাপ আলোচনা হলো। এ বাস্তবতায় আমাদের যুব-সমাজ, ছাত্র সমাজ এবং সমগ্র সমাজের ভিবিন্ন শ্রেনীর মানুষেরা কিভাবে অবদান রাখবে বা তাদের কী করণীয় হওয়া উচিত সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলাম। এরপর বিদায় নিয়ে যে যার ঘরে চলে গেল। আমরাও ঘুমাতে গেলাম।
যে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো চলে বর্গা শিক্ষক দিয়ে: সম্ভাবনাময়ী স্বপ্নগুলোর অপমৃত্যু:
২০ এপ্রিল ২০১৮ সকাল সাড়ে ১০ টা। কমলাক থেকে সয়নালছড়া গ্রামে আসতে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো সময় লাগে। এ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথে সেদিন আমার সঙ্গী হয়েছিল দুইজন শিশু। সম্পর্কে তারা আপন দুই ভাই। বড়টার বয়স বারো কি তের, ছোটটার বয়স ১০ হবে। আসার প্রথম দশ মিনিট আমাদের মধ্য কোনো কথা হলো না। তারপর আমিই প্রথম কথা বলা শুরু করলাম। নিজের পরিচয় দিলাম। কোথা থেকে আসছি আর কোথায় যাবো বললাম। তারাও আমার প্রতিটি কথা শুনে যাচ্ছিল। প্রথমে ছোট ভাইটির সাথে আলাপ জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার কাছ থেকে তেমন আশানুরূপ ফল পেলাম না। কেন জানি আমার প্রতিটি কথায় এড়িয়ে গেল। এরপর বড় ভাইয়ের সাথে দুয়েকটা কথা বলাতে গর গর করে কথা বলতে লাগল। জানতে পারলাম, তাদের বাড়ি সয়নালছড়া গ্রামে। চার ভাইবোন তারা। সে সবার বড়। পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৭ জন। জুম চাষ করে তারা। এবছর মাত্র চার আড়ির জুম কেটেছে তারা। পথে আসতে আসতে সদ্য পোড়ানো তাদের জুমক্ষেতটি সে দেখিয়ে দিল। এখনো জুমে পুড়ে না যাওয়া গাছ গুলো পরিস্কার করা হয়ে উঠেনি।
পড়ালেখা করো কিনা জানতে চাইলে সে মাথা নেড়ে না বাচক ভঙ্গি করে বুঝাল, পড়ালেখা করে না। কেন পড়ালেখা করো না প্রশ্ন করাতেই চুপ হয়ে রইল কিছুক্ষন। তারপর পথ চলতে চলতে বললো, “বাবার বয়স হয়েছে। আগের মতো আর কষ্ট করতে পারেনা। তাই পড়ালেখা ছেড়ে জুমে বাবাকে সাহায্য করানোর দায়িত্বটা নিয়েছি। বাবার কষ্ট দেখে আর পড়ালেখা করার ইচ্ছে হয়নি।” তার কথা শুনে আমি এতটাই আবেগপ্লুত হলাম যে, সাথে সাথে চোখে জল এসে গেল। সে আরো জানালো, তার ইচ্ছা ছিল সে পড়ালেখা করে তাদের স্কুলে শিক্ষক হবে। ছোট ছোট বাচ্ছাদের পড়াশোনা করাবে। এরপর আবারো চুপচাপ.. ছোট ভাইটাও হেলে দুলে আমাদের পিছু পিছু চলল। আরো অনেক কথা হলো। আসার পথে মনে মনে নিজেকে কেন জানি অপরাধী মনে হতে লাগলো। মনে মনে নিজের সাথে বার বার কথা বলছিলাম। বারবার তার কথাগুলো মনে পড়ছিল। এ সম্ভাবনাময়ী স্বপ্নগুলো একদিন আমাদের সমাজে তথা দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারত। কিন্তু দারিদ্র্যর কষাঘাতে তার মতো অনেক ছেলে-মেয়ের দেখা স্বপ্নগুলো হারিয়ে যাচ্ছে অতল গহব্বরে। এ কচি বয়সে জীবন বাঁচার তাগিদে তাদের মুখোমুখী হতে হচ্ছে ভয়াবহ কষ্টের। তাদের চিন্তা ভাবনা এখন জুমকে নিয়ে। তাদের আগামী বছরের খাদ্যর খোরাক, চিকিৎসা ও বস্ত্রের খরচ জোগাবে এ জুম। এরকম শত শত সম্ভাবনাময়ী স্বপ্নগুলোর অপমৃত্যু হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সে স্বপ্নগুলোর অপমৃত্যুর জন্য কারা দায়ী?
