বনজ সম্পদ কমে যাওয়ায় সাজেকে তীব্র খাদ্যসংকট
৬০৭ বর্গমাইল আয়তনের দেশের বৃহত্তম সাজেক ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার পরিবার চরম খাদ্য সংকটে রয়েছে। সেখানকার অধিকাংশ মানুষই বসবাস করেন দারিদ্র্যসীমার নিচে, আর জীবিকা হিসেবে একমাত্র অবলম্বন জুম চাষ দুর্গম পাহাড়ি গ্রামগুলোতে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যমও হাঁটাপথ। প্রতি বছরের বর্ষা মৌসুমের আগ থেকেই এসব এলাকায় স্থানীয় খাদ্যের সংকট বাড়তে থাকে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, হেডম্যান ও কার্বারীদের মতে, সাজেক ইউনিয়নের ৪০ থেকে ৪৫টি গ্রামে এই অবস্থা বিরাজ করছে। ১২০-১৩০ টাকা কেজি মুল্যে চাল বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে। দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা মানুষদের পক্ষে এতো চড়া মুল্যে চাল কিনে খাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বনজ সম্পদ কমে যাওয়ায় ভাতের বিকল্প হিসেবে বনজ খাদ্য আর আগের মতন সহজলভ্য নয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
কজতলী পাড়ার কার্বারী কালাচাঁন ত্রিপুরা জানান, মূলত সাজেক ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষই বনজ সম্পদ আহরণ ও জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। অনেক আগেই বনজ সম্পদ শেষ হয়ে গেছে। তাতে পানির উৎসও কমে যাচ্ছে ক্রমশ। জুমে ফলনও হয় না আগের মতো। ফলে জীবন নির্বাহের কঠিন এক সংগ্রামের দ্বারপ্রান্তে দুর্গম এলাকার বাসিন্দারা।
ইউপি সদস্য দেবজ্যোতি চাকমা বলেন, দেশ স্বাধীনের সাড়ে পাঁচ দশক পরও সাজেকে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি। বিদ্যুৎ- যোগাযোগ এবং স্যানিটেশনের মতো প্রয়োজনীয় বিষয়াদি এলাকাবাসীর কাছে এখনো স্বপ্নের মতো।
বাঘাইহাট বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সংবাদকর্মীদের জানান, সাজেকে তিনটি বাজারেই এখন ক্রেতা শূন্যতা বিরাজ করছে। কারণ দুর্গম এলাকার মানুষরা বেশ কয়েক বছর ধরেই জুমে ভালো ফলন পাচ্ছেন না। অপরদিকে যোগাযোগ দুর্গমতার কারণে উৎপাদিত যৎসামান্য পণ্যও হাটে-বাজারে আনতে পারছেন না। ফলে পণ্য বিণিময়ের যে প্রথা ছিল সেটিও অচল হয়ে পড়ায় সীমাহীন অর্থ সংকটে পড়েছেন দুর্গম এলাকার প্রান্তিক মানুষরা।
মাচলং বাজারের ব্যবসায়ী মো. ইমরান জানান, যেখানে প্রতি সপ্তাহে শুধু তাঁর দোকান থেকেই ৩০ বস্তা চাল বিক্রি হতো, সেখানে এখন ব্যবসা-বাণিজ্যে রীতিমতো ভাটা পড়েছে।
অরুণ কান্তি চাকমা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘আলো’র নির্বাহী পরিচালক। একই সাথে তিনি সাজেকের রুইলুইয়ে বেসরকারি পর্যায়ে প্রথম রিসোর্ট নির্মাতাও। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সাজেকে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে দাবি করেন, সাময়িক কোন রেশনিং দিয়ে এই সমস্যার সমাধান মিলবে না। কারণ, বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাসরত প্রান্তিক মানুষদের জীবন-সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ন কৌশল ছাড়া রাতারাতি কোন পরিবর্তন কল্পনা করা যাবে না।
তিনি এই সমস্যার সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে এলাকার মানুষদের স্থায়িত্বশীল ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, এসব এলাকায় কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা গেলে ভালো। তাছাড়া বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ অবকাঠামোও জরুরি।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তাজুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দুর্গম এলাকার খাদ্য সংকটের বিষয়ে আমাকে জানিয়েছেন। এবিষয়ে আমি জেলা প্রশাসক স্যারকে জানিয়েছি। ইতিমধ্যে জরুরি ভিত্তিতে উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিজস্ব চাঁদা তুলে চার মেট্রিক টনেরও বেশি চাল দেওয়া হয়েছে।
বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বড় ঋষি চাকমা বলেন, সাজেকের খাদ্যাভাব সর্ম্পকে আমাকে সাজেকের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন এবং এ বিষয়ে আমি জেলা প্রশাসন ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়েছি। আশা করছি দ্রুত সরকারি সাহায্য এসে পৌঁছাবে আপনাদের খাদ্যাভাব কিছুটা হলেও লাঘব হবে।
বড়ঋষি চাকমা দাবি করেন, দুর্গম এলাকার জুম চাষিদের আগের তুলনায় ফসলের ফলন অর্ধেক কমে এসেছে। জুমের ফলন কম ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া ওই সব এলাকায় এখন ৮০ টাকা ধরেও চাল পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু সাজেক ইউনিয়ন নয়, বিভিন্ন ইউনিয়নে দুর্গম এলাকা বসবাসরতদের চরম খাদ্য সংকট চলছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে।