করোনাকালের বাজেটে আদিবাসীদের গুরুত্ব দেওয়ার দাবি-সোহেল হাজং

কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর ফলে ভয়াবহ আঘাত হেনেছে দেশের অর্থনীতিতে। লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ শিল্প-কারখানার চাকাগুলো ঘুরছে না। প্রবাসী আয় কমে এসেছে। গার্মেন্টস শিল্প থেকে উপার্জন কমে গেছে। ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা কেন্দ্রগুলো মুখ থুবরে পড়ে আছে। ছন্দ পতন দেখা দিচ্ছে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকগুলোতে। আদিবাসীসহ সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষেরা সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। ঠিক এই অবস্থা চলাকালে, সময় এল আরেকটি অর্থবছরের নতুন বাজেট ঘোষণার। সেলক্ষ্যে, গত ১১ জুন জাতীয় সংসদে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে মোট পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করা হয়েছে। বাজেটে আদিবাসীসহ প্রান্তিক মানুষের সুরক্ষায় পর্যাপ্ত বরাদ্দের দাবি থাকলেও তার প্রতিফলন ঘটেনি।
প্রস্তাবিত বাজেটে আবারো আদিবাসীরা উপেক্ষিত
আমরা দেখছি দেশের আদিবাসীরা বরাবরই বাজেটে উপেক্ষিত। তাদের জনসংখ্যা অনুসারে কিংবা প্রান্তিকতার অবস্থা বিবেচনা করে কোনকালেই জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয় না। আদিবাসীদের মোট জনসংখ্যা নিয়ে সরকার ও আদিবাসীদের মতের মধ্যে রয়েছে বিরাট তারতম্য। এই তারতম্য বা ফারাক বন্ধ করার জন্য যে বিভাজিত তথ্য সংগ্রহ করা দরকার ছিল, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট পূরণের গত ৫টি বছরেও সেটি নিয়ে সরকার উদ্যোগ নেয়নি। “কাউকে পেছনে ফেলে নয়” এসডিজি’র এ মূলমন্ত্রটি তখনি বোঝা যেত যখন দেশের জনগণ কে কোন অবস্থানে আছি তা নির্ধারিত হতো। কিন্তু দেশে আদিবাসীদের সঠিক সংখ্যা আমরা এখনও জানি না। আদিবাসীদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার আলাদা করে কত, তা সরকারের কাছে সঠিক হিসেব নেই। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উপার্জন ও অর্থনৈতিক অবস্থার হিসেব আলাদা করে সরকার বের করার উদ্যোগ এখনও নেয়নি। যদি তা থাকত, তাহলে আজ আদিবাসীদের মধ্যে কত শতাংশ দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে এলাকাভেদে তা জানা যেত এবং সে অনুযায়ী তাদের মাঝে করোনাকালীন ত্রাণ ও সরকারি সহায়তা পৌাঁছে দেয়া সম্ভব হত! পরিকল্পিত কাজ বাস্তবায়ন আসলে এমনি হওয়া উচিত ছিল যা হয়নি।
আজ হাজার হাজার আদিবাসী পরিবার কর্মহীন, খাদ্যহীন, কেউ কেউ আধ বেলা খেয়ে বা না খেয়ে, আবার কেউ কেউ পাহাড়ের আলু, কচু খেয়ে যে যেভাবে পারে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে! খেটে খাওয়া মানুষের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। গার্মেন্টস ও কারখানার আদিবাসী কর্মীরা অনেকেই চাকরিচ্যূত হয়ে এলাকায় ফিরেছে। এছাড়া শহরের বিউটি পার্লারগুলোর হাজার হাজার আদিবাসী মেয়েদের কাজ বন্ধ হয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। সরকারি ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা অধিকাংশ গরীব, নিরীহ, চাইতে না জানা আদিবাসী পরিবারের ঘরে পৌঁছেনি। গত ২০ এপ্রিল দিনাজপুরে শত শত আদিবাসী সরকারি কোন ত্রাণ না পেয়ে দিনাজপুর-রংপুর হাইওয়ে অবরোধ করেছিল। উত্তরবঙ্গের অনেক আদিবাসী পরিবার আগাম শ্রম বিক্রি করে মহাজনদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। অনেকেই এসময় কড়া সুদে মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিচ্ছেন, করোনা মহামারির পর শোধ করে দিবেন বলে। কিন্তু দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলা এ প্রাদুর্ভাব অসহায় আদিবাসীদের জীবন বিপর্যস্ত করে তোলেছে।