প্রায় সোয়া এক ঘন্টা হাটার পর সয়নালছড়া গ্রামে এসে পৌছালাম। আমাকে পৌছে দিয়েই তারা দ্রুত বিদায় নিল। আমিও বিদায় জানালাম।গ্রামটি বেশ সুন্দর। গ্রামের ঠিক মাঝখানে একটি স্কুল এবং খেলার মাঠ দেখতে পেলাম। সয়নালছড়া থেকে নিট পয়েন্ট নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব বাবার বয়সী একজন নিল। সয়নালছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কি অবস্থা জানতে চাওয়াতে অনেক কিছু ফাঁক-ফোকর বেড়িয়ে এল। লোকটি জানালো, এ স্কুলে সরকারীভাবে নিয়োগ পাওয়া একজন শিক্ষক এবং একজন শিক্ষিকা রয়েছেন। কিন্তু তারা আছে নামমাত্র। একজনের নাম অর্পনা চাকমা আর অন্য জনের নাম মোঃ ফারুক। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে তারা কখনো স্কুলে ক্লাস করাতে আসেননি এবং গ্রামের কেউই তাদের চেনেনা। লোকটির কাছ থেকে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সাগর কার্বারীর মোবাইল নাম্বারটা নিলাম। সাগর কার্বারীর সাথে মোবাইলে প্রায় আধা ঘন্টার বেশি কথা বলেছিলাম। উনার ভাষ্যমতে, উনি স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হলেও সে স্কুলে সরকারীভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের সাথে কখনো পরিচয় বা দেখা-সাক্ষাত হয়নি। শুধুমাত্র ফোনে যোগাযোগ হয়। উনি আরো বললেন, গত বছর এ স্কুল থেকে পিএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ৫ জন। সেখান থেকে উত্তীর্ণ হয়েছিল মাত্র দুজন। পরীক্ষার কয়েকদিন আগে শিক্ষক দুজনের সাথেই নাকি তাদের কথা হয়েছিল। তারা বলেছিল, তারা পরীক্ষার হলে গিয়ে পরীক্ষার্থীদের ভালো মন্দ দেখবে। তারা যেন চিন্তা না করে। কিন্তু, পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীদের কেউ দেখতে আসেনি। এবছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় সয়নালছড়া স্কুল থেকে অংশগ্রহন করবে তেরো জন শিক্ষার্থী। এ তেরো জন শিক্ষার্থী পিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে কি হবে না তা নিয়ে অভিবাবক মহলে চিন্তার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা চিন্তিত।
জানা যায়, সরকারীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত দুজন শিক্ষক অর্পনা চাকমা আর ফারুক বিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস না করে এ বছরের জানুয়ারি হতে আলোচনা করে মাসিক ৬০০০ টাকা বেতনে দুজন বর্গা শিক্ষক রেখেছেন। সে দুজন বর্গা শিক্ষক হলেন নির্মল কান্তি চাকমা (ইন্টার পাশ করতে পারেনি) এবং জ্ঞান রঞ্জন চাকমা (ইন্টার পাশ করেছে)। তাদের দুজনের বাড়িই সয়নালছড়া গ্রামে। গত জানুয়ারি থেকে বর্তমান পর্যন্ত এ দুজন বর্গা শিক্ষককে প্রতিজনকে ৬০০০ টাকা করে বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও এক টাকাও এখনো পর্যন্ত তাদেরকে দেওয়া হয়নি বলে তারা জানায়।
নিউলংকর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। এখানের অবস্থাও অত্যান্ত করুন। এ বিদ্যালয়ে চারটি গ্রামের শিশুরা পড়াশোনা করে। গ্রামগুলো হচ্ছে আদুপাড়া, নিউলংকর পাড়া, মোনো আদাম এবং আনন্দ পাড়া। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, এ বিদ্যালয়ে মোট তিনজন শিক্ষক রয়েছেন। প্রধান শিক্ষক মনোরঞ্জন চাকমা, অপর দুজন ববিতা চাকমা এবং সেলী চাকমা। মনোরঞ্জন চাকমা থাকেন রুলোইয়ের কাছাকাছি দাড়ি আদামে, ববিতা চাকমা সাবেক বাঘাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমার স্ত্রী অপরজন সেলী চাকমা মধ্যম বাঘাইছড়ি গ্রামে। প্রধান শিক্ষক মনোরঞ্জন চাকমা সপ্তাহে এক-দুদিন ক্লাশে আসলেও অপর দুজন শিক্ষিকা ববিতা চাকমা এবং সেলী চাকমা কখনো ক্লাশে যাননি বলে জানা যায়। এমনকি তাদের চেহারা গ্রামবাসীরা এখনো দেখেননি বলে জানায়। এ দুজন শিক্ষিকা ক্লাশ না করে অনার্স পড়ুয়া একজন ছাত্র মনেন্দ্র চাকমা নামে একজনকে বাৎসরিক ৫৬,০০০/- দরে দেওয়ার কথা বলে তার মাধ্যমে পাঠদান করান। অর্থাৎ বাৎসরিক ৫৬ হাজার টাকায় (মাসিক হিসাবে সাড়ে ৪ হাজার টাকার কিছু বেশি) এ দুজন শিক্ষিকা তাদের শিক্ষকতা বর্গায় রেখেছেন।
