শিশু সন্ত্রাসী ও দ্বিখণ্ডিত বাংলাদেশ এবং…
…রমেল চাকমার রেখে যাওয়া কিছু চিন্তার খোরাক
বিকট নীরবতা ভেঙে শুরু হওয়া বিবিধ অপলাপ
রাঙামাটির নানিয়ারচরে সরকারি সেনাদের হাতে আটক হওয়ার পর (অভিযোগ অনুসারে নির্যাতনের শিকার হয়ে) চিকিৎসাধীন অবস্থায় চট্টগ্রামে মৃত্যুবরণ করা রমেল চাকমাকে নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে শুরুতে বিকট নীরবতা থাকলেও ফেসবুকে বেশ আলোচনা চলছে গত কয়েকদিন ধরে। তাতে আমিও কিছুটা অংশ নিয়েছি, আর সেই সুবাদে একাধারে কৌতুককর ও হতাশাব্যঞ্জক কিছু বিষয় চোখে পড়াতে সেসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে থাকতে পারি নি। যেমন প্রাথমিক নীরবতা ভেঙে একাধিক পত্রিকা কিভাবে রমেল চাকমাকে নিয়ে ‘কর্মবাচ্যনির্ভর’ ভাষায় খবর পরিবেশন শুরু করেছে, তা নিয়ে ফেসবুকে লিখেছি। নিচে বর্তমান প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক, এমন আরো দু’একটি পর্যবেক্ষণ তুলে করছি।
চাকমা হওয়ার ‘সুবিধা’
“রমেল চাকমার প্রতি যে এত দরদ দেখানো হচ্ছে, সেটা কি সে চাকমা বলেই?” এমন প্রশ্ন তুলেছেন ফেসবুকে সরব উপস্থিতিসম্পন্ন একাধিক ব্যক্তি, যেনবা রমেল চাকমার মৃত্যুতে দেশের নাগরিক সমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে এবং গণমাধ্যম জুড়ে চলছে ব্যাপক আলোড়ন। কিন্তু বাস্তবতা হল উল্টো। অধিকন্তু চাকমা তথা অন্যান্য প্রান্তিক জাতিসমূহের উপর সংঘটিত বহু অন্যায় দশকের পর দশক ধরে ধামাচাপা দিয়ে আসা হচ্ছে এদেশে। এই প্রেক্ষাপটে উদ্ধৃত প্রশ্নে যে নিষ্ঠুর পরিহাস ও তাচ্ছিল্য ফুটে ওঠে, তা কি সচেতনভাবেই প্রকাশ করছেন অনেকে?
পাঁচ-ছয় বছর বয়সের শিশুও যখন ‘সন্ত্রাসী’
একজন সুহৃদ ফেসবুকে রমেল চাকমা বিষয়ক আমার একটি পোস্ট শেয়ার করাতে সেটির নিচে নিজের পরিচয় চিটাগাং-এর ‘পোয়া’ (ছেলে) হিসেবে দেওয়া এক ব্যক্তি একটি ছবি দিয়ে মন্তব্য জুড়ে দিয়েছেন, “ছবি কথা বলে…রমেল চাকমা কি আসলেই নিরীহ, নিরপরাধ?” ‘কথা বলা’ ছবিটিতে রয়েছে অস্ত্র হাতে পোজ দেওয়া পাঁচ ব্যক্তি, যাদের একজনের উপর লাল বৃত্ত এঁকে তার নাম-পরিচয় লিখে দেওয়া হয়েছে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ ‘রমেল চাকমা’। তবে তরুণটির দুই চোখই স্বাভাবিক, এবং তার চেহারার সাথে পত্রপত্রিকায় আসা এক-চোখে-দৃষ্টিশক্তিহীন রমেলের কোনো মিল নেই। আরো মজার ব্যাপার হল, ছবিতে দেখানো পাঁচজন সশস্ত্র ব্যক্তির মধ্যে একজনের বয়স হবে বড়জোর পাঁচ ছয় বছর, যে কোনোমতে একটি অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে! বাকিরাও সবাই কিশোর। ছবিটা আমি ফেসবুকে শেয়ার করব কিনা ভাবছিলাম, কিন্তু এতে যেহেতু একজন শিশুসহ অল্পবয়সী তরুণদের দেখানো হয়েছে, তা করা থেকে বিরত থাকলাম, এবং কোনো লিংকও আর দিচ্ছি না। যাই হোক, ধরা যাক এমন কোনো ছবি বা অন্য কোনো দালিলিক প্রমাণ আছে যা দিয়ে রমেল চাকমাকে একজন ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে তুলে ধরা যায়। সেটি ব্যবহার করেও কি তাকে অবৈধভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা কোনোভাবে জায়েজ হত? অবশ্যই নয়। কিন্তু এই মৌলিক প্রশ্নের ধারে কাছে না গিয়েই অনেকে যে কাঁচা হাতের ভুয়া ছবি ও নির্লজ্জ মিথ্যাচারের সহায়তায় একটা চরম অন্যায়কে আড়ালের চেষ্টা করতে পারে, তা থেকে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের কোন চেহারা আমরা দেখতে পাই?
