পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত করতে শাসকগোষ্ঠীর গোয়েবলসীয় অপপ্রচার ও তথ্য সন্ত্রাসঃ মঙ্গল কুমার চাকমা
![](https://ipnewsbd.net/wp-content/uploads/2017/03/mm-1-1.jpg)
সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, জুম্ম জনগোষ্ঠী, জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলন ও আন্দোলনরত সংগঠনগুলো সম্পর্কে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও সংস্থা এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক একতরফা, বিকৃত, খণ্ডিত, সাজানো ও কল্পিত অপপ্রচার জোরদার করা হয়েছে। অপরদিকে সংবাদ প্রকাশে বাধা-নিষেধ, অপপ্রচারনায় ভাড়াটে সাংবাদিক এবং ভূঁইফোড় স্থানীয় প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকা চালুকরণ, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ভিত্তিহীন ইতিহাস অবতারনা করে, সাম্প্রদায়িক উস্কানী দিয়ে এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের ধোঁয়া তুলে ঘৃণ্য তথ্য সন্ত্রাসে এসব গোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠেছে যা জার্মান স্বৈরশাসক হিটলারের প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলসকেও হার মানায়।
এই অপপ্রচার ও তথ্য সন্ত্রাসের সর্বশেষ সাড়াশি উদ্যোগ হলো ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের শেষান্তে ও ২০১৭ সালের জানুয়ারির প্রথমার্র্ধে ইনকিলাব, মানবজমিন, জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক ইত্যাদি জাতীয় দৈনিকসহ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের ভূঁইফোড় প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধারাবাহিক সংবাদ প্রতিবেদন একযোগে প্রচার ও প্রকাশ করা। ‘পাহাড়ে অশান্তির আগুন’, ‘পাহাড় থেকে আসা অত্যাধুনিক অস্ত্র জঙ্গিদের হাতে’, ‘শান্তির পাহাড়ে হঠাৎ লু হাওয়া, জুম্মল্যা- গড়ার স্বপ্ন!’, ‘ভূমি কমিশন আইনে সংশোধনী নিয়ে উত্তপ্ত পার্বত্যাঞ্চল’, ‘ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে ৩ গ্রুপের ১৮শ’ সন্ত্রাসী, চলছে নীরব চাঁদাবাজি, জিম্মি সাধারণ মানুষ’, ‘পার্বত্য জেলায় পাহাড়ী ও বাঙালীদের ভেতর ক্রমেই অবিশ্বাস বাড়ছে’ ইত্যাদি ভীতি সঞ্চারকারী শিরোনামে বানোয়াট ও অতিরঞ্জিত সংবাদ পরিবেশন করে দেশবাসীকে আতঙ্কিত করে তুলছে এবং জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে উস্কে দিচ্ছে। পত্রিকায় এমনভাবে বলা হয়েছে যে, ‘পার্বত্য তিন জেলা যেন অন্য এক জগৎ’।
এই তথ্য সন্ত্রাস ও অপপ্রচারনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর একটি মহল, গোয়েন্দা সংস্থা, আমলাতন্ত্র, হলুদ সংবাদকর্মী, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, তথাকথিত সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধীতাকারী থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দল, কতিপয় জাতীয় রাজনৈতিক দল, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় কায়েমী স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন মহল সম্পৃক্ত রয়েছে। কতেক ক্ষেত্রে এসব পক্ষসমূহ বাহ্যত পরষ্পর বিরোধী মনে হলেও এই অপপ্রচারনা ও তথ্য সন্ত্রাসে তারা কার্যত একসূত্রে গাঁথা ও অদৃশ্য সূতায় আতাঁতবদ্ধ। বিশেষ করে দক্ষিণপন্থী বিভিন্ন জাতীয় রাজনৈতিক দল ও তাদের অনুসারী তথাকথিত নাগরিক সংগঠন জাতীয় পর্যায়ে অহি-নকুল সম্পর্ক হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ও চুক্তি বিরোধী গোয়েবলসীয় অপপ্রচারনা ও তৎপরতায় এক কাতারে পরষ্পর সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকে।
এই অপপ্রচারনা ও তথ্য সন্ত্রাসের মূল লক্ষ্য হলো জুম্ম জনগণের চলমান পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ন্যায্য আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবে চিহ্নিত করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা, চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে দেশ-বিদেশের জনমতকে বিভ্রান্ত করা, জুম্ম জনগণের উপর চলমান দমন-পীড়নকে ধামাচাপা দেয়া, সরকারের চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রমকে জায়েস করা, এবং চূড়ান্তভাবে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী হিসেবে অপপ্রচার
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের দীর্ঘ ১৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। সুদীর্ঘ ১৯ বছরের মধ্যে চারটি রাজনৈতিক সরকার ও দুইটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার- মোট ছয়টি সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসলেও কোন সরকারই চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসেনি। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ২০০৯ সাল থেকে আজ অবধি প্রায় ৮ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অপরদিকে উন্নয়নের নামে ও চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে জুম্ম জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে জুম্ম স্বার্থ বিরোধী ও চুক্তি-পরিপন্থী বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিতে থাকে এবং আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে দমন-পীড়নের মাধ্যমে এসব কার্যক্রম জোরপূর্বক বাস্তবায়ন করে চলেছে।
দীর্ঘ ৮ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায়, পক্ষান্তরে সরকারের চুক্তি-পরিপন্থী ও জুম্ম স্বার্থ-বিরোধী কার্যক্রমের ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি জুম্ম জনগণের চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ পূঞ্জীভূত হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর প্রতি সাধারণ মানুষ হয়েছে চরম অতিষ্ঠ ও বিক্ষুব্ধ। সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন-২০১৬-এর সময় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা সেটা বুঝতে পেরে দলীয় নৌকা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস না করার কারণে দলীয় প্রতীক (নৌকা মার্কা) নিয়ে অনেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী ছিলেন না।
এই ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দিতে তথা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ রাঙ্গামাটি জেলাধীন বিভিন্ন ইউনিয়নে ‘সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে’ আওয়ামীলীগের অনেক প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিতে না পারার ষড়যন্ত্রমূলক ও ভিত্তিহীন অজুহাত তুলে ধরে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার হীন উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস বন্ধ এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের অজুহাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ গত ২৪ মার্চ ২০১৬ রাঙামাটি শহরে এক তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের আয়োজন করে। সেনাবাহিনী, বিজিবি, গোয়েন্দাবাহিনী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সহযোগিতায় ক্ষমতাসীন দল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্দোলনরত জনসংহতি সমিতি ও অধিকার কর্মীদেরকে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী, অপহরণকারী, খুনী, ধর্ষণকারী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, চোরাকারবারী হিসেবে চিহ্নিত করতে গোয়েবলসীয় অপপ্রচার শুরু করে। ভাড়াটে, সাম্প্রদায়িক, সুযোগসন্ধানী ও হলুদ সংবাদকর্মীদের দিয়ে ইনকিলাব, মানবজমিন, জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক ইত্যাদি জাতীয় দৈনিকসহ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের ভূঁইফোড় প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও কল্পিত সংবাদ প্রচার করতে থাকে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘পাহাড়ে অশান্তির আগুন’ শিরোনামে দৈনিক ইনকিলাবে ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত জনৈক ফারুক হোসাইনের প্রতিবেদনে এমন ভীতি সঞ্চারকারী পরিস্থিতি বর্ণনা করে বলা হয় যে, “আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানিসহ এমন কোন অপরাধ নেই যার সাথে তারা জড়িত নয়। …ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও সেখানে পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে অসহায়। বাদ পড়ছে না সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও আনসার সদস্যরাও।” এই সংবাদ যে কত অতিরঞ্জিত, বানোয়াট, কল্পনা প্রসূত তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ভীতিকর পরিস্থিতি সাজাতে গিয়ে এবং জুম্মদের আন্দোলনরত সংগঠনগুলোকে বর্বর সন্ত্রাসী ও ভয়ংকর অপরাধী হিসেবে অতিরঞ্জন করতে গিয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও আনসার সদস্যদেরকেও অসহায় হিসেবে সংবাদে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা এসব বাহিনীর জন্য অপমানজনকও বটে। বাহ্যত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচারনা চালানো হলেও তার অন্তরালে মূল টার্গেট হলো আপামর দেশবাসীর কাছে জুম্ম জনগোষ্ঠীকে বর্বর, বন্য, অসভ্য, ভয়ংকর, উচ্ছৃঙ্খল হিসেবে উপস্থাপন করা এবং অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের ন্যায্য আন্দোলনকে সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যক্রম হিসেবে তুলে ধরা।