কোভিড-১৯ সম্পর্কে স্বাস্থ্যবিধি ও সচেতনতামূলক তথ্যগুলো সরকার আদিবাসীদের নিজ ভাষায় ভাষান্তর করে সচেতনতা বাড়ানোর কোন উদ্যোগ নেয়নি। বিশেষ করে পাহাড়ের আদিবাসীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে নিজেদের পাড়াগুলো লকডাউন করে ফেলে স্বেচ্ছায় এ প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষার জন্য নিজেদের আলাদা বা কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার জন্য। তাদের এসব ভাল উদ্যোগকে কোন মূল্যায়ন করা হয়নি, এমনকি নিজের উদ্যোগে করা লকডাউন পাড়াগুলোতে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হয়নি। আবার, স্থানীয় পর্যায়ে আদিবাসীরা যতটুকু কৃষিপণ্য উৎপাদন করে আয় করত আজ তার বাজার মূল্য হারিয়ে ফেলেছে। আরো অবাক করা বিষয় হল, আদিবাসীরা সারাবছর যে পরিমাণ মানবাধিকার লঙ্ঘণের শিকার হয় সেটি কিন্তু এই করোকালেও চলমান আছে। পাহাড় ও সমতলে আদিবাসীরা তাদের ভূমি দখল, উচ্ছেদ, হয়রানি, অপহরণ, হত্যাকান্ড, আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ, এসব ঘটনা এখনও ঘটে চলেছে। এছাড়াও এ করোনাকালের শুরুর দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে হাম ও অজ্ঞাত রোগে ১০ জনের অধিক শিশু মারা গেছে এবং শতাধিক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এখন করোনার প্রভাব এসে তাদের জীবনকে আরো তছনছ করে দিয়েছে। কর্মঠ আদিবাসীরা এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অনিশ্চয়তার স্বপ্ন দেখছে এসব প্রান্তিক মানুষ। এসব মানুষদের কথা গুরুত্ব দিয়ে বাজেট কেন হবে না!
ঐতিহাসিক কারণেই বাংলাদেশের আদিবাসীরা পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী। আদিবাসীদের প্রান্তিকতার সমস্যা তো রয়েছেই। গত বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছিল, ‘দারিদ্র্য হার ৪০ শতাংশ থেকে কমে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। অতি দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশ থেকে কমে ১১ শতাংশ হয়েছে।’ ‘দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন বেড়ে ১,৯০৯ ডলার হয়েছে।’ কিন্তু আমরা বিভিন্ন গবেষণায় দেখতে পাই, আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে দারিদ্র্য হার প্রায় ৬০ শতাংশের ওপরে। রাঙ্গামাটি আর বান্দরবানে দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ৬৪ শতাংশ এবং ৬৩.২ শতাংশ, সমতলের আদিবাসী অধ্যুষিত জেলা দিনাজপুরে এই হার ৬৪.৩ শতাংশ। আদিবাসীদের মাথাপিছু আয় জাতীয় গড় থেকেও অনেক কম। পাহাড়ের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ কম, সমতলের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ৪১ শতাংশ কম। সমতলের দুই-তৃতীয়াংশ আদিবাসী কার্যত ভূমিহীন (আদিবাসী নেভিগেটর, কাপেং ফাউন্ডেশন ২০১৯)। সমতলের আদিবাসীদের মতো পাহাড়ের আদিবাসীরাও আর্থসামাজিক বঞ্চনার শিকার; নানারকম মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও শিকার। সেখানে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হয়ে আরো চুক্তি বিরোধী কাজ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অসহায় আদিবাসী শিশুদের কৌশলে ধর্মান্তরিত কর্ম অব্যাহতসহ পাহাড়ে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হলেও তা পাহাড়ের মূল সমস্যা সমাধানে জোরালো নয়।
আগামী বাজেটে কি বরাদ্দ থাকছে আদিবাসীদের জন্য
সংসদে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট পেশ করা হলো সেখানে বরাবরের মতো দেশের ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী আবারো উপেক্ষিত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময়ে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন অঙ্গীকার করেছেন, তার মধ্যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে শক্তিশালী করা, আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক সকল প্রকার আইন ও অন্যান্য অন্যায় ব্যবস্থার অবসান করা এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা ইত্যাদি অন্যতম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এবং আগের বাজেটগুলোতেও এসব অঙ্গীকারগুলোর কোনটিই সুনির্ষ্টিভাবে গুরুত্ব পায়নি। বাজেট প্রক্রিয়া ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের সরাসরি অংশগ্রহণ করার কোন উদ্যোগও ছিলনা।