দ্বিখণ্ডিত বাংলাদেশ
‘রমেল চাকমা মরতে গেলেন কেন?’ শিরোনামে দেওয়া আমার একটি পোস্টের নিচে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘রমেল চাকমারা বাংলাদেশকে দ্বিখণ্ডিত করতে চায়।’ সেটি তাৎক্ষণিকভাবে খণ্ডনের কোনো চেষ্টা আমি করি নি, তেমন প্রয়োজনও বোধ করি নি, কিন্তু এমন কথা যেহেতু প্রায়ই ওঠে, আমি এখানে একটা প্রত্যুত্তর দিচ্ছি যা কেউ চাইলে নিজেও ব্যবহার করতে পারেন।
“রমেল চাকমারা কি চায় সেটা পরের প্রশ্ন, খেয়াল করার বিষয় হল, বাংলাদেশ আগেই দ্বিখণ্ডিত হয়ে আছে! পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত শত অন্যায়ের ঘটনা যে বরাবরই ধামাচাপা দিয়ে আসা হয়েছে, তা নিয়ে দেশের বাকি অংশ এ পর্যন্ত কতটা খোঁজ রেখেছে বা মাথা ঘামিয়েছে? এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যেগুলি দেশের অন্য কোথাও ঘটলে ক্ষমতাসীনদের গদি উল্টে যেতে পারত। এটা কি এই বাস্তবতাই তুলে ধরে না যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে? কারা এভাবে দেশকে ‘দ্বিখণ্ডিত’ করে রেখেছে এবং কিসের স্বার্থে?”
বহুধাখণ্ডিত পার্বত্য চট্টগ্রাম
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে যে নানা দিক থেকে দেশের বাকি অংশ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে বিভিন্নভাবে, তাই নয়, পুরো অঞ্চলটি সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নিজেও বহুধাখণ্ডিত হয়ে আছে। বিভিন্ন কারণে মনে হয়, এসব বিভেদকে ক্ষমতাসীন এক বা একাধিক গোষ্ঠীই হয়তবা নিজেদের সুবিধার্থে জিইয়ে রাখছে। মাঝখানে পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে সাধারণ জনগণকেই সবচেয়ে বেশি গুনতে হচ্ছে বঞ্চনা ও দুর্ভোগের মাশুল। বলা হয়ে থাকে, ‘বনে থাকলে বাঘের নাম মুখে নিতে নেই’, যে কথা আমি ফেসবুকে উল্লেখ করেছি রমেল চাকমার খবর পরিবেশন করতে গিয়ে নির্যাতনকারী হিসেবে অভিযুক্ত সংস্থার নাম উচ্চারণ করা থেকে প্রথম আলোর বিরত থাকার বিষয়টি সামনে আনতে গিয়ে। দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানই যখন ক্ষমতার বিভিন্ন কেন্দ্রকে এতটা সমঝে চলে, সেখানে জনগণের বিবিধ প্রান্তিক অংশের অবস্থা কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। তার উপর পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতীকী অর্থে সাধারণ মানুষদের সমঝে চলতে হয় একই বনাঞ্চলে বিচরণকারী একাধিক বাঘকে! হতে পারে এই তুলনা সারা দেশের ক্ষেত্রেও কিছুটা প্রযোজ্য। যাই হোক, এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সংকল্প যেন জনগণের মধ্যে সুসংহত হয়ে ওঠে সর্বত্র, সেই লক্ষ্যে কাজ করার অনেক কিছু আছে।
পুনশ্চ:
একই রাষ্ট্রীয় সুতোয় গাঁথা তিনটি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ শিরোনামে অক্টোবর ১৮, ২০১৬ তারিখে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করেছিলাম ফেসবুকে। ওতে উল্লিখিত তিনটি ঘটনার মধ্যে রয়েছে আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতা: আমি যখন উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন দেশের একটি সশস্ত্র বাহিনীর হাতে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছিলাম, এমনকি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল। ঘটনাটা ঘটেছিল নানিয়ারচরে, যে এলাকা ছিল মৃত্যুর আগে রমেল চাকমার ঠিকানা!
প্রশান্ত ত্রিপুরা; নৃবিজ্ঞানী