‘পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা’ নয়, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোই ছড়াচ্ছে অশান্তির আগুন
“রাতের অন্ধকারে চিৎকার শুনলেই অজানা আতঙ্কে আঁতকে উঠেন পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিরা। কেউ বুঝি প্রাণ হারালো পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে। আবারও বুঝি ধর্ষণের শিকার হলো কোন নিরীহ নারী-শিশু। চাঁদা না দেয়ায় হয়তো পুড়ে গেল কোনো পরিবারের কপাল। …মেয়েদের তুলে নিয়ে করা হচ্ছে ধর্ষণ” (পাহাড়ে অশান্তির আগুন, ইনকিলাব, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬) গোয়েবলসীয় কায়দায় এভাবে অপপ্রচার চালানো হলেও প্রকৃত সত্য তার সম্পূর্ণ বিপরীত। বরঞ্চ সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও সেটেলার বাঙালিদের অত্যাচারে জুম্মদের জীবন চরমভাবে অতিষ্ঠ ও ক্রমাগত বিপন্ন হয়ে পড়ছে। রাত-বিরাতে সেনা-বিজিবি-পুলিশ তল্লাসী অভিযানের নামে কখন কোন জুম্মকে তুলে নিয়ে যায় এবং মধ্যযুগীয় কায়দায় মারধর করে পঙ্গু করে দেয় সেরূপ এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় জুম্মদের দিনাতিপাত করতে হয়। নিজেদের বাস্তুভিটা, বাগান-বাগিচা, চাষাযোগ্য জমি কখন কোন মুহুর্তে সেটেলার বাঙালিরা বেদখল করে নেয় কিংবা রাতের আধারে কখন সেটেলারদের সারি সারি ঘর নির্মিত হয়ে যায় এমন শঙ্কার মধ্যে থাকতে হয় জুম্মদের। সারাক্ষণই আতঙ্কে থাকতে হয় কখন কোন মুহুর্তে সেটেলার বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কর্তৃক কোন জুম্ম নারী, শিশু ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়। জুম্মদের উপর এই শ্বাসরুদ্ধকর অরাজক পরিস্থিতি চাপিয়ে দিয়েছে বা ‘পাহাড়ে এই অশান্তির আগুন’ ছড়িয়ে দিচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী, সরকারি প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা। এভাবে দেশের ৬১ জেলার বাইরে তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদেরকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিগত ৪৬ বছর ধরে সেনাশাসন এবং শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়নের মধ্যে এক নিরাপত্তাহীন শ্বাসরুদ্ধকর জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের পরিবর্তে জুম্মদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের অংশ হিসেবে সাম্প্রদায়িক হামলা, আক্রমন, ভূমি বেদখল, স্বভূমি থেকে উৎখাত, বহিরাগত অনুপ্রবেশ, চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলছে। সন্ত্রাসী তল্লাসীর নামে নির্বিচারে ধর-পাকড়, মধ্যযুগীয় কায়দায় মারধর, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলায় জড়িত করে জেল-হাজতে প্রেরণ, জুম্মদের ঘরবাড়ি তল্লাশী ও ভাঙচুর ইত্যাদি মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। কেবল ২০১৬ সালে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রায় শ’ খানেক নিরপরাধ জুম্মদেরকে অবৈধভাবে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে, নব্বই জনের অধিক লোককে আটক করে নির্যাতন করেছে এবং মিথ্যা মামলা দায়ের করে কেবল বান্দরবান জেলায় প্রায় দেড় শতাধিক লোককে এলাকাছাড়া করেছে। সেনা ক্যাম্প থেকে প্রকাশ্যে জানিয়ে দেয়া হয় যে, সেনাশাসনের বিরুদ্ধে টু শব্দও করা যাবে না; করলেই নির্যাতন অবধারিত। এভাবে সেনাবাহিনী কর্তৃক অবাধ নিপীড়ন-নির্যাতন ও যত্রতত্র অবৈধ গ্রেফতারের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়া এবং জনগণকে আতঙ্কের মধ্যে রাখা হচ্ছে।
জুম্মল্যাণ্ড, পৃথক পতাকা, মুদ্রা ও স্বায়ত্তশাসিত সরকার সম্পর্কে অপপ্রচার
জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের ন্যায্য আন্দোলনকে সন্ত্রাস হিসেবে চিত্রিত করার ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের শেষ নেই, দেশে-বিদেশে এই আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী আন্দোলন হিসেবে পরিচিহ্নিত করার জন্য তারা নানা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। ১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের সময় জামাত-বিএনপি ও মৌলবাদী গোষ্ঠী চুক্তি সম্পাদিত হলে যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে বলে প্রচারণা চালিয়েছিল ঠিক সেভাবে দেশে-বিদেশে মুসলিম সম্প্রদায়কে ধর্মীয় সুরসুরি দিয়ে উস্কে দেয়ার হীনলক্ষ্যে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ষড়যন্ত্রে দক্ষিণ সুদান ও পূর্ব তিমুরের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি খ্রীস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তিহীন ও বানোয়াট প্রতিবেদন প্রচার করছে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনী, ক্ষমতাসীনদের অনেক ব্যক্তি। মৌলবাদীদের অপপ্রচার প্রতিধ্বনিত করে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু ২০১৬ সালের মার্চে জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘পার্বত্যাঞ্চলকে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সন্তু লারমা।’ এই অপপ্রচারের অংশ হিসেবে দৈনিক মানবজমিনে ‘পাহাড়ে সামরিক কাঠামো তৈরি করে সশস্ত্র সংগঠনের দাপট’ শিরোনামে গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬ জনৈক কাজী সোহাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, “তাদের রয়েছে নিজস্ব সেনাপ্রধান, আলাদা আলাদা কোম্পানী, …কাঁধে চকচকে ভারি ও দামি অস্ত্র। এ রকম প্রায় ১৮শ’ সদস্য রয়েছে পার্বত্য জেলাগুলোতে। তারা প্রত্যেকেই প্রশিক্ষণ পাওয়া দক্ষ ও ক্ষিপ্র। …তাদের রয়েছে নিজস্ব পরিচয়পত্র, মুদ্রা ও পতাকা। পাহাড়ে জুম্মল্যা- ও স্বায়ত্তশাসিত সরকার গঠনকে টার্গেট করে নীরবে সশস্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছে এই সশস্ত্র সংগঠনগুলো।”
বাক্য গঠনে ও শব্দ চয়নে সামান্য হেরফের করে একই ধরনের সংবাদ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে দৈনিক জনকণ্ঠে ‘শান্তির পাহাড়ে হঠাৎ লু হাওয়া, জুম্মল্যা- গড়ার স্বপ্ন!’ শিরোনামে, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে দৈনিক ইনকিলাবে ‘পাহাড়ে অশান্তির আগুন’ শিরোনামে, ৪ জানুযারি ২০১৭ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকে ‘ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে ৩ গ্রুপের সন্ত্রাসী, চলছে নীরব চাঁদাবাজি, জিম্মি সাধারণ মানুষ’ শিরোনামে, ১৭ জুলাই ২০১৬ আমাদের সময়.কম-এ ‘পাহাড়ে নানা কৌশলে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বিচ্ছিন্নতাবাদ’ শিরোনামে এবং ‘বাংলাদেশ সামরিক প্রতিরক্ষা-বিএমডি’ নামক ফেসবুক পেজ-সহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়। যদিও সংবাদের প্রারম্ভে ‘পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে’ বা ‘রাঙ্গামাটি/খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে’ উল্লেখ করা হলেও এ সকল সংবাদের একমাত্র সূত্র হচ্ছে ‘গোয়েন্দা সংস্থা’, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী’, ‘নিরাপত্তা বাহিনী’ ও ‘স্থানীয় সূত্র’-এর প্রতিবেদন বা বয়ান। এসব সংবাদে খাগড়াছড়ি জেলার পুলিশ সুপার আব্দুল মজিদ, রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপার সাঈদ তরিকুল, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহেদুজ্জামান, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরীর বরাত দিয়ে ইতর বিশেষ হেরফের করে একই বক্তব্য বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানো হয়। এ থেকে বুঝা যায়, এসব সংবাদগুলোর তথ্য একই উৎস থেকে সংগৃহীত হয়েছে এবং সুদূর প্রসারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই গোয়েবলসীয় কায়দায় অপপ্রচারের জন্য এসব সংবাদগুলো একটা নিদিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয়েছে।