এই করোনাকালেও দেশের অবহেলিত আদিবাসীদের গুরুত্ব দিয়ে বাজেট তৈরি হয়নি। বিগত কয়েক বছরের ন্যায় এবারের বাজেট বক্তৃতায়ও আদিবাসীদের সম্পর্কে কোন স্পষ্ট বিবরণী, একটি আলাদা অনুচ্ছেদ/প্যারাগ্রাফ-এর উপস্থিতি ছিল না। তবে, সমতলের আদিবাসীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে প্রতিবছর “বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা” নামে যে থোক বরাদ্দ দেয়া হয় সেখানে বরাদ্দ আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৫০ কোটি টাকা, আগামী ২০২০-২১ অর্থ বছরের জন্য তা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে ৮০ কোটি টাকা। এছাড়া মৎস ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমতল ভূমিতে বসবাসরত অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ও জীবন মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সমন্বিত প্রাণি সম্পদ উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৬ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা।
সমতলের বিশ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী বরাবরই উন্নয়ন বাজেটে অবহেলিত ও বঞ্চিত থাকে। এবারও তাই হয়েছে। তাদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন এবং মন্ত্রণালয় বা খাতভিত্তিক বাজেট প্রণয়ণের দাবি করে আসছে আদিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের অঙ্গীকার করে আসছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক যে, কোনবারই এ উদ্যোগ গ্রহণে বরাদ্দ রাখা হয় না। প্রকৃতপক্ষে, সমতলের আদিবাসীদের জন্য সরাসরি কোন বাজেট বরাদ্দ নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে “সমতল ভূমিতে বসবাসরত আদিবাসীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত)” কর্মসূচীর আওতায় তাদের জন্য যে বরাদ্দ চলে আসছে। তা আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ৮০ কোটি টাকা। মাথাপিছু গড় করলে বছরে জনপ্রতি পড়বে ৪০০ টাকা। যা একেবারে নগন্য ও হাস্যকর বরাদ্দ। চলমান ২০১৯-২০ অর্থবছরে এখাতে বরাদ্দ ছিল ৫০ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪০ কোটি এবং ২০১৭-১৮ সালে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩০ কোটি। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এই থোক বরাদ্দের অর্থ বাস্তবায়নে সমতল আদিবাসীদের কোন অংশগ্রহণ বা ক্ষমতা নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন মূখ্য সচিবের অধীনে সংশ্লিষ্ট উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে উন্নয়ন মূলক প্রকল্পের অর্থ বন্টন করেন। উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণে আদিবাসীদের সংযুক্ত করা হয় না এবং তাদের মতামতও গ্রহণ করা হয় না। এছাড়াও সমতলের জন্য বরাদ্দ-এর বন্টন প্রক্রিয়ার মধ্যেও রয়েছে নানা অনিয়ম ও জটিলতা। আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দকৃত এই প্রকল্পের মধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় আদিবাসী ছাড়া অন্যান্য জনগণকেও সংযুক্ত ও বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ফলে প্রকৃত আদিবাসী উপকারভোগীগণ এ বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ বলতে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যে বরাদ্দ হয় তা বোঝে থাকি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরে আঞ্চলিক সংগঠন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সম্পাদিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ অনুযায়ী তার পরবর্তী বৎসরে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩টি জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মকান্ডের সমন্বয় সাধন এবং এই অঞ্চলের জনসাধারণের সাংস্কৃতিক উন্নয়নসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যথাযথ ব্যবস্থাদি গ্রহণের কথা রয়েছে। যেখানে ১৪টি আদিবাসী জাতিসত্তার ১০ লক্ষাধিক মানুষসহ এখন তার প্রায় সমপরিমাণ বাঙালি জনগণও সেখানে বসবাস করছে। একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এর প্লাস পয়েন্ট হল তাতে এমনিতেই কিছু বরাদ্দ এসে যায়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজন অপেক্ষা বরাদ্দ অনেক কম এবং ওখানকার আদিবাসীদের মূল সমস্যা সমাধানে নির্দিষ্ট বরাদ্দ না থাকায় আদিবাসীদের সমস্যার সমাধান না হয়ে পাহাড় আরো দিনদিন বিবর্ণ হয়ে পড়ছে।
