জাতীয় নাগরিক উদ্যোগের আয়োজনে পার্বত্য চুক্তির ২২ তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে রাজধানীতে আলোচনা সভা
![](https://ipnewsbd.net/wp-content/uploads/2019/12/hsl-2.png)
সতেজ চাকমা: । আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২২ তম বর্ষপূর্তি। এ উপলক্ষ্যে রাজধানীতে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে জাতীয় নাগরিক উদ্যোগ। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে উক্ত অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এই চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা), কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট বিশিষ্ট গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক মেসবাহ কামাল, নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীন কণা, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।
জাতীয় নাগরিক উদ্যোগের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌসের পরিচালনায় উক্ত আলোচনা সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সঞ্জীব দ্রং। তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেন, আমরা যখন চুক্তির বর্ষপূর্তি পালন করছি আমাদের আজ আনন্দিত মনে উৎসবের সাথে পালন করবার কথা। কিন্তু সেই চুক্তির বর্ষপূর্তি আজ বেদনার আর ক্ষোভের। পাহাড়ের মানুষ আজ হাহাকার দৈন্যদশার মধ্যে দিনাতিপাত করছে বলেও তাঁর অভিযোগ।তিনি সবার জন্য মানবিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবী করেন। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রের অনুভূতি এখন ভোঁতা হয়ে গেছে। আমরা এক অনুভূতিহীন রাষ্ট্রে বসবাস করছি।
সংহতি বক্তব্যে নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির বলেন, সমাজের অর্ধেক অংশ নারীদের পেছনে ফেলে যেমন সমাজ এগিয়ে যেতে পারেনা তেমনি বাংলাদেশের একটা অংশ আদিবাসীদের পেছনে রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীণ কণা তাঁর বক্তব্যে বলেন, পাহাড়ে কোনো সহিংসতা ঘটলে দুটো জায়গাকে টার্গেট করা হয়। একটা পাহাড়ের নারী আর অপারটি ভূমি। এই আধিপত্যবাদী মননই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের পথে মূল অন্তরায় বলে দাবী করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো সরকারী কর্মকর্তাদের ‘পানিশমেন্ট জোন’। একসময় আন্দামান দ্বীপ, রোবেন দ্বীপ ছিল ‘পানিশমেন্ট’ জোন। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেখা হয়।
কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ছিল রাষ্ট্রের সংগে জনগণের চুক্তি। কিন্তু এই চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়াটা এক ধরণের বঞ্চনা। এই চুক্তি যদি বাস্তবায়ন না হয় তাহলে তাদের আবার অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া ব্যতীত আর কোনো জায়গা থাকবে না। এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে না পারার দায় অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে বলেও জানান তিনি।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী শামসুল হুদা বলেন, প্রায়শই একটি মহল থেকে বলা হয় ২২ বছর ধরে চুক্তির যা বাস্তবায়ন হওয়ার কথা সেটা হয়ে গেছে। এখন সরকার যা করবে সেটাই হবে। এটা কখনো যৌক্তিক হতে পারে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
বিশিষ্ট গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, সরকার প্রতি বছর বিভিন্ন পত্রিকায় পার্বত্য চুক্তি উপলক্ষ্যে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেন। কিন্তু এই ক্রোড়পত্রে চুক্তি স্বাক্ষরকারী অন্যতম ব্যক্তি সন্তু লারমার বক্তব্যও থাকা জরুরী। কেননা, সরকার কেবল মাত্র একতরফাভাবে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
তিনি আরো বলেন, সরকার বলে থাকে চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্যে ৪৮ টি বাস্তাবায়ন হয়েছে। এই কথাটি ২০১৩ সাল থেকে সরকার বলে আসছে। তাহলে এই ৬ টি বছরে কেন আরো বেশি হয়নি তার একটি ব্যখ্যা সরকারের থাকা উচিত। তিনি আরো দাবী করেন, সরকার হয়ত ১০০ বছর পূর্তিতেও বলবেন ৭২ টি ধারার মধ্যে ৪৯ টি বাস্তবায়িত হয়েছে।