বলা বাহুল্য, জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে সত্তর-আশি-নব্বই দশকে জুম্ম জনগণের সশন্ত্র আন্দোলন চললেও জনসংহতি সমিতি বা জুম্ম জনগণ কখনোই স্বাধীনতা দাবি করেনি বা স্বাধীনতার দাবি তুলে জুম্মল্যা-, জুম্মল্যাণ্ডের জন্য পতাকা ও মুদ্রা প্রচলন করেনি। বরঞ্চ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন বা আইন পরিষদ সম্বলিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও সংবিধানের আওতায় ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের দাবি জানিয়েছিল। তারই আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান রেখে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি-উত্তর সময়ে জুম্ম জনগণের আন্দোলনের মূল কর্মসূচি হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। জুম্ম জনগণের কোন সংগঠন থেকে বা রাজনৈতিক দল থেকে কেউ পৃথক জুম্মল্যা- গঠন, পৃথক পতাকা ও মুদ্রা প্রচলনের কর্মসূচি তুলে ধরেনি। এ ধরনের গুজব ও ভিত্তিহীন অভিযোগ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত ও ষড়যন্ত্রমূলক।
বলাবাহুল্য, বর্তমান অবাধ তথ্য প্রযুক্তি যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নামে-বেনামে নানা জনে সত্য-মিথ্যা নানা সংবাদ প্রচার করে থাকে, যেটা ফেসবুক কর্তৃপক্ষও স্বীকার করে তা মোকাবেলার জন্য নানা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে অতি উৎসাহী ব্যক্তি ‘পৃথক জুম্মল্যা- গঠন, পৃথক পতাকা ও মুদ্রা প্রচলনের’ মতো গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়াতে পারে তা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ‘গোয়েন্দা সংস্থা’, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী’, ‘নিরাপত্তা বাহিনী’গুলো সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে কেন এ ধরনের গুজবকে ভিত্তি করে অপপ্রচারে মরিয়া হয়ে উঠবে? বস্তুত তারা দেশের অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা ইত্যাদি দোহাই দিলেও এধরনের গুজবকে ভিত্তি করে গোয়েন্দা প্রতিবেদন সরবরাহ পূর্র্বক সংবাদ মাধ্যমে প্রচারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশবাসীর কাছে জুম্ম জনগণকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বা স্বাধীনতাপন্থী হিসেবে তুলে ধরে জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে উস্কে দেয়া; আরো যদি সংকীর্ণ অর্থে বলতে গেলে তাহলে বলতে হয় যে, জুম্মদের বিরুদ্ধে সাধারণ বাঙালিদেরকে উত্তেজিত করে তোলা।
এভাবে আজ শাসকশ্রেণি তথা রাষ্টযন্ত্রের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ, সংস্থা ও বাহিনীগুলো আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর নাম ভাঙিয়ে কার্যত জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও তথ্য সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু রাষ্ট্রশক্তি তাদের হাতে রয়েছে, আইন-আদালত তাদের নিয়ন্ত্রণে, অধিকাংশ প্রচারমাধ্যম তাদের কাছে করতলগত, কাজেই তারা এই প্রচারযুদ্ধ একচেটিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে এবং দেশবাসীকে একতরফা, বিকৃত, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলো পৌঁছে দিয়ে চলেছে যা প্রত্যক্ষভাবে দেশের জঙ্গী, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক ও উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে পুরিপুষ্ট করে তুলছে। জুম্ম জনগণ যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব ও সংবিধানের অধীনে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দেশের নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য গণতান্ত্রিক উপায়ে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে সেখানে এসব অপপ্রচার চালিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলো জুম্ম জনগণকে আরো দূরে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে চলেছে বলে বলা যেতে পারে।
এই অপপ্রচারে মাঠপর্যায়ে কৃত্রিম ভিত্তি তৈরি করতে প্রায় সময়ই জুম্মল্যা-ের পতাকা নিয়ে বা নানা ধরনের ভিত্তিহীন গুজবের খোঁজখবর ও তথ্য নিয়ে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে তৎপর হতে দেখা যায় যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও ভীতিকরও বটে। এ থেকে এটা বললে অত্যুক্তি হওয়ার কথা নয় যে, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিংবা জনমনে ‘পৃথক জুম্মল্যা- গঠন, পৃথক পতাকা ও মুদ্রা প্রচলনের’ মতো গুজবগুলো এসব ‘গোয়েন্দা সংস্থা’, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী’, ‘নিরাপত্তা বাহিনী’গুলোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রকারান্তরে প্রচার করে যাচ্ছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাহাড়ির নামে বাঙালিদের বা বাঙালির নামে পাহাড়িদের যে ধরনের বেনামী একাউন্টের ছড়াছড়ি রয়েছে বলে অনুমান করা হয় তা থেকে এই সন্দেহ কখনোই উড়িয়ে দেয়া যায় না। এর পেছনে মূল উদ্দেশ্যই হলো গুজব ছড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিতে অস্থিতিশীল করে তোলা এবং তাতে এসব কায়েমী গোষ্ঠী কর্তৃক ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা।
অস্ত্র ভাণ্ডার ও সশস্ত্র গ্রুপ সম্পর্কে অপপ্রচার
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত রাজনৈতিক দল ও কর্মীদেরকে অস্ত্রধারী ও সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করতে শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে অত্যাধুনিক অস্ত্র ভাণ্ডার ও সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যদের বিপুল সংখ্যা দেখিয়ে গোয়েবলসীয় অপপ্রচারে নেমেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ‘পাহাড়ে অশান্তির আগুন’ শিরোনামে দৈনিক ইনকিলাবে বলা হয় যে, “পার্বত্য এলাকায় অবৈধ অস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তুলেছে সন্ত্রাসীরা। …দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নেই এমন অত্যাধুনিক মডেলে অস্ত্রও পাওয়া যাচ্ছে সন্ত্রাসীদের কাছে। …শুধু রাঙামাটিতে অত্যাধুনিক অবৈধ অস্ত্র রয়েছে ৮শ’ থেকে ৯শ’ এবং খাগড়াছড়িতে এই সংখ্যা সাড়ে ৫শ’ থেকে ৬শ’।” ৪ জানুয়ারি ২০১৭ ‘ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে ৩ গ্রুপের ১৮শ’ সন্ত্রাসী’ শিরোনামে দৈনিক ইত্তেফাকে গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে বলা হয় যে, “এই তিন গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৮শ’। …এর মধ্যে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের রয়েছে প্রায় ৯শ’ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী। তাদের অধীনে রয়েছে সামরিক কায়দায় ৬টি কোম্পানি। জেএসএস (সংস্কার) এর রয়েছে ২টি কোম্পানি। তাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীর সংখ্যা প্রায় পৌনে ৩শ’। আর ইউপিডিএফ এর ৪টি কোম্পানির অধীনে রয়েছে প্রায় ৭শ’ সশস্ত্র সদস্য।” দৈনিক ইনকিলাবের ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬ সংখ্যায় বলা হয়, “পার্বত্য অঞ্চলে জেএসএস ও ইউপিডিএফের ১০ হাজারের বেশি সন্ত্রাসী সক্রিয় রয়েছে।”
