চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের নবীন বরন ও বিদায় সংবর্ধনা দিল পিসিপি
“আলোর পথে দ্রোহের সূচনা নবীনের জয়গান, শেখড় আজ ডাকছে তোমায় মিলাও তব প্রান” এই স্লোগানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের নবীন বরন ও বিদায় সংবর্ধনা-২০১৮ইং অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ শুক্রবার পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ(পিসিপি) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের প্রাক্তন ডিন ও লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক হোসাইন কবির বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ পিছিয়ে পড়া না, যারা আজকে ক্ষমতায় আছে, যারা আজকে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে তারাই পিছিয়ে রেখেছে এ দেশের আদিবাসী মানুষদের। তিনি উপস্থিত নবীন এবং প্রবীন ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের চলতি গন্ডিবদ্ধ চিন্তা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। নিজের দেখার চোখকে প্রসারিত করতে হবে, নিজের মনের জানালাকে খুলে দিতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এ গন্ডিবদ্ধ চিন্তা ভাবনা থেকে যারা বেড়িয়ে এসে তাদের চিন্তাভাবনাকে সমাজের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে তাদের এ সমাজের সংকীর্ণ চিন্তাধারার মানুষরা হত্যা করেছে। ব্রুনো, সক্রেটিস, জোয়ান অব আর্ককে তারা মেরে ফেলেছে।’
বিশেষ অথিতির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জুয়েল চাকমা বলেন, ‘বর্তমান শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি বৃহৎ জেলখানায় পরিণত করে রেখেছে এবং এখানকার অধিবাসীদের হাজতির মত করে রাখা হয়েছে। চোখে দেখা যায় না এমন এক অদৃশ্য কারাগারে আমরা বসবাস করছি। এ কারাগার থেকে মুক্ত হতে কি করণীয় বর্তমান ছাত্র সমাজকে আজকেই নির্ধারণ করতে হবে।’
তিনি উপস্থিত নবীন ও বিদায়ী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এম এন লারমা যে আদর্শ বুকে ধারন করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন, বিজাতীয় শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তাদের অন্যায় শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, এ থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিতে হবে।’
‘আজকে রুমা থেকে থানচি, সাজেক থেকে ঠেগা, ঘুনধুম থেকে দুদুকছড়া পর্যন্ত মানুষেরা সুখে নেই। তাদের প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ভয়ে, বাড়ি-ছাড়া হওয়ার ভয়ে, নিজের জায়গা জমি হারানোর ভয়ে, অস্তিত্ব হারানোর ভয়ে জীবন যাপন করছে। তারা প্রতিনিয়ত নিপীড়ণ-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। জুম্ম জনগণের যে কান্না, যে কান্না অন্তরের চোখ না দিয়ে দেখলে দেখা যায় না, সে কান্না আজকের তরুন প্রজন্মকে ঘোছাতে হবে’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
জুয়েল চাকমা আরো বলেন, ‘আজকে এদেশের শাসকগোষ্ঠী পর্যটন স্থাপনের নামে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নামে, সামরিক স্থাপনার নামে, সামাজিক বনায়নের নামে এবং বিভিন্ন নামে বেনামে জুম্ম জনগণকে তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। এ ষড়যন্ত্র বন্ধে জুম্ম ছাত্র সমাজ তথা দেশের সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে।’
বিশেষ অথিতির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমন্বয়ক শ্রী শরৎ জ্যোতি চাকমা বলেন, ‘আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২১ বছর পার হয়ে যাচ্ছে। সরকার চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো, যে বিষয়গুলো জুম্ম জনগণের অস্তিত্বের সাথে জড়িত যেসব বিষয়গুলো সরকার বাস্তবায়নে গাফেলতি করছে।’
তিনি সরকারকে অভিযোগ করে বলেন, ‘সরকার ভূমি কমিশন গঠন করেছে, কিন্তু, ভূমি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে যে জনবল, যে প্রবিধান, যে অর্থবল প্রয়োজন, সেগুলো ঝুলিয়ে রেখেছে। এ যেন ভাত না দিয়ে থালা দেওয়া সমান। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে পিছিয়ে রেখে সরকারের যে এজেন্ডা ২০৩০ কখনো সফল হবেনা, বাস্তবায়ন হবে না।’
‘আজকে শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফ, গনতান্ত্রিক ইউপিডিএফ এবং সংস্কার পন্থীদের নিয়ে পাঁতানো খেলা, পাঁতানো রাজনীতি শুরু করে দিয়েছে। এ পাঁতানো খেলা এবং পাঁতানো রাজনীতিতে পা দেবেন না।
তিনি আরো বলেন, আজকের তরুন ছাত্র সমাজকে স্বপ্ন দেখতে হবে। যে স্বপ্ন অধিকার আদায় করে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাবে’ বলে মন্তব্য করেন শরৎ জ্যোতি চাকমা।
সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে তা খুবই দুঃখজনক। এরকম একটি ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে চলতে দেওয়া যায় না।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা পিসিপির সাধারন সম্পাদক কৃতি চাকমার সঞ্চালনায় এবং সভাপতি মিন্টু চাকমার সভাপতিত্বে নবীন বরন ও বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্যে রাখেন, প্রাণ-রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, প্রাণ-রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কাঞ্চন চাকমা, ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শ্রী আনন্দ বিকাশ চাকমা, ফার্মেসী বিভাগের প্রভাষক শ্রীমতি উমেই চেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সাধারন সম্পাদক শ্রাবন চাকমা। এছাড়াও নবীনদের পক্ষে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন পালি বিভাগের সৌরভ চাকমা এবং বিদায়ীদের পক্ষে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী চিংসাথুই খিয়াং।