আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র ব্যর্থ: সংবাদ সম্মেলনে সুলতানা কামাল
সুমেধ চাকমা: আদিবাসী তথা মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র ব্যর্থ বলে দাবী করেছেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল। আজ জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই কথা বলেন। উক্ত সংবাদ সম্মেলনটি বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, এএলআরডি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, কাপেং ফাউন্ডেশন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, স্বদেশ, হেড ও নাগরিক সমাজের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে সঞ্চালনা করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা এবং লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।
এদিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা হত্যা ও আদিবাসী ভূমি দখলের প্রতিবাদে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে ঘটনায় আহত এবং প্রত্যক্ষদর্শী রিনা মুন্ডা বলেন, “রাশেদুল ও এবাদুল তাদের সন্ত্রাসী দলবল নিয়ে আমাদের মুন্ডা পাড়ায় হামলা করে। ওরা ঘরবাড়ি ঘিরে নেয়। ওরা কোনো কথাই শুনে নাই, আমাদের তিনটা মহিলার ওপর আক্রমণ করে, মারধর করে, অমানবিক নির্যাতন করে এবং আমার শশুরমশাইকে সেখানে মেরে আহত করা হয়। তারপর আমাদের ২০০ কেজি ধানের পাতা ছিল, সেই ধানের পাতাগুলো নষ্ট করে। আমরা এখন ক্ষতিগ্রস্থ, আমরা এখন জমি চাষ করতে পারছি না।”
আজ জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে ১৯ আগস্টের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে রিনা মুন্ডা আরও বলেন, “আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না। তারা বলে দিয়েছে কোনো ক্ষেত্রে যদি আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায় তাহলে তাদের মারপিট করা হবে। এজন্য আমরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে পারিনি। আসামীদের ধরে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি যেন দেয়া হয় এই দাবি জানাচ্ছি।”
হামলার ঘটনায় মামলার বাদী এবং নিহত নরেন্দ্রনাথ মুন্ডার ভাইয়ের ছেলে ফনিন্দ্রনাথ মুন্ডা ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “গত ১৯ আগস্ট শুক্রবার সকাল আটটার দিকে দেখি কিছু লোক এসে আমাদের বাড়িঘর ঘেরাও করে তারপর জমি চাষ করতে নেমে যায়। আমাদের তিনজন মহিলা উনাদের বাধা দিতে গেলে তারা তাদের নির্যাতন, মারপিট করে। আমাদের নরেন কাকা ওখানে গিয়েছিল তাদের বাধা দেয়ার জন্য, বৌমাদের যাতে মারপিট করা না হয়। কিন্তু হত্যাকারীরা তাকেও মারধরে করে। বাড়ির চারপাশে আমাদেরকে ঘেরাও করে রেখেছিল, আমরা কিছু করতে পারিনি। আমরা চেয়ারম্যান, মেম্বারকে ফোন দিয়েছিলাম। উনারা আমাদের ডাকে সাড়া দেয়নি। হামলার পর প্রশাসনের লোক আমাদের ওখানে যায়।”
তিনি আরও বলেন, “আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য কোন ভ্যান কি মোটরসাইকেল আমাদেরকে নিয়ে আসতে চাচ্ছিল না ভয়ের জন্য। ওরা বলছিলো, তোমাদের রোগী যদি নিয়ে যাই তাহলে আমাদের পথে বেত দিয়ে মারবে।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “আমার কাছে মনে হয় আমরা ছোটবেলায় যে রূপকথার গল্প পড়তাম একটার পর একটা, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকতো, একের পর এক পরীক্ষা দিতেই হতো, সেই পরীক্ষার আর শেষ হয়না। আমি দেখি যে, আদিবাসীদের জীবনটাও সেরকম একটা অবস্থার মধ্যে পড়েছে। একটার পর একটা তাদের জীবনে বিগ্রহ, অত্যাচার, ধর্ষণ, হত্যা চলতেই থাকবে, তাদের সম্পত্তি বেদখল হতেই থাকবে এবং তারা সেই সংগ্রাম, আন্দোলন করতে করতেই জীবন পার করবে।”
রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে তিনি আরও বলেন, “রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করা। যেকোনো শ্রেণীর হোক, যেকোনো সংখ্যার হোক, যেকোনো জাতির হোক, যেকোনো বর্ণের হোক আমাদের সংবিধান বলে দিয়েছেন রাষ্ট্র সবাইকে সমান চোখে দেখবে এবং প্রত্যেকের অধিকার সংরক্ষণ করবে। আজকে দুঃখের সাথে বলতে হয়, মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। একজন মানুষের অধিকার রক্ষায় যদি রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়ে থাকে, সেই ব্যর্থতার দায়ভার তাকে গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন তাদেরকে আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, তারা কিন্তু ক্ষমতায় গেছেন জনগণের মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, সামাজিক অধিকার, তার ব্যক্তিগত জীবনের অধিকার সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকার করে।”
সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন মুন্ডাদের অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন-সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব গোপালচন্দ্র মুন্ডা এবং আহ্বায়ক অধ্যাপক আশিক-ই- এলাহী, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা কয়েকটি দাবি ও সুপারিশ তুলে ধরেন। সেগুলো হলো: ১. অবিলম্বে নরেন্দ্রনাথ মুভা হত্যার মূল আসামীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা, ২. ধুমঘাট এলাকার মুন্ডা পরিবারগুলাের জীবন ও জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ৩. ১৯৫০ (৯৭) সালের রাষ্ট্রীয় প্ৰজাসত্ব আইন যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় আদিবাসী মুন্ডাদের জমি ফেরত দেয়া, ৪. আদিবাসীদের যেসব জমি জাল দলিলের মাধ্যমে বা অন্য কোনাে উপায়ে দখল করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সেইসব জমি দখলমুক্ত করে প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া, ৫. নরেন্দ্রনাথ মুন্ডার পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও আহতদের চিকিৎসার খরচসহ ক্ষতিপূরণ দেয়া, ৬. সারা দেশে আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘন বন্ধ করা এবং দুষ্কৃতকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা, ৭. অবিলম্বে মুন্ডাসহ সমতলের আদিবাসীদের জন্য সরকারের প্রতিশ্রুত ভূমি কমিশনের গঠনের উদ্যোগ নেয়া, ৮. ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করা জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা, ৯. জেলাপ্রশাসকের বিনা অনুমতিতে আদিবাসীদের যেসব জমি হস্তান্তর হয়েছে বা জাল দলিলের মাধ্যমে বেদখল হয়েছে, এসব দলিল বাতিলের জন্য সরকার বা রাষ্ট্র কর্তৃক উদ্যোগ গ্রহণ করা।
উল্লেখ্য যে, জমি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে মুন্ডা সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করা হয়। এ ঘটনায় আহত নরেন্দ্র মুন্ডা (৬৫) পরদিন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এ হামলার ঘটনায় ফনিন্দ্রনাথ মুন্ডা বাদি হয়ে ২২ জনের নাম উল্লেখ করে ১৯২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।