পার্বত্য চট্টগ্রামে সশন্ত্র গ্রুপের উপস্থিতি সম্পর্কে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ভাণ্ডার ও বিপুল সশস্ত্র সদস্য সংখ্যা নিয়ে প্রচারনা চালানো হচ্ছে তা বাস্তবতা ও প্রকৃত সত্যের অপলাপ বৈ কিছু নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তি পক্ষ-বিপক্ষ কিছু সশস্ত্র গ্রুপ বিদ্যমান থাকলেও গোয়েন্দা, আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর বরাত দিয়ে উপরোল্লেখিত জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত অস্ত্র ভাণ্ডারের পরিমাণ ও সশস্ত্র সদস্যদের সংখ্যার তুলনায় নিতান্তই গৌণ। এই সশস্ত্র গ্রুপের গঠন ও উত্থানের পেছনেও রয়েছে শাসকগোষ্ঠী তথা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রভাবশালী মহলের ষড়যন্ত্র ও মদদ। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের প্রাক্কালে চুক্তি বিরোধী গ্রুপ কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল, কার মদদে ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নস্যাৎ করার সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি প্রভাবশালী মহলের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে ও পৃষ্ঠপোষকতায় সেদিন এই চুক্তি বিরোধী গ্রুপের উত্থান ঘটেছিল। শাসকগোষ্ঠীর মদদ ছিল বলেই ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ সালে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে জনসংহতি সমিতির অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানে চুক্তি বিরোধী পোষ্টার, প্লেকার্ড, ফেস্টুনের লম্বা বাঁশ ও লাঠি নিয়ে এই চুক্তি বিরোধী গ্যাং ঢুকতে সক্ষম হয়েছিল। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রীপরিষদের সদস্য, বিদেশী কূটনীতিক ও উচ্চপদস্ত সামরিক-বেসামিক কর্মকর্তাদের স্বার্থে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল, কয়েকটি নিরাপত্তা তল্লাসী পেরিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকতে হতো, আগাম তালিকাভুক্তি ব্যতীত কারোরই প্রবেশ করার সুযোগই ছিল না, সেখানে কিভাবে চুক্তি বিরোধী গ্যাং দলবদ্ধভাবে দৃশ্যমান বিপুল সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকেছিল তা ভেবে দেখলেই বুঝা যায় সেখানে নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, স্থানীয় প্রশাসনসহ শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন মহল প্রত্যক্ষ ও গভীরভাবে জড়িত ছিল। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সেই চুক্তি বিরোধী গ্যাং অস্ত্র সংগ্রহ করে অবাধে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে এবং নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় জনসংহতি সমিতির সদস্যসহ চুক্তি পক্ষীয় লোকজনের উপর সশস্ত্র হামলা করতে থাকে। শুধু তাই নয়, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা ও অফিস-আদালতের সন্নিকটস্থ স্থানে একপ্রকার নিরাপত্তা দিয়ে তাদেরকে অবাধে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা ইত্যাদি সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এই সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টির পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র গ্রুপের তৎপরতা দেখিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে বৈধতা দেয়া, অপরদিকে এই সশস্ত্র গ্রুপকে দিয়ে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করা।
জনসংহতি সমিতির তরফ থেকে সরকারকে বার বার বলা সত্ত্বেও এই চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি। ফলে নিজেদের জীবন বাঁচাতে ও আত্মরক্ষার স্বার্থে কতিপয় ব্যক্তি চুক্তি বিরোধী গ্রুপের সশস্ত্র হামলা প্রতিরোধ করতে বিভিন্ন এলাকায় প্রতিপক্ষ সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে তুলে। এসব সশস্ত্র গ্রুপগুলো চুক্তি বিরোধী গ্রুপের বিরোধী বলেই তাদেরকে চুক্তি পক্ষীয় সশস্ত্র গ্রুপ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে এসব গ্রুপগুলোকে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র গ্রুপ হিসেবে অপপ্রচার চালানো হয়। বস্তুত জনসংহতি সমিতি এসব সশস্ত্র গ্রুপের সাথে কোন সংশ্লিষ্টতা নেই, জড়িত থাকার প্রশ্নই উঠে না। অপরদিকে তথাকথিত চুক্তি পক্ষীয় সশস্ত্র গ্রপের প্রতিরোধের ফলে একপর্যায়ে চুক্তি বিরোধী গ্রুপ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা মহল থেকে এ গ্রুপকে মদদ দিয়ে তাদেরকে আবার শক্তিশালী করা হয়। ২০০৭-২০০৮ সালে দেশে জরুরী অবস্থা চলাকালে কার মদদে ও সমর্র্থনে জাতীয় পর্যায়ে ও পার্বত্য চট্টগ্রামে সংস্কারপন্থীদের উত্থান ঘটেছে তা এখানে না বলাই শ্রেয়। শাসকগোষ্ঠীর এই ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত রয়েছে; বলা যায় বর্তমান সময়ে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সুযোগে আরো জোরদার হয়েছে।
এভাবেই আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র গ্রুপের উত্থান ও তৎপরতার পেছনে মূখ্যত শাসক মহলই দায়ী বলে নি:সন্দেহে বলা যেতে পারে। অথচ আজ সেই শাসক মহল তথা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রভাবশালী গোষ্ঠী এই সশস্ত্র তৎপরতার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত রাজনৈতিক দল ও কর্মীদেরকে জড়িত করে অস্ত্রধারী ও সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করার ষড়যন্ত্র চালাতে মরিয়া হয়ে পড়েছে। অনেকটা ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ এর মতো।
উল্লেখ্য যে, এসব সশস্ত্র গ্রুপগুলো জুম্মদের মধ্যকার অন্তর্কোন্দলের ফলে সৃষ্টি এবং তাদের তৎপরতা মুখ্যত ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। স্বাধীন জুম্মল্যা- গঠনের কর্মসূচি তুলে ধরতে তাদেরকে কখনোই শোনা যায়নি। তবে এটা ঠিক যে, তাদের সেই অন্তর্ঘাতি সশস্ত্র তৎপরতা পার্বত্যাঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলার জন্য উদ্বেগজনক ও ক্ষতিকরও বটে। বলাবাহুল্য, পার্বত্যাঞ্চলের এই সশস্ত্র তৎপরতা মোকাবেলা করতে হবে রাজনৈতিকভাবে। পার্বত্য চট্টগ্রমের সমস্যা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা। এই সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে জাতীয়ভাবে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে এবং চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার জন্য চুক্তি বিরোধী গোষ্ঠীসমূহকে মদদ প্রদানসহ শাসকগোষ্ঠীর নানা মহলের নানামুখী ষড়যন্ত্রের ফলে জুম্ম জনগণের মধ্যে চরম হতাশা, ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। জুম্ম জনগণের এই হতাশা, ক্ষোভ ও অসন্তোষকে পূঁজি করেই চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ গ্রুপগুলো তাদের নানামুখী কার্যক্রম পরিচালিত করার ক্ষেত্র খুঁজে পাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই জুম্ম জনগণের এই হতাশা, ক্ষোভ ও অসন্তোষকে দূরীভূত করতে হবে এবং তার মাধ্যমেই সশস্ত্র গ্রুপগুলোর তৎপরতাকে মোকাবেলা করতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান যেমনি নিহিত রয়েছে তেমনি নিহিত রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র তৎপরতার অবসান। চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষের সংঘাত দ্রুত নিরসন হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
চাঁদাবাজি বনাম দুর্নীতি ও টেণ্ডারবাজি
‘তিন পার্বত্য জেলায় সশস্ত্র সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ’ এ ধরনের অপপ্রচারে আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল সরব রয়েছে। ২৯ ডিনেম্বর ২০১৬ দৈনিক মানবজমিনে ‘পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠনের চাঁদাবাজির রাজত্ব’ শীর্ষক সংবাদে “বছরে এ তিন জেলায় শুধু চাঁদা তোলা হয় ৪০ কোটি ২৯ লাখ ১৬ হাজার টাকা” বলে উল্লেখ করা হয়। উক্ত সংবাদে “বিভিন্ন খাত ছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, জুম্ম জাতীয় নেতার মৃত্যু দিবস, মাতৃভাষা দিবস, দলের কাউন্সিল, বৈসাবি/বিজু/সাংগ্রাই, পূজা, বৌদ্ধ পুর্ণিমা, বৌদ্ধ বিহার/মন্দির, কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান ইত্যাদির নামে” নামে চাঁদাবাজি হয় বলে উল্লেখ করা হয়। চাঁদাবাজির পরিমাণ আরো অনেকগুণ বাড়িয়ে ১ জানুয়ারি ২০১৭ দৈনিক জনকণ্ঠে বলা হয় যে, “প্রতিদিনই পার্বত্য অঞ্চল থেকে সশস্ত্র উপজাতি গ্রুপগুলো এক থেকে দেড় কোটি টাকার চাঁদা আদায় করছে।”
