অন্যান্যআঞ্চলিক সংবাদ

ভয়ে কথা বলে না আত্মহত্যা করা দুই আদিবাসী সাঁওতাল কৃষকের পরিবার

সূভাষ চন্দ্র হেমব্রম, রাজশাহী: রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করা দুই আদিবাসী সাঁওতাল কৃষকের পরিবারের সদস্যরা এখনও আতঙ্কে আছেন। বাইরে থেকে কেউ খোঁজখবর নিতে গেলে ভয়ে তাঁরা কথা বলতে পারেন না। বাইরের লোকজন দেখলে তাঁরা বাড়ি ছেড়েই পালিয়ে যান। প্রভাবশালী মহলের চাপে থাকার কারণে গ্রহণ করতে পারেন না কোন সামাজিক সহায়তাও।

বৃহস্পতিবার ২১ জুলাই ২০২২ রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘুটু গ্রাম ঘুরে এসে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানিয়েছে একটি নাগরিক পর্যবেক্ষক দল। সকালে ১১ সদস্যের একটি দল নিমঘুটু গ্রামে আত্মহত্যা করা কৃষক অভিনাথ মারান্ডি ও রবি মারান্ডির বাড়ি যান। বিকালে এক মতবিনিময় সভায় তাঁরা সাংবাদিকদের সার্বিক পরিস্থিতি জানান। অ্যাকশনএইড ও বেসরকারি সংস্থা পরিবর্তন-এর সহযোগিতায় খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি) নগরীর একটি হোটেলে এ সভার আয়োজন করে।

সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জেলা শাখার সভাপতি কল্পনা রায়। মতবিনিময় সভা পরিচালনা করেন পরিবর্তনের নির্বাহী পরিচালক রাশেদ রিপন।

সভায় রুলফাও-এর পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, ঘটনার পাঁচ মাস পরেও পরিবার দুটি ভীত। কথা বলতে তাদের জড়তা রয়েছে। ভয়ে তাঁরা কথা বলতে চায় না। ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁদের মুখ বন্ধ রাখা হচ্ছে। তাঁদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। দ্রুতই এ পরিস্থিতির অবসান হওয়া প্রয়োজন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বখতিয়ার আহমেদ বলেন, গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, স্থানীয় ক্ষমতাচক্র এখনও পরিবার দুটিকে ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে রেখেছে। সামাজিক সহায়তা পর্যন্ত গ্রহণ করতে তারা ভয় পাচ্ছে। একটা উন্নয়ন সংস্থা পর্যন্ত ক্ষমতার হিসেব-নিকেশের মধ্যে যুক্ত হয়ে পরিবার দুটিকে ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে রেখেছে। পরিবার দুটিকে নিরাপত্তা দেওয়া যাঁদের দায়িত্ব তাঁরা ব্যর্থ হয়েছে।

খানির কোষাধ্যক্ষ মুশফিক আহমেদ বলেন, দুই কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলার অভিযোগপত্র হয়েছে। কিন্তু যে পরিস্থিতি তাতে পরিবার দুটি বিচার পাবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। সরকারকে এই বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

কালের কণ্ঠের খুলনা ব্যুরো প্রধান ও খানির সদস্য গৌরাঙ্গ নন্দী বলেন, গ্রামে যাওয়ার পর আমরা পরিবার দুটির অনেককেই পাইনি। ভয়ে তারা কথা বলতে পারে না। এই ভয় কারা সৃষ্টি করে রেখেছে তা প্রশাসনকে খতিয়ে দেখতে হবে। খানির সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, কৃষকের সঙ্গে বসে সেচের নীতিমালা করা হয়নি বলে এমন ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনার দায় এড়াতে পারে না বিএমডিএ। কারণ, তারা কৃষককে সেচের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চাষাবাদে নামিয়ে পানি দিতে পারেনি। প্ররোচনার মামলায় বিএমডিএকেও অভিযুক্ত করা উচিত ছিল। এর সুযোগও ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের জেলার সভাপতি বিমল চন্দ্র রাজোয়াড় বলেন, আজ আমরা নিমঘুটু যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রবির মা বাড়িতে তালা দিয়ে অন্যত্র সরে গেলেন। অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রমও চলে যাচ্ছিলেন। আমরা তাকে থামিয়ে কথা বলেছি। তিনি ভয়ে থাকার কথা জানিয়েছেন। ভয় কারা দেখাচ্ছেন তাও ভয়ে বলতে চাননি তিনি।

এই মতবিনিময় সভা থেকে পরিবার দুটির নিরাপত্তা নিশ্চিত, দুই কৃষকের আত্মহত্যার প্ররোচনার বিচার নিশ্চিত, পানি কমিশন গঠন এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের বিনামূল্যে সেচ সুবিধা দেওয়ার দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে যত্রতত্র ভূ-গর্ভস্থ পানি তোলা বন্ধ করে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পানি দিয়ে কৃষকের সেচ সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।

উল্লেখ্য, বিএমডিএ’র গভীর নলকূপে দিনের পর দিন ঘুরেও বোরো ধানের খেতে পানি না পেয়ে গত মার্চে সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মারান্ডি ও তাঁর চাচাতো ভাই রবি মারান্ডি বিষপান করেন। এতে তাঁদের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় দুই পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় দুটি আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা করা হয়। বিভিন্ন মহল থেকে প্রথমে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হলেও শেষ পর্যন্ত পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে পানির জন্যই বিষপান করেছিলেন দুই কৃষক। পুলিশ বিএমডিএ’র গভীর নলকূপ অপারেটর ও ওয়ার্ড কৃষক লীগের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে। তিনি এখন কারাগারে।

Back to top button