এতো মাত্র সয়নালছড়া আর নিউলংকর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থার কথা উল্লেখ করলাম। সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নেলশন চাকমার সাথে কথা বলে জানতে পারি, বর্তমানে সাজেক ইউনিয়নে বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্র ১ টি : বাঘাইহাট উচ্চবিদ্যালয়, জুুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩ টি : রুইলুই জুনিয়র হাই স্কুল, মাচালং জুনিয়র হাই স্কুল, করল্যাছড়ি জুনিয়র হাই স্কুল। সরকারিভাবে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৫ টি, বেসরকারি তথা ভিবিন্ন এনজিও বা দাতা সংস্থা দ্বারা চালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩০-৪০ টি বা তার থেকে কম। জাতীয়করণকৃত ৩৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মোট তেরোটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মাত্র জাতীয়করণের অন্তর্ভুক্ত হয়। এগুলো হলো: প্রথম দফায় ৯ টি: নিউলংকর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সয়নালছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রুইলুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিয়ালদাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, থুইছুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেথলিং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লংকর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,
দ্বিতীয় দফায় ৪ টি: গঙ্গারাম মুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাইবোন ছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লক্ষীছড়ি মুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। সর্বশেষ, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী ২০ তারিখে তৃতীয় দফায় বাকী ২২ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষনা দেওয়া হলেও শিক্ষকদের জাতীয়করণ করা হয়নি।
প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সরকারীভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলেও ২/৩ টি বিদ্যালয় বাদে বাকি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষককেরা কোনোদিন ক্লাশ করাননি বলে জানান তিনি। উপরন্তু সেই শিক্ষকেরা বছরের পর বছর ধরে তাদের স্কুলগুলোতে বর্গা শিক্ষক রেখে তাদের দায়ছাড়াভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এবং মাসে মাসে বেতন-ভাতা তুলে ভোগ করছেন।
তিনি আরো বলেন, শিক্ষকেরা যাতে বিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত ক্লাস নেন সেজন্য শিক্ষকদের সাথে দফায় দফায় আলোচনা করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায়ও তিনি অনেকবার উপজেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান বরাবর এ বিষয়ে আলোকপাত করেন এবং শিক্ষকরা যাতে বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে পাঠদান করেন সেজন্য উপযুক্ত ব্যাবস্থা গ্রহন করার দাবী করেন। কিন্তু, তারা আশ্বাস দিলেও এ ব্যাপারে কেউ উপযুক্ত ব্যাবস্থা নেননি।
দীর্ঘ পথ। বড় একটা পাহাড়, যে পাহাড়টা রুলোই পাহাড়ের সারিটির সাথে মিছে গেছে, সে পাহাড়টি চূড়ো পর্যন্ত উঠলাম। তবে এবার প্রকৃতিও যেন আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল। আসার পথের পুরোটা সময়ই আকাশ মেঘলা ছিল এবং ঠান্ডা বাতাসের ঝলকানিগুলোতে বারবার যেন প্রান ফিরে পাচ্ছিলাম আমরা। অবশেষে নিট পয়েন্ট পৌছালাম। লোকটি বারবার বলতে লাগলেন, আপনারা তো সংগঠন করেন, আপনারা একটু এবিষয়টা খটিয়ে দেখবেন দয়া করে। আমাদের খুব উপকার হবে। আমাদের ছোট্ট ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত যেন নষ্ট না হয়।