এটা বলার সুযোগ নেই যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে নানাভাবে চাঁদাবাজি হচ্ছে না। তবে যে হিসেবে চাঁদাবাজি নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল অপপ্রচার চালাচ্ছে তা প্রকৃত পরিস্থিতির তুলনায় অতিরঞ্জিত। এই চাঁদাবাজির সাথে আন্দোলনরত সংগঠন ও কর্মীদেরকে জড়িত করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অপপ্রচার চালানোর পেছনে মূল উদ্দেশ্যই হলো জনসংহতি সমিতিসহ আন্দোলনরত সংগঠন ও কর্মীদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিহ্নিত করা এবং তাদের উপর দমন-পীড়ন বৈধতা প্রদান করা। উল্লেখ্য যে, ‘…বিজু/সাংগ্রাই, পূজা, বৌদ্ধ পুর্ণিমা, বৌদ্ধ বিহার/মন্দির, কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান ইত্যাদি’ সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য জনগণের স্বেচ্ছায় দেয়া এককালীনও চাঁদাবাজি হিসেবে আখ্যায়িত করছে যার অন্যতম লক্ষ্য হলো জুম্মদেরকে এসব সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনেও বাধা সৃষ্টি করা। অথচ বিভিন্ন মসজিদ/মাদ্রাসার জন্য গাড়ি আটকিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে মাইক বাজিয়ে রাস্তা-ঘাটে চাঁদা তোলা হলেও তা চাঁদাবাজি হিসেবে গণ্য করতে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী বা প্রশাসনকে দেখা যায়নি।
আরো উল্লেখ্য যে, আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল চাঁদাবাজি নিয়ে সরব থাকলেও তিন পার্বত্য জেলায় সীমাহীন দুর্নীতি, প্রকল্প আত্মসাৎ, টে-ারবাজি, দুর্বৃত্তায়ন ও দলীয়করণ সম্পর্কে একেবারেই নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিন পার্বত্য জেলায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে একটি পদের বিপরীতে ৮ থেকে ১২ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়ে থাকে। ২০১৫-১৬ সালে তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় হাজার খানেক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। প্রতিটি পদে গড়ে ৫ লক্ষ টাকা ধরলে এক হাজার পদের বরাতে ৫০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে যা শাসকশ্রেণির সাথে যুক্ত লোকদের পকেটে চলে যায়। বর্তমান সরকারের আমলে তিন পার্বত্য জেলায় অর্থের অভাবে খেটেখাওয়া গরীব মানুষের পক্ষে চাকরি পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব। বর্তমানে কনস্টেবল পদে নিয়োগ পেতে কমপক্ষে ৫/৬ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়। পুলিশ নিয়োগেও তিন পার্বত্য জেলায় কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয়ে থাকে। টেণ্ডারবাজি, প্রকল্প আত্মসাৎ, খাদ্যশস্য বাবদে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি ও অনিয়ম তো রয়েছেই। ছাত্রলীগ-যুবলীগের রয়েছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি, যার সংবাদগুলো প্রচ্ছন্ন বাধা-নিষেধের মুখেও মাঝেমধ্যে পত্রিকায় চলে আসে। আর রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সম্পদ গাছ-বাঁশ পাচারে শতকোটি টাকার অনিয়ম ও লেনদেন। এই অনিয়মে আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল জড়িত বলে এ বিষয়ে তারা একেবারেই জেনেও না জানার ভান করে থাকে। আর চাকরির জন্য কেবল লক্ষ লক্ষ টাকার ঘুষ দিলে হবে না, তজ্জন্য ক্ষমতাসীন দলের টিকিট বা সুপারিশ থাকতে হবে। এভাবেই আজ পার্বত্য চট্টগ্রামকে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা অপব্যবহারের স্বর্গরাজ্যে ও দুর্নীতি আখড়ায় পরিণত করা হয়েছে। তথাকথিত উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির কারণে নয়; শাসকশ্রেণির দুর্নীতি, অনিয়ম, প্রকল্প আত্মসাৎ ও টেণ্ডাবাজিই হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলার উন্নয়নে প্রধান বাধা, এটা নি:সন্দেহে বলা যায়।
অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রেফতার সম্পর্কে অপপ্রচার
বর্তমানে কতিপয় জাতীয় দৈনিকের পাতা খুললেই বা অনলাইন পত্রিকায় টুঁ মারলে প্রায়ই বিপুল পরিমাণ ‘অস্ত্র উদ্ধার’ ও ‘সন্ত্রাসী গ্রেফতার’ এর খবর দেখতে পাওয়া যায়। অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী গ্রেফতার পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন কোন ঘটনা নয়। এই অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রেফতারের সাথে জড়িত রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীসহ শাসক মহলের রাজনৈতিক, বৈষয়িক ও কায়েমী স্বার্থ। একসময় বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়িকে বলা হতো অস্ত্রের খনি। কয়েকদিন পর পর সেখানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হতো এবং আশ্চর্যের বিষয় যে, এই অস্ত্র উদ্ধারে কেউ ধরা পড়তো না।
বস্তুত অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্বদানকারী সংশ্লিষ্ট কম্যান্ডারদের প্রমোশন লাভ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শক্তিশালী সশস্ত্র দল রয়েছে এই অজুহাত সৃষ্টি করার জন্য নানা অভিনয়ের মাধ্যমে অস্ত্র উদ্ধার হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ৩ ডিসেম্বর ২০০৪ দৈনিক চট্টগ্রাম মঞ্চে প্রকাশিত কবির হোসেন সিদ্দিকীর প্রতিবেদন বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় যে, “…কতিপয় বিডিআর কর্মকর্তার সাজানো নাটক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা প্রমোশন পাবার জন্যই একবার উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলো বার বার করেই দেখানো হচ্ছে।” এটাই হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলায় তথাকথিত অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী গ্রেফতারের প্রকৃত ঘটনা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র যে মোটেই উদ্ধার হয় না কিংবা অস্ত্রধারী কাউকে যে গ্রেফতার করা হয় না তা কিন্তু নয়। কিন্তু অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী গ্রেফতারের ঘটনাগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ঘটনাই সাজানো ও পূর্ব পরিকল্পিত। যেমন গত ১৫ আগস্ট ২০১৫ রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার বড়াদমের বারিবিন্দু ঘাটে সংঘটিত সেনাবাহিনী ও অস্ত্রধারীদের মধ্যকার বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ৫ জন অস্ত্রধারী নিহত এবং ৩টি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ২টি চাইনিজ রাইফেল, একটি এসএমজি ও একটি পিস্টল উদ্ধারের ঘটনা সঠিক হলেও ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতারকৃত ৫ জন ব্যক্তি ছিল নিরীহ গ্রামবাসী।
গত ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ রাতে বিজিতলা আর্মী ক্যাম্পের সেনারা খাগড়াছড়ি ইউনিয়নের থলিপাড়া গ্রামের কালিবন্ধু ত্রিপুরার বাড়ি থেকে অস্ত্রসহ তিনজনকে গ্রেফতারের ঘটনাও ছিল সাজানো ও পূর্ব পরিকল্পিত। জানা যায় যে, সেদিন গভীর রাতে কালিবন্ধুর বাড়ি ঘেরাও করে ঘুম থেকে জাগিয়ে সবাইকে ঘরের বাইরে জড়ো করে। এ সময়ে সেনা সদস্যরা একটা হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে। ঘর থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর হ্যান্ড ব্যাগ থেকে দু’টি পাইপ গান পাওয়া গেছে বলে ঘোষণা করে। পরে সেনা সদস্যরা অস্ত্রগুলো গুজিয়ে দিয়ে তিনজনের ছবি তুলে তাদেরকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। পরে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তাদের অস্ত্রসহ তোলা ছবি ছাপিয়ে সন্ত্রাসী হিসেবে সংবাদ প্রচার করা হয়।
গত ১৪ জুলাই ২০১৬ বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার তালুকদার পাড়ার ৬ জন নিরীহ জুম্ম গ্রামবাসীকে ধরে এনে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সন্ত্রাসী সাজানোর চেষ্টা করা হয়। সাংবাদিকদের সামনে তাদেরকে ‘আত্মসমর্পণকারী সন্ত্রাসী’ বলে তুলে ধরলে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে লুসাইমং নামে একজন বলেন, “আমরা কোন সন্ত্রাসী নই, আমরা খেটে-খাওয়া মানুষ। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমাদেরকে সন্ত্রাস বিরোধী আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের জন্য ডাকাতে আমরা এখানে এসেছি। আলোচনা সভা শেষে তার বাংলো থেকে বের হলে আর্মিরা গাড়িতে উঠতে বলে আমাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসে এবং এখন সন্ত্রাসী বলে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে।” এই হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর সন্ত্রাসী গ্রেফতারের নমুনা।
