চা বাগান শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা
চা বাগান শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে চা বাগান শ্রমিকদের জীবন-যাপন উপযোগী “মানবিক মজুরি” ঘোষণা দাবি জানিয়েছে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।
বিবৃতিতে বলা হয়, গত ৯ আগস্ট থেকে চা বাগানের শ্রমিকরা ৩শ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন। সম্প্রতি ত্রিপক্ষীয় সভায়ও বিষয়টি সুরাহা হয়নি। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দাবির বিপরীতে মাত্র ১৪ টাকা মজুরি বৃদ্ধিতে রাজি হয়েছে। বর্তমান ১২০ টাকা মজুরি কিংবা এর সাথে আরও ১৪ টাকা যোগ করে ১শ ৩৪ টাকা বিদ্যমান উচ্চমূল্যের বাজারে কখনই জীবন-যাপনের উপযোগী মানবিক মজুরি হতে পারে না। শ্রমিকদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে আমরা তাদের জীবন-যাপনের উপযোগী মানবিক মজুরি ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি।
১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসন অবসানের প্রায় ৭৫ বছর পরও বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক নীতিতেই চা বাগানগুলো পরিচালিত হচ্ছে, যা কখনই মানবিক হতে পারে না। একজন শ্রমিক যে হারে মজুরি পাচ্ছেন, তা দিয়ে শ্রমিক ও তার নির্ভরশীল পরিবারের ভরণপোষণ করা যায় না। অথচ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের রেশন সুবিধা এবং ২০ কেজির বেশি চা পাতা তুলতে পারলে বর্ধিত মজুরি প্রদানের বিষয়টিকে উচ্চকিত করে প্রচার করছেন। যদিও এই রেশন ও বর্ধিত মূল্য পরিশোধে শুভঙ্করের ফাঁকির বিষয়টি বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। কেননা বহুদিন থেকেই শ্রমিকরা অভিযোগ করে আসছেন যে, রেশনে যে চাল বা আটা দেওয়া হয় তা কখনই ঘোষিত পরিমাপের পরিমাণ পাওয়া যায় না। এমনকি একজন শ্রমিকের পক্ষে সারাদিনে ২০ কেজি পাতা তুলতে পারাটা সহজ কাজ নয়, কালেভদ্রে এক-দুইজন শ্রমিক ২০ কেজির চাইতে বেশি পাতা তুলতে পারেন। এই বাড়তি পাতার জন্য যে মূল্য পরিশোধ করা হয়, তা কেজি প্রতি নির্ধারিত মূল্যের চাইতে কম। অপরদিকে বেশি সংখ্যক শ্রমিকই ২০ কেজি পাতা তুলতে পারেন না। এক্ষেত্রে যে পরিমাণ কম তোলা হয় এবং তার বিপরীতে যে টাকা দৈনিক মজুরি থেকে কেটে নেওয়া হয়, সেটি বাড়তি পাতার জন্য প্রদেয় মূল্যের চাইতে অনেক বেশি। এই শুভঙ্করের ফাঁকির বিষয়টি মালিকপক্ষ বরাবরই এড়িয়ে যান!
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আমরা মনে করি, প্রায় ২শ বছর আগে যাত্রা শুরু করা এই শিল্পের শ্রমিকরা এখনও একইভাবে শোষণের শিকার হচ্ছে, যা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথা বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী চা বাগানের শ্রমিকদের সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্তির জন্য রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রমিকের মৌলিক প্রয়োজনের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য বাগান শ্রমিকদের জীবন-যাপনের উপযোগী মানবিক মজুরি নিশ্চিতে রাষ্ট্রকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। চা বাগানে ঔপনিবেশিক আমলের দাসপ্রথা বিদ্যমান। ফলে এখানে বংশ পরম্পরায় শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত হওয়াটাই যেন স্বাভাবিকতা পেয়েছে। বাগান শ্রমিদের সুযোগ-সুবিধা বঞ্চণার ব্যবস্থাপনা এই পরম্পরাকে টিকিয়ে রাখছে। এখানকার শ্রমিক ও তার পরিবার-পরিজন প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা সভ্যসমাজে কাম্য হতে পারে না। আমাদের সামনে একটি বিষয় স্পষ্ট, চা বাগানের শ্রমিদের মৌলিক প্রয়োজন মেটানো এবং পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র তার অন্যতম কর্তব্য হিসেবে গণ্য করে নি, যা বাগান শ্রমিদের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণের উৎকট প্রকাশ। এই বৈষম্য দূর করতে হবে, যেখানে রাষ্ট্রের কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। আমরা বিশ্বাস করি, চা বাগানের শ্রমিকরা ৩শ টাকা মজুরির যে দাবি তুলেছেন, তা বিদ্যমান বাজার মূল্যের তুলনায় কম। মৌলিক প্রয়োজন পুরণ, পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও প্রত্যাশিত জনস্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তিতে সক্ষম করে তুলতে তথা মানব অস্তিত্বের সুরক্ষায় চা বাগান শ্রমিদের জন্য জীবন-যাপন উপযোগী “মানবিক মজুরি” ঘোষণা এবং বাজার মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য বিধানে মজুরি বৃদ্ধির স্থায়ী কাঠামো গড়ে তোলাসহ চা বাগান শ্রমিককে শ্রম আইনের আওতায় নিতে রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা করবে।
বিবৃতি প্রদানকারীরা হলেন: ১. পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সভাপতি, ঐক্য ন্যাপ ২. অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ৩. রামেন্দু মজুমদার, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন ৪. রাশেদা কে. চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ৫. ডা. সারওয়ার আলী, ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন ৬. ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার, সদস্য সচিব, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চ ৭. অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ৮. ডা. ফওজিয়া মোসলেম, সভাপতি, মহিলা পরিষদ ৯. এস.এম.এ সবুর, সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি ১০. খুশী কবির, মানবাধিকার কর্মী ১১. জাহিদুল বারী, সাধারণ সম্পাদক, গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি ১২. রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৩. সালেহ আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন ১৪. ড. জোবায়দা নাসরিন, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৫. অ্যাডভোকেট পারভেজ হাসেম, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ১৬. আবদুল ওয়াহেদ, কার্যকরী সভাপতি, জাতীয় শ্রমিক জোট ১৭. রাজিয়া সামাদ ডালিয়া, সমাজকর্মী ১৮. জাকির হোসেন নির্বাহী পরিচালক নাগরিক উদ্যোগ, ১৯. ড. সেলু বাসিত, গবেষক ও সংস্কৃতি কর্মী ২০. আব্দুর রাজ্জাক, শ্রমিক সংগঠক ২১. অ্যাডভোকেট জীবনানন্দ জয়ন্ত, সংগঠক, গণজাগরণ মঞ্চ ২২. এ কে আজাদ, সংস্কৃতি কর্মী ২৩. অলক দাস গুপ্ত, সংস্কৃতি কর্মী ২৪. দীপায়ন খীসা, তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ২৫. আবদুল আলীম, মানবাধিকার কর্মী ২৬. বিভূতী ভূষণ মাহাতো, সদস্য, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি ২৭. আবদুল মোতালেব জুয়েল, সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী ।