খেলাধুলা

চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্রিড়া ক্ষেত্রে বিকাশের সুযোগ থেকে জুম্ম’রা বঞ্চিতঃ সন্তু লারমা

রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি, আইপিনিউজঃ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় খেলাধুলার ক্ষেত্রে বিকাশের সুযোগ থেকে জুম্ম জনগণ  বঞ্চিত হচেছন বলে মন্তব্য করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা। মাসব্যাপী চলা ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান স্মৃতি ফুটবল টুর্ণামেন্ট এর সমাপনী অনুষ্ঠান ও পুরষ্কার বিতরণী পর্বে তিনি আজ (৩০ সেপ্টেম্বর) এ কথা বলেন।
সমাপনী অনুষ্ঠান ও পুরষ্কার বিতরণী পর্বে  প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। এছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, রাঙ্গামাটি পৌরসভার স্থানীয় কাউন্সিলর রবি মোহন চাকমা, বিজয় কুমার চাকমা কার্বারী, শ্যামল মিত্র কার্বারী, বিশিষ্ট শিল্পী রঞ্জিত দেওয়ান, সনজিত দেওয়ান, সোনাধন চাকমা, ওয়াশিষ চাকমা, স্বপন কুমার চাকমা, বীরেন্দ্র চাকমা, পলাশ কুসুম চাকমা এবং মোনঘর শিশু সদনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হোবি চাকমাসহ আরো অনেকে।
সমাপনী অনুষ্ঠান ও পুরষ্কার বিতরণী পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান  জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতি যদিও খেলাধুলার আয়োজন এবং খেলাধুলার ক্ষেত্রে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অনূকূল নয়। তবুও  এই খেলার মধ্যে দিয়ে  পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ প্রমাণ করেছে খেলাধুলার ক্ষেত্রে তারা কতটুকু আন্তরিক। এই খেলাধুলার মধ্যে দিয়ে নিজেদের জীবনকে বিকশিত করার একটা বাস্তবতা তারা প্রকাশ করেছে।
খোলোয়ারদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ও অতিথিরা।
সন্তু লারমা আরো বলেন,  আমিও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আমাদের আজকের পার্বত্যঞ্চলে যে বিশেষ শাসন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে খেলাধুলার অঙ্গনে বিকাশের সুযোগ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে  পার্বত্যঞ্চলের জনগণ সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে। খেলাধুলা শুধু স্বাস্থ্যের জন্য নয়। আমাদের মধ্যকার ঐক্য- সংহতি এবং জীবন বিকাশেও ভূমিকা রাখে।
তিনি আরো বলেন,  আজকে খেলাধুলার আমাদের প্রতিটি জেলায় যে পার্বত্য জেলা পরিষদ রয়েছে। সেই জেলা পরিষদের একটি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমরা জেলা পরিষদ এবং জেলা ক্রীড়া সংস্থা নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় আছে। ক্রীড়া নৈপুণ্য থেকে পার্বত্যঞ্চলের জনগণকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। ক্রীড়া এটা যুব সমাজেরই একটা অধিকার। এই মৌলিক অধিকার থেকে পার্বত্যঞ্চলের তরুণ সমাজকে আমরা বঞ্চিত রাখতে পারিনা। তাই আজকে সকলের  দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আসুন আমরা এই পার্বত্যঞ্চলের বুকে  ক্রীড়াঙ্গন বিকাশে একটা বাস্তবতা সৃষ্টি করি। তাই পার্বত্যঞ্চলের যারা নীতিনির্ধারক, পার্বত্যঞ্চলের উন্নয়নের দায়িত্বে সংশ্লিষ্ট সকলেই মিলে এই ক্ষেত্রটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার।
তিনি আরো বলেন, আজকের খেলায় উভয় দলকে আমি অভিনন্দন জানাই। তারা এই সংকীর্ণ খেলার মাঠে যে ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন তা পার্বত্য অঞ্চলের ক্রীড়াঙ্গনে তারুণ্যের যে শক্তি সেটা প্রতিফলিত হয়েছে। সে সাথে বিশেষ বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যারা এই টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। এই প্রতিযোগিতা সফলভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে যারা সহযোগিতা দিয়েছেন তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন পরমাণু এফসি ফুটবল দল।
ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান এর জীবন সংগ্রাম স্মরণ করে তিনি আরো  বলেন, যিনি পার্বত্য অঞ্চলের জনমানুষের জন্য তথা সারা বিশ্বের মানবতা রক্ষার জন্য লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন।  নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। আমৃত্যু পার্বত্য অঞ্চলের  জনমানুষের জন্য তিনি তার ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন। তিনি একজন বিপ্লবী, একজন দেশপ্রেমিক এবং তিনি একজন জাতীয়তাবাদী। তিনি তার সমগ্র জীবন লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। আজকে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের স্মৃতি উদযাপনের মধ্যে দিয়ে আমি তার প্রতি আবার কৃতজ্ঞতা ও  শ্রদ্ধা জানাই। পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের তথা পার্বত্য অঞ্চলের যে বাস্তবতা, সেই বাস্তবতা থেকে বেড়িয়ে এসে এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তা আমি  শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলায় ২-০ গোলে খিপ্প্যাপাড়া একাদশকে হারিয়ে পরমাণু এফসি চ্যাম্পিয়ন হয়। ম্যান অব দ্যা ম্যাচ নির্বাচিত হন পরমাণু এফসির বুবু মারমা। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন ঋত্বিক ত্রিপুরা। সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হন উখাই মারমা এবং সেরা গোলদাতা নির্বাচিত হন রাঙ্গাপানি জুনিয়র্সের খেলোয়াড় রিকুমনি চাকমা। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হল মাসব্যপী চলা ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান স্মৃতি ফুটবল টুর্ণামেন্ট।
উল্লেখ্য, ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র আন্তর্জাতিক মুখপাত্র। পাহাড়ের  জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পক্ষে আন্তর্জাতিক প্রচারকার্যের অন্যতম পুরোধা। তিনি ছিলেন একজন নিখাদ স্বজাতি ও স্বদেশপ্রেমিক, অত্যন্ত ত্যাগী ও সাহসী মানবাধিকার কর্মী এবং বিপ্লবী। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে তার হাত ধরে জুম্ম জনগণের অধিকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযানের পত্তন ঘটেছে যা ধীরে ধীরে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। জাতিসংঘে জুম্মদের পদার্পণ এবং জুম্মদের অধিকারের পক্ষে কথা বলার কাজটা তিনিই প্রথম শুরু এবং প্রতিষ্ঠিত করেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি অত্যন্ত সৎ, নিষ্ঠাবান ও সাদাসিধা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন।ছোটকাল থেকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তাঁর লেখাপড়া শুরু হয় খাগড়াছড়ির খবংপয্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তৎসময়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়ে তিনি সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম শিক্ষাবিদ, সংগ্রামী ও প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব চিত্ত কিশোর চাকমার প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত মহাপ্রুম এমই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে আবার সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। তিনি ১৯৫২ সালে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে ১৯৬১ সালে বিএসসি (অনার্স) ও ১৯৬২ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। পরে ১৯৬৮ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কুইন এলিজাবেথ কলেজে ভর্তি হন এবং চার বছর পর এমফিল গবেষণা সমাপ্ত করেন। এরপর ১৯৮০ সালে রসায়নে সালফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষ করার পর ব্যক্তিগত স্বার্থ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে জলাঞ্জলি দিয়ে অচিরেই তিনি সম্পূর্ণভাবে জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক প্রচার আন্দোলনে নিজেকে সমর্পণ করেন। জুম্ম জাতির সংগ্রামে নিজেকে সঁপে দেয়ায় ব্যক্তি জীবনে ড. দেওয়ান বিয়েও করেননি। ড. আর এস দেওয়ানের জন্ম ৭ জানুয়ারি ১৯৩২ সালে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার খবংপয্যা গ্রামে। তাঁর পিতা রমেশচন্দ্র দেওয়ান ও মাতা চন্দ্রমুখী দেওয়ান। পিতামাতার চার পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। তিনি মৃত্যুবরণ করেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ২৯ মার্চ যুক্তরাজ্যের ম্যানচেষ্টার শহরে নিজের এপার্টমেন্টে। মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।মহান এই ব্যক্তির অবদান ও স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই মূলত এই ফুটবল টুর্নামেন্ট ।

Back to top button