রুলোই পাহাড়ের দক্ষিন দিকে নেমে যাওয়া পাহাড়ের সারিটার ঠিক পিট বরাবর গ্রামের নামটিই নিট পয়েন্ট। আধা ভাঙাচোড়া সব ঘরই মাচাং ঘর, কারোর ঘরের চাল টিন দিয়ে ঢাকা বাকীগুলো শনের। খাবার এবং অন্যান্য কাজে ব্যাবহৃত পানির সংকট চলছে সেখানে। সবচেয়ে বড় কথা এখানে বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে যুগ যুগ ধরে। সরকারি কোনো স্কুল নেই এ গ্রামে। এ গ্রামের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে এখান থেকে দীর্ঘ এক ঘন্টার পথ (নিট পয়েন্ট থেকে সয়নালছড়া যেতে লাগে এক ঘন্টা। পাহাড় বেয়ে নামতে হয় বলে সময় কম লাগে। আর সয়নালছড়া থেকে এখানে আসতে পাহাড় উঠতে হয় বলে লাগে দুই ঘন্টা) বেয়ে সয়নালছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে না গেলে কখনো ভাবতেই পারবেন না, এখানকার ছোট্ট বাচ্চারা কতটা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে।
এখান থেকে রুলোই পর্যটন বেশি দূরে নয়। মাত্র আধা ঘন্টার পথ। পাহাড় বেয়ে উঠলেই পর্যটন স্পট। সারি সারি রং বেরঙের রিসোর্ট, পাকা রাস্তা, দোকান সব মিলিয়েই যেন বিদেশের কোনো পর্যটন স্পট। এ পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে কিছু মাদক ব্যাবসায়ী মিজোরাম থেকে প্রতিনিয়ত চোরা পথে এ পর্যটন কেন্দ্রে ভিবিন্ন বিদেশী মদ সরবরাহ করে চলেছে।
পরিশেষ, আজকে শিক্ষা ব্যবস্থার এ পরিবেশ শুধুমাত্র সাজেকে নয়, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ ভিবিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। শত শত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাজারো শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। এ হাজারো শিক্ষার্থীরাই একদিন এ এলাকার তথা দেশের ভিবিন্ন প্রতিষ্টানে নেতৃত্ব দেবে এবং বিশেষ অবদান রাখবে। কিন্তু সাজেক তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে এরকমের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকলে অচিরেই এ শিশুদের জীবন অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। অনেকগুলো সম্ভাবনাময়ী স্বপ্নের মৃত্য হবে। আজকে জেলা পরিষদের মাধ্যমে যারা শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকেন, সেই কর্তৃপক্ষ আজ দুর্নীতির মধ্য দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা যখন সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠতে পারে না, তখন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাও মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। এ অব্যবস্থার মধ্য শিক্ষা কখনো এগিয়ে যেতে পারেনা। আর এ অব্যবস্থার মধ্য সরকার এক প্রকার জোর করে এখানে রাংগামাটি মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছে। আজকে উন্নয়নের কারনে হোক বা যেকারনেই হোক না কেন এরকম চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের জন্য কখনো সুফল বয়ে আনবে না, শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা কখনো এগিয়ে যেতে পারবো না, এ নির্মম বাস্তবতা আমাদের ছাত্র ও যুব সমাজকে উপলব্ধি করতে হবে এবং করণীয় ঠিক করতে হবে। আজকে সাজেকে শুধুমাত্র শিক্ষাব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে তা নয়, এ বিশাল এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সুব্যবস্থা একেবারে নেই বললেই চলে। এখানে জুম চাষ যোগ্য ভুমি কমে গেছে। তাছাড়া এ এলাকার ভূমিপুত্ররা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিকসহ ভিবিন্ন দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে জুম্ম জনগনের অধিকারের সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সরকারকেই বিশেষভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
……………………….
জিকো চাকমা, দপ্তর সম্পাদক, পিসিপি, রাঙামাটি শহর শাখা।