এভাবেই আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে কখনো ১০ হাজারের বেশি সন্ত্রাসী, কখনো ১৮শ’ সন্ত্রাসীর সক্রিয় থাকার কথা প্রচার করা হচ্ছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে তথাকথিত ‘উপজাতীয়’ অস্ত্রধারীদের কল্পিত রাজ্যে পরিণত করছে। সরকার নিজেদের স্বার্থে কখনো “পার্বত্য চট্টগ্রামে বয়ে চলে শান্তি সুবাতাস” (জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) বলে প্রচার করছে, পক্ষান্তরে আবার “অশান্তির আগুনে জ্বলছে পার্বত্য তিন জেলার মানুষ” (ইনকিলাব, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬) বলে জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে তথ্য সন্ত্রাস চালাচ্ছে।
পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন সম্পর্কে অপপ্রচার
গত আগস্টে মন্ত্রীসভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ অনুমোদনের পর সেটেলার বাঙালিদের পাঁচটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন উক্ত আইনের বিরোধিতা করে আসছে। “নতুন এ আইনের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী বাঙালিরা ভূমি থেকে উচ্ছেদ হবেন এবং ভূমির অধিকার হারাবেন। …এতে পাহাড়িদের আধিক্য থাকবে ও নিজেদের অধিকার ক্ষুন্ন হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন” (বিবিসি ১০ আগস্ট ২০১৬; পার্বত্যনিউজ ১১ আগস্ট ২০১৬)। আর সে কারণে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের সংশোধনী বাতিলের দাবি জানাচ্ছে এই পাঁচটি সেটেলার বাঙালি সংগঠন।
পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের সংরক্ষিত আসনের মহিলা সাংসদ ফিরোজা বেগম চিনুও সেই অপপ্রচারে সামিল হয়েছেন। গত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ঢাকাস্থ জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় “পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের ভূমি হারা করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করতে একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে” বলে খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী উল্লেখ করেন যার মধ্য দিয়ে তাঁর সাম্প্রদায়িক চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে।
বস্তুত এই আইন সংশোধনের মাধ্যমে ভূমি কমিশনকে বা পাহাড়ি সদস্যদেরকে নতুন কোন অধিকার বা ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি। ভূমি কমিশন আইনের উক্ত সংশোধনীর মাধ্যমে কমিশনে জুম্মদের সদস্য সংখ্যা যেমনি বৃদ্ধি করা হয়নি, তেমনি বাঙালিদের সদস্য সংখ্যাও কমানো হয়নি। কমিশনের চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা কমিয়ে ও কোরামের জন্য চেয়ারম্যানসহ অপর দুইজন সদস্যের পরিবর্তে অপর তিনজন করার ফলে অন্য কোন সদস্যের ক্ষমতাও বাড়ানো হয়নি। বরঞ্চ অধিকতর গণতান্ত্রিক ধারা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতাকে নিশ্চিত করা হয়েছে এবং তার মধ্য দিয়ে পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের ভূমি অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। এই আইন সংশোধনের মাধ্যমে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে এই ভূমি কমিশন আইনটি সঙ্গতিপূর্ণ করা হয়েছে এবং চুক্তিতে বর্ণিত কার্যাবলী বা এখতিয়ার ভূমি কমিশনের উপর ন্যস্ত করার বিধান যথাযথভাবে করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংশোধিত ভূমি কমিশন আইনের বিরুদ্ধে মৌলবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক মহল, এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের অনেক নেতা-কর্মীও অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে।
বাঙালীদের বিতাড়ন সম্পর্কে অপপ্রচার
বস্তুত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী বাঙালিরা ভূমি থেকে উচ্ছেদ হবেন এবং ভূমির অধিকার হারাবেন’ এমন আশঙ্কা নিতান্তই অমূলক ও অবান্তর। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, প্রথা, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী পাহাড়ি-বাঙালি যাদের জায়গা-জমি বন্দোবস্ত ও ভোগদখল রয়েছে তাদের অন্যায্যভাবে উচ্ছেদ হওয়ার বা ভূমি অধিকার হারাবার কোন কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতিকে লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে, জবরদস্তি উপায়ে কিংবা পদ্ধতি-বহির্ভুতভাবে জায়গা-জমি বন্দোবস্তী নিয়েছেন বা বেদখল করেছেন তাদের তো আইনের আওতায় আসতেই হবে এবং তা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে তো অবৈধ বন্দোবস্তী বা বেদখল ছেড়েই দিতে হবে। সেইসব অবৈধ দখলদারদের পক্ষে সাফাই গাওয়া কখনোই মানবিক, ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক হতে পারে না। বলাবাহুল্য, বাঙালিরা ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও ভূমি অধিকার হারাবার সস্তা শ্লোগান তুলে ধরে সাধারণ বাঙালিদের তথা দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার যেভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে সেভাবে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ও চুক্তির বিরুদ্ধে সেইরূপ অপপ্রচার চালিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে অপপ্রচার
২০০৯ সালে পার্বত্য চুক্তি পক্ষীয় সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসলেও আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সময়সূচি কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণা পূর্বক চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলী হস্তান্তর ও কার্যকরকরণ; পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য প্রশাসনিক ও আইন পদক্ষেপ; ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার; ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণসহ পুনর্বাসন; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ, চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন; সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন ইত্যাদি চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোন কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ‘চুক্তি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে’ বা ‘চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক’, ‘৮০% চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে’, কখনো বা ‘এ সরকারের আমলে ৯০% চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে’ ইত্যাদি বুলি আওড়িয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ‘চুক্তির ১৯ বছরের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বেশির ভাগ শর্তই পূরণ করা হয়েছে’ (ইনকিলাব, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬) বলে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রদান করা হচ্ছে। এমনকি দেশ-বিদেশের জনমতকে বিভ্রান্ত করতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে’ বলে অসত্য বক্তব্য প্রচার করতে থাকে। বস্তুত ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে।
