আগামীকাল রাঙ্গামাটিতে পিসিপি’র সম্মেলন: ৩৩ বছরে পা রাখছে ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটি
আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): লড়াই, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৩৩ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ। সংক্ষেপে সংগঠনটি পিসিপি নামেই সমাধিক পরিচিত। আগামীকাল ২০ মে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম ছাত্র সমাজের লড়াকু এই সংগঠনটি পালন করতে যাচ্ছে ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৮৯ সালের ২০ মে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জাতিসমূহের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ জড়িত রয়েছে। সামরিক নিপিড়ীনের ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে শৃংখল ভেঙে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখিয়েছে পাহাড়ী ছাত্র-জনতাকে।
এবারের ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে সংগঠনটি। ২দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মাধ্যমে পালন করতে যাচ্ছে সংগঠনটি। সেই সাথে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ২৬তম কেন্দ্রীয় সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কাউন্সিলের মাধ্যমে আসবে নতুন নেতৃত্ব।
আগামীকাল রাঙ্গামাটির জিমনেসিয়াম মাঠ প্রাঙ্গণে সকাল ৯.৩০টায় ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ২৬তম কেন্দ্রীয় সম্মেলনের অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবি অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী। উক্ত সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা)। এছাড়াও অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিণ কণা, বিশিষ্ট সাংবাদিক নজরুল কবীর, শিক্ষবিদ শিশির চাকমা প্রমুখ। জিমনেসিয়াম মাঠ প্রাঙ্গনে সকাল ১০ টায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সম্মেরনে সভাপতিত্ব করবেন সংগঠনটির সভাপতি সুমন মারমা। পরদিন দিনব্যাপী (২১ মে) রাঙামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে সংগঠনটির প্রতিনিধি সম্মেলন ও কাউন্সিল অধিবশেন অনুষ্ঠিত হবে বলে আইপিনিউজকে জানিয়েছেন পিসিপি’র নেতৃবৃন্দ।
এছাড়াও ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ২৬তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল উপলক্ষ্যে পিসিপি পোষ্টার, বিৃবতি, পিসিপি’র মুখপত্র ‘কেওক্রডং’ প্রকাশ করেছে। ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর, চট্টগ্রাম মহানগর এবং তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন উপজেলায় প্রকাশিত পোস্টার দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে সংগঠনটি। পিসিপি’র এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়: “আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন জোরদারকরণে ছাত্র সমাজ অধিকতর সামিল হউন”।
উল্লেখ্য যে, ১৯৮৯ সালের ৪ মে লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ২০ মে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জুম্ম ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে ‘বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’-এর জন্ম হয়। লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদ জানাতে পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য সেদিন ২০ মে বিকালে বুয়েটের রশিদ হলের ২০২ নম্বর রুমে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই মিটিঙে রাত অবধি আলাপ আলোচনা করে প্রশান্ত ত্রিপুরাকে আহ্বায়ক করে ‘বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তারপর দিন ২১ মে লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে মৌন মিছিলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মৌন মিছিলে সামিল হয় শত শত জুম্ম ছাত্রছাত্রী। সেদিন বিকালে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
পররর্তীতে ১৯৮৯ সালের ৯ জুলাই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজেয় পাদদেশে। উক্ত সম্মেলনে বিধান চাকমাকে সভাপতি ও ধীরাজ চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ১৭ সদস্য বিশিষ্ট প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়।
এভাবেই লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম ছাত্রছাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব দৃঢ় অঙ্গীকার ও প্রত্যয় নিয়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাম্য ও প্রগতির মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যাত্রা শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ। জন্মলগ্ন থেকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ জুম্ম ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের দাবিসহ সার্বজনীন বিজ্ঞান-ভিত্তিক গণমুখী সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থার দাবির পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সাংবিধানিক নিশ্চয়তাসহ সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধানের দাবি তুলে ধরে। জুম্ম ছাত্র সমাজ পিসিপি’র পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে।
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত পিসিপি’র বিবৃতিতে বলা হয় যে, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি-উত্তর সময়েও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ জুম্ম ছাত্রদের সংগঠিতকরণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বৃদ্ধি, আদিবাসী জাতিসমূহের স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু, বিনামূল্য কোচিং ক্লাস, শিক্ষা ক্যাম্পেইন, বার্ষিক শীত বস্ত্র বিতরণ প্রভৃতি জুম্ম জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করে চলেছে। অপরদিকে জুম্মদের ভূমি বেদখল, জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, অবৈধ গ্রেফতার, বিচার-বহির্ভুত হত্যা, জুম্ম নারী ধর্ষণ, চুক্তি লঙ্ঘন করে সেনা ক্যাম্প স্থাপন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন এবং ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ময়দানে সোচ্চার। এ লড়াইয়ে পিসিপি’র অনেক ত্যাগী নেতা শহীদ হয়েছেন।
উক্ত বিবৃতিতে আরো বলা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা ভয়াবহভাবে বিরাজ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক জীবন এক অলিখিত কারাগারে বাস করতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিভাবে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর হতে চললেও সরকার চুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ সরকার বর্তমানে এক নাগাড়ে ১৩ বৎসর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোন কার্যকর পদক্ষেপ ও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। পার্বত্য চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত রেখে দিয়ে সরকার উল্টো ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে অব্যাহতভাবে দেশে বিদেশে অসত্য, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিবৃতিতে পিসিপি উল্লেখ করে যে, এভাবেই সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী সরকারগুলোর মতো সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক ও জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব বিলুপ্তির ভ্রান্ত নীতি গ্রহণ করেছে। জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত’ হিসেবে পরিচিহ্নিত করার জন্য ব্যাপক অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম চালিয়ে হচ্ছে। জুম্ম জনগণের ঘরবাড়ি তল্লাসী, গ্রেফতার, ক্রশফায়ারের নামে বিচার-বহির্ভুত হত্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের, নারীর প্রতি সহিংসতা, অনুপ্রবেশ, ভূমি বেদখল, চুক্তি বিরোধী অপপ্রচার ইত্যাদি মানবতা ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে বলে পিসিপি তার বিবৃতিতে উল্লেখ করে।