অধ্যাপক মেসবাহ কামাল তাঁর বক্তব্যে বলেন, সরকারে চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যে কাল ক্ষেপনের কৌশল আছে। এই কালক্ষেপন করা উচিত নয়। তিনি আরো বলেন, এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটা সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা তৈরী করা উচিত ছিল কিন্তু সরকার তা না করে কৌশল হিসেবে নানা ধরনের দমন-পীড়ন চালাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, এই চুক্তি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা পাহাড়ের নেতৃস্থানীয়রা যতটুকু বুঝেন সামরিক ও বেসামরিক আমলারা তেমন বুঝেন না। তিনি আরো অভিযোগ করেন, আজকে এই চুক্তি বাস্তবায়নে আজ পদে পদে বাঁধা। এই বাঁধা আসছে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের পক্ষ থেকে।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, আমি ধরে নিলাম ৪৮ টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু আমার তো প্রধান বিষয়- ভূমি। এই ভূমির উপর যদি আমার নিয়ন্ত্রণ না থাকে, এই ধারাটি যদি সমাধান না হয় তাহলে এই ৪৮ টি বাস্তবায়ন অর্থহীন।
তিনি আরো বলেন, অস্ত্র জমা দিয়েই তো পাহাড়ী মানুষরা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর সন্তু লারমা বা পাহাড়ী মানুষরা কী এমন করেছে যা বাংলাদেশের স্বার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। সরকার কিন্তু এরকম একটি বিষয়ও দেখাতে পারবে না বলেও দাবী করেন বিশিষ্ট এই শিক্ষক।
তিনি পাহাড়ে চলমান হত্যাকান্ড নিয়ে বলেন, এই হত্যাকান্ড সংঘটনের পেছনে কারা জড়িত রয়েছে তাদেরকে খুঁজে বের করার সেরকম কোনো রাষ্ট্রীয় তাড়নাও আমরা দেখি না। একটি সভ্য রাষ্ট্রে একজন নিরপরাধ মানুষেরও অস্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে না। যদি সেটা হয় তাহলে সেখানে কোনো গলদ আছে বলে ধরে নিতে হবে।
চলমান শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়কেও অভিযানের আওতায় আনা উচিত দাবী করে তিনি আরো বলেন, সরকারের মতে ৪৮ টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে আর জনসংহতির মতে ২৫ টি বাস্তবায়িত হয়েছে। এই দাবীর মধ্যে যে বিশাল তফাৎ এটাকে সামনে নিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান।
অনুষ্ঠানে চুক্তি স্বাক্ষরকারী এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে গড়ে ওঠা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, চুক্তি হয়েছিল দু’ভাবে। একটি লিখিতভাবে অন্যটি অলিখিত ভাবে। এই অলিখিত চুক্তির মধ্যে অন্যতম হল পাহাড়ের বিদ্যমান আইনের লঙ্ঘন করে জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় যে নিরীহ বাঙালিদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদেরকে সম্মানজনকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসন করা। কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
উক্ত বিষয়টি কেন চুক্তিতে লেখা হয়নি তা’র প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি আরো বলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এই সেটলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসনের ব্যাপারটি চুক্তিতে উল্লেখ না করতে অনুরোধ করেছিলেন। কেননা, এটি চুক্তিতে লেখা হলে দেশে বিভিন্ন মহলে নানা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করেছিলেন। সেইসাথে তিনি তাঁর (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) উপর বিশ্বাস রেখে উক্ত সেটলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু আজ অবধি সেই বিশ্বাস রাখা হয়নি বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়টি হচ্ছে -ভূমি। কিন্তু এই ভূমি বিষয়টি এখনো পার্বত্য তিন জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয়নি। তাই ভূমি সমস্যা সমাধানে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের বিধিমালা যদি প্রণীতও হয় তারপরও এই কমিশনের মাধ্যমে সেই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে না বলেও অভিযোগ তুলে ধরেন পাহাড়ের এই নেতা।
সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয় বলে অভিযোগ করে তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। এ দেওয়াল থেকে সামনে এগিয়ে আসার জন্য পাহাড়ের মানুষ উদ্যোগ নিচ্ছে বঔের হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানের সভাপতি বর্ষীয়ার রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য সমাপনি বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের এক দশমাংশ (পার্বত্য চট্টগ্রাম)জায়গায় সেনা শাসন বিদ্যমান থাকবে আর পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়ার দাবী করবেন এই স্ববিরোধীতা হতে পারে না। সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ক্রোড়পত্র প্রতারণায় ভরা বলেও দাবী করেন তিনি।তিনি অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবী করেন।
এছাড়া উক্ত অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. খাইরুল চৌধুরী, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি নূর মোহাম্মদ তালুকদার, বিশিষ্ট সাংবাদিক নুরুল কবির সহ দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রগতিশীল ব্যাক্তিবর্গ।