এ অপপ্রচারে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আরো একধাপ গিয়ে চুক্তিরই বিরোধিতা করে চলছে এবং নানাভাবে অপপ্রচারে অবতীর্ণ রয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ দৈনিক জনকণ্ঠ এবং ৪-৫ জানুয়ারি ২০১৭ দৈনিক ইত্তেফাকে খাগড়াছড়ির ডিসি মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামানের দেয়া বক্তব্য তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উক্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “উপজাতিদের দাবি অনুযায়ী সব দফা বাস্তবায়ন করা হলে পার্বত্য অঞ্চল আর বাংলাদেশের অংশ থাকবে না। কারণ তখন তাদের হাতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও বন বিভাগ চলে যাবে। এখান থেকে সব নিরাপত্তা সংস্থার লোকজনকে চলে যেতে হবে। এসিল্যান্ড চলে যাবে। এসব যদি চলে যায় দেশের একদশমাংশের সার্বভৌমত্ব থাকবে না।” অপরদিকে ‘সম্ভাবনার পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়নের স্বপ্ন ও বাস্তবতা’ শিরোনামে লেখা ২৪ আর্টিলারি ব্রিগেড ও গুইমারা রিজিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: তোফায়েল আহমেদ, পিএসসি-এর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “শান্তিচুক্তির কিছু ধারা আমাদের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক” (‘দৈনিক পূর্বকোণ’-এর ২৯, ৩০ ও ৩১ জুলাই ২০১৫ এবং ১ আগস্ট ২০১৫; দৈনিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ ও ‘যায় যায় দিন’ এর যথাক্রমে ৩১ জুলাই ২০১৫ ও ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়েও প্রজাতন্ত্রের স্বাক্ষরিত চুক্তির বিরুদ্ধে তাঁরা যে বক্তব্য দিয়েছেন তা থেকে বুঝা যায় সর্ষের মধ্যে ভূত রয়েছে। খোদ সরকারি প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অর্গানই চুক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বস্তুনিষ্ঠ ও প্রকৃত অবস্থা স্বীকার করা নি:সন্দেহে সততা ও আন্তরিকতার পরিচায়ক। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়ন না করে চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে কিংবা যা বাস্তবায়িত হয়নি তা বাস্তবায়িত হয়েছে বলে দাবি করা নি:সন্দেহে প্রতারণা এবং দূরভিসন্ধিমূলক বৈ কি। এটা চুক্তি বাস্তবায়ন না করারই একটা সুদূরী প্রসারী ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ক্ষমতাসীন দলসহ দেশের শাসকগোষ্ঠী চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না করার হীনউদ্দেশ্যেই চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে নির্দ্বিধায় বলা যায়।
জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কর্মসূচিকে জুম্ম বিরোধী কর্মসূচিতে রূপান্তর
সারাদেশে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ তথা সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হলেও পার্বত্যাঞ্চলে সেই জঙ্গীবাদ বিরোধী কার্যক্রমকে ব্যবহার করা হচ্ছে আন্দোলনরত জনসংহতি সমিতি ও কর্মীদের বিরুদ্ধে। তিন পার্বত্য জেলায় জঙ্গীবাদ বিরোধী সমাবেশে জঙ্গীদের পরিবর্তে জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য প্রদান করে থাকে। এমনকি “সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে জামায়াত-শিবিরের সাথে জনসংহতি সমিতির নেতাদের সম্পর্ক ও সখ্যতা রয়েছে” (১৬ আগস্ট ২০১৬, দৈনিক পূর্বকোণ) মর্মে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট প্রচারণা চালাতে থাকে। “বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন ছাড়াও মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর কাছ থেকে তারা অস্ত্র সংগ্রহ করছে” বলে জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে জঙ্গীবাদ বিরোধী কার্যক্রমকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হচ্ছে এবং প্রকারান্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে।
২৮ ডিসেম্বর ২০১৬ দৈনিক মানবজমিনে ‘পাহাড় থেকে আসা অত্যাধুনিক অস্ত্র জঙ্গিদের হাতে’ শীর্ষক সংবাদে উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে বলা হয় যে, “স্থানীয় গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, পাহাড়িদের হাত ঘুরে এসব অস্ত্র এখন পৌঁছে যাচ্ছে দেশে সক্রিয় বিভিন্ন জঙ্গিদের হাতে। ব্যবহার হচ্ছে দেশবিরোধী সন্ত্রাসী কাজে। আটক জঙ্গিরা পাহাড় থেকে অস্ত্র সংগ্রহের বিষয়টি এরই মধ্যে স্বীকার করেছে।” ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬ জনকণ্ঠেও একই ধরনের সংবাদ প্রকাশ করা হয়। উল্লেখ্য যে, এযাবৎ শত শত জঙ্গী আটক করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্ত্র সংগ্রহের বিষয়টি কোন জঙ্গী দাবি করেছে বলে শোনা যায়নি বা কোন সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়নি। এটা পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত গোয়েন্দাদের সাজানো সংবাদ। এর পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামী জঙ্গীদের তৎপরতা আড়াল করে প্রকারান্তরে তাদেরকে মদদ প্রদান করা, পক্ষান্তরে জুম্মদের আন্দোলনরত সংগঠন ও কর্মীদের উপর দমন-পীড়ন চালানোর অজুহাত তুলে ধরা।
আরো উল্লেখ্য যে, ১৬ আগস্ট ২০১৬ তারিখের দৈনিক পূর্বকোণে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন থেকে জেএসএস অস্ত্র সংগ্রহ করছে বলা হলেও ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখের দৈনিক মানবজমিনে ‘পাহাড়িদের হাত ঘুরে এসব অস্ত্র এখন পৌঁছে যাচ্ছে দেশে সক্রিয় বিভিন্ন জঙ্গিদের হাতে’ বলে স্ববিরোধী বক্তব্য প্রদান করা হয়। এ থেকে বুঝা যায়, জঙ্গীদের সাথে জেএসএসের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনী ও ক্ষমতাসীনদের অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা ও সাজানো।
গত ২৭ আগস্ট ২০১৬ রাঙ্গামাটিতে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, যুবসেনা ও ছাত্রসেনা নামক তিন জঙ্গী ও সাম্প্রদায়িক দল কর্তৃক পার্বত্য ভূমি কমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করলেও প্রশাসন ও আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে সেসব চুক্তি বিরোধী ও জঙ্গী সংগঠনের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বরঞ্চ তাদেরকে নির্বিঘেœ কর্মসূচি পালনের সুযোগ করে দেয়া হয় বলে জানা যায়। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন সাম্প্রদায়িক জঙ্গী গোষ্ঠীসমূহের তৎপরতা প্রকারান্তরে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে।
অপপ্রচারনায় ভাড়াটে সাংবাদিক, প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকা
বর্তমান অবাধ তথ্য প্রযুক্তির যুগে ভাড়াটে সাংবাদিক, হলুদ সংবাদ কর্মী, ভূঁইফোড় অনলাইন ও ছাপানো পত্রিকার মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রয়ন্ত্রের আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীসহ শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন মহল। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাঙের ছাতার মতো অহরহ বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা গড়ে তোলা হয়েছে। বাহ্যত ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এসব অনলাইন পত্রিকাগুলো গড়ে তোলা হলেও অধিকাংশই সরকারি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে। মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যবসার পাশাপাশি জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে শাসকগোষ্ঠীর প্রচারযুদ্ধে এসব অনলাইন পত্রিকাগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে চালু করা অধিকাংশ অনলাইন ও ছাপানো পত্রিকাগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, জুম্ম জনগোষ্ঠী, জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলন ও আন্দোলনরত সংগঠন সম্পর্কে শাসকশ্রেণির একতরফা, বিকৃত, খ-িত, সাজানো ও কল্পিত তথ্য ও সংবাদ অপপ্রচার করে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব পত্রিকায় সেনা কর্মকর্তা, সাম্প্রদায়িক লেখক ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের লেখা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিরোধী, জুম্ম বিদ্বেষী, আন্দোলনরত জুম্ম সংগঠন-বিরোধী লেখা ও প্রবন্ধ, সভা-সমিতিতে প্রদত্ত সাম্প্রদায়িক সংগঠন, নিরাপত্তাবাহিনী, ক্ষমতাসীন দল তথা শাসকগোষ্ঠীর বক্তব্যগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি ইনকিলাব, মানবজমিন, জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক ইত্যাদি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোও এসব অনলাইন পত্রিকায় পুন:প্রচার করা হয়। এক্ষেত্রে গুইমারা ২৪ আর্টিলারি ব্রিগেড ও রিজিয়নের কমা-ার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: তোফায়েল আহমেদ, মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান প্রমুখ সেনা কর্মকর্তাদের লেখা প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকা ও সরকারি প্রকাশনায় প্রচার করা তার মধ্যে অন্যতম। এই প্রচারনা শিল্পে এমন বৈষয়িক ও কায়েমী স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে যেখানে এককালে প্রগতিশীল সংগঠনের সাথে যুক্ত অনেক ব্যক্তিও সরকারের বিশেষ মহলের অনুদানে অনলাইন পত্রিকা চালু করে এই জাতি-বিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারে সামিল হয়ে সুবিধবাদী ও সাম্প্রদায়িক ভূমিকা গ্রহণ করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অপপ্রচারের লক্ষ্যে সম্প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশেষ প্রভাবশালী গোষ্ঠীর উদ্যোগে জেলা পর্যায়ে কিছু ভূঁইফোড় সাংবাদিক সৃষ্টি করে বিভিন্ন পত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যমের পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে দিয়ে থাকে বলে লক্ষ করা গেছে। সাংবাদিক সেজে সংবাদ সংগ্রহের নামে সহজে যাতে তারা বিভিন্ন সভা-সমিতিতে প্রবেশ বা কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে পারে তজ্জন্য উক্ত প্রভাবশালী গোষ্ঠী থেকে তাদের জন্য এ ধরনের পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট পত্রিকা বা সংবাদ মাধ্যম থেকে তারা বেতন-ভাতা না পেলেও সেই বিশেষ প্রভাবশালী গোষ্ঠী থেকে তাদেরকে নানাভাবে আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। সেই ভুঁইফোড় সাংবাদিকদের দিয়ে পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে বা জুম্মদের আন্দোলনরত সংগঠন ও কর্মীদের বিরুদ্ধে সংবাদ কিংবা সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। সেসব ভাড়াটে সাংবাদিকদের দিয়ে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী অতিরঞ্জিত, বানোয়াট ও কল্পিত সংবাদ প্রচারের জন্য অপরাপর সাংবাদিকদের প্রভাবিত করা কিংবা জুম্মদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যাতে প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত না হয় তজ্জন্য বিভিন্ন পত্রিকা ও গণমাধ্যমের স্থানীয় সাংবাদিকদের চাপ দেয়া হয়ে থাকে।
সংবাদ প্রকাশ, সভা-সমিতির উপর বাধা-নিষেধ
একদিকে অনলাইন ও ছাপানো পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অপপ্রচার জোরদার করা হয়েছে, অন্যদিকে জুম্মদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনের সংবাদ এবং আন্দোলনরত সংগঠন ও কর্মীদের আহুত জনসভা, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ, নানা কর্মসূচির সংবাদ প্রকাশের উপর শাসকশ্রেণির প্রভাবশালী মহল থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়ে থাকে। ফলে নিপীড়ন-নির্যাতন এবং আন্দোলনরত সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূূচির সংবাদ অধিকাংশ ক্ষেত্রে জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয় না।
অন্যদিকে কতেক ক্ষেত্রে অনুমতি দেয়া হয় না আন্দোলনরত সংগঠনের জনসভা, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সভাবেশ, আন্দোলনের কর্মসূচি আয়োজন। গত ২ ডিসেম্বর ২০১৬ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৯তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে বান্দরবানের রাজার মাঠে নাগরিক সমাজের আহুত গণসমাবেশের অনুমতি প্রদান করেনি বান্দরবান জেলা প্রশাসন। গত ২৬-২৭ নভেম্বর ২০১৬ খাগড়াছড়ি জেলার সিন্দুকছড়ি সাব-জোনের সেনারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৯তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে টানানো পোস্টার ছেড়ে ফেলে এবং পোস্টারিং-এর কাজে নিয়োজিত কর্মীদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং সমতল অঞ্চলে আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশনের দাবিতে গত ১৮ জানুয়ারি ২০১৬ তিন পার্বত্য জেলার জেলায় গণমানববন্ধন আয়োজনে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন কর্তৃক খাগড়াছড়ি জেলায় অনুমতি দেওয়া হয়নি। ফলে খাগড়াছড়ি সদরে মানববন্ধনে আসা লোকদের উপর পুলিশ চড়াও হয়। মহালছড়ি উপজেলাধীন মাইসছড়ি ইউনিয়ন ও মহালছড়ি সদরে বাধা প্রদান করে। মহালছড়ি ক্যাম্পের সেনা কর্তৃক মাইসছড়ির ম্যাজিস্ট্রেট পাড়া ও নুনছড়ি পাড়ার মানববন্ধনে আসা লোকদেরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও বেধড়ক মারধর করে। এতে ৯ জন আহত হয় এবং একজনকে ধরে নিয়ে থানায় কিছুক্ষণ আটকে রাখা হয়। এভাবে আজ শাসকগোষ্ঠী মত প্রকাশ ও সমাবেশের স্বাধীনতার উপরও হস্তক্ষেপ করে চলেছে।
জুম্ম জাতিগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উস্কানীতে অপপ্রচার
জুম্ম জাতিগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে এক জাতির বিরুদ্ধে আরেক জাতিকে উস্কে দিতে অতি সুক্ষ্মভাবে অপপ্রচার চালানো হয়। ২ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে দৈনিক জনকণ্ঠে ‘পার্বত্য জেলায় পাহাড়ী ও বাঙালীদের ভেতর ক্রমেই অবিশ্বাস বাড়ছে’ শীর্ষক সংবাদে সুচতুরভাবে জুম্ম জাতিগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে বিভাজনের বিষ ছড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়। উক্ত সংবাদে বলা হয় যে, “পাহাড়ে ১২টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ বাঙালী জনগোষ্ঠীর বসবাস। এর মধ্যে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমারা সংখ্যায় বেশি। সরকারের দেয়া সব সুযোগ সুবিধা এই তিন নৃ-গোষ্ঠীর মানুষই ভোগ করছেন। বাকি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ দরিদ্র ও নিরীহ। …তাদের মধ্যে পাহাড় স্বাধীন করার কোন চিন্তা কাজ করে না। তারা জানেনও না সরকার পাহাড়ীদের জন্য লেখাপড়া, সরকারি চাকরিসহ রাষ্ট্রীয় অন্যান্য সুযোগ সুবিধার জন্য শতকরা ৫ ভাগ কোটা রয়েছে। পাহাড়ে শতভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হচ্ছে চাকমারা। …তঞ্চ্যঙ্গা, বম, পাংখোয়া, চাক খিয়াং, খুমি, লুসাই ও কোচদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই নগণ্য। …বাঙালীদের মতোই তাদের অবস্থান। তারা কখন চিন্তাও করে না পাহাড়ে কী ধরনের শাসন হবে।”
উক্ত সংবাদে সরকারি সুযোগ-সুবিধা কেবল চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা জনগোষ্ঠীর লোকেরাই ভোগ করছে কিংবা তারা ছাড়া অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ‘পাহাড় স্বাধীন করার কোন চিন্তা কাজ করে না’ বলে উল্লেখ করার মাধ্যমে অতি সুক্ষ্মভাবে জাতিগত বিভেদ সৃষ্টির পাঁয়তারা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এটা সত্য যে, চাকমাদের তুলনায় ‘তঞ্চ্যঙ্গা, বম, পাঙ্খুয়া, চাক, খিয়াং, খুমি, লুসাইদের মধ্যে শিক্ষার হার কম’। কিন্তু ‘শতভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হচ্ছে চাকমারা’ এ কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও অপপ্রচারমূলক।
উপসংহার
উগ্র সাম্প্রদায়িক, উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহলের পাশাপাশি নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে জুম্মদের মধ্যে একটি সুবিধাবাদী ও সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠী শাসকশ্রেণির এই অপপ্রচারে চরম দালালি ভূমিকা পালন করছে। জুম্মদের জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে এবং জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও আবাসভূমির অস্তিত্বকে বিপন্ন করে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও স্থানীয় সরকার পরিষদগুলোতে চেয়ারম্যান-মেম্বার হওয়া সহ ক্ষমতা ও পদবী লাভ, প্রকল্প-চাকরি-টে-ার লাভের সুযোগ, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে কাঁচা টাকা কামাই, বাড়ি-গাড়ি-ব্যাংক ব্যালেন্স গড়ে তোলার কায়েমী স্বার্থে জুম্মদের এই দুলাগোষ্ঠী মুৎসুদ্দীপনায় লিপ্ত রয়েছে।
এই অপপ্রচার, মিথ্যাচার ও তথ্য সন্ত্রাসের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি অধিকতর অবনতির দিকে যেমনি ধাবিত হচ্ছে তেমনি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোয়েবলসীয় কায়দায় অপপ্রচার ও তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্মাদনা ছড়িয়ে দিয়ে ও অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আখেরে কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল সাময়িক লাভবান ও পরিতৃপ্ত হলেও তারা দেশে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণে এবং দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে চরম ক্ষতি করে চলেছে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে নতুন করে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কখনোই কাম্য হতে পারে না।
…………………
তারিখ: ৩১ জানুয়ারি ২০১৭।
মঙ্গল কুমার চাকমা; তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।