প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়লেও আমরা দেখেছি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে গতবছরে তার আগের বছরের তুলনায় বরাদ্দ ১১৫ কোটি টাকা কমানো হয়েছিল। অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা, কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা।
কিন্তু ১১ জুন পেশ করা বাজেটে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে স্বাভাবিক হারেই বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী ২০২০-২১ অর্থ বছরের জন্য এ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে ১ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা (যার মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ৮৬৪ কোটি টাকা এবং পরিচালন ব্যয় ৩৭১ কোটি টাকা)। যদিও এ বরাদ্দ শুধুমাত্র পাহাড়ের আদিবাসীদের জন্য নয়। এই মন্ত্রণালয়ের সকল পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় এবং পাহাড়ের আদিবাসী ছাড়াও প্রায় সমপরিমাণ পুনর্বাসি বাঙালি মানুষের বাজেটও এখানে অন্তর্ভূক্ত। মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি পার্বত্যচুক্তির মাধ্যমে সেখানকার ভালমন্দ দেখার জন্য যে আঞ্চলিক পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তার জন্য আলাদা কোন বরাদ্দ নেই। তাদের বরাদ্দের জন্য মুখ চেয়ে থাকতে হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দিকে। করোনার এ ক্রান্তিলগ্নেও বাজেটের অভাবে পাহাড়ি অসহায় মানুষদের জন্য এ আ লিক পরিষদ কোন সহায়তামূলক কাজ করতে পারছে না ।
সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনি
আগামী অর্থ-বছরে সামাজিক সুরক্ষায় বাজেট ধরা হয়েছে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। যা বাজেটের ১৬.৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩.০১ শতাংশ। কিন্তু খুবই দুঃখজনক যে, সামাজিক সুরক্ষার এই বাজেটে আদিবাসীদের অগ্রাধিকার দিয়ে কোন নির্দেশনা নেই। তবে এই খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি যদি অবহেলিত ও প্রান্তিক মানুষের অবস্থার উন্নতির লক্ষ্য হয় তাহলে এখানে অবশ্যই আদিবাসীদের সরাসরি অংশগ্রহণ করানো উচিত এবং সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত।
সমতলের আদিবাসীদের জন্য ”বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা” নামে থোক বরাদ্দ ৮০ কোটি টাকা এ বেষ্টনিতে দেখানো হয়েছে। এছাড়া এবার নতুনভাবে মৎস ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমতল ভূমিতে বসবাসরত অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ও জীবন মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সমন্বিত প্রাণি সম্পদ উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৬ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা। চলতি বছরে নাকি এ খাতে ৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে যা আমরা কেউ জানিনা কোথায়, কখন খরচ করা হয়েছে। এভাবে আদিবাসীদের বাজেট বরাদ্দ পরিকল্পনায় যদি আদিবাসীদের সরাসরি যুক্ত নাকরে আমলারা নিজেরাই বরাদ্দ দেখিয়ে খরচ করে ফেলে তাহলে আদিবাসীদের দেখিয়ে শুধু বঞ্চনায় করা হবে! এবার এ খাতে নতুন করে ৪৬ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগটি প্রশংসনীয় কিন্তু এ বরাদ্দ বাস্তবায়নে অবশ্যই আদিবাসীদের যুক্ত করতে হবে এবং যাদের জন্য বাজেট তারা যেন এই সুবিধার শতভাগ পায় তার জবাবদিহিতাও থাকতে হবে। কেননা, আদিবাসীরা আমলাতন্ত্রের জটিলতার মধ্যে কতটুকু সামজিক সেবা লাভ করতে সক্ষম, তা ভাবার বিষয়। তাছাড়া স্থানীয় সরকার কাঠামোতে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। আমরা বিগত বছরে দেখেছি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী: ভিজিএফ, ভিজিডি, এফএফই, কাবিখা, কাবিটা ইত্যাদি বড় খাতগুলোতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্তি বা অভিগম্যতা খুবই কম। টিআইবি-এর একটি গবেষণায় ওঠে এসেছে, একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড পেতে নিয়মবহির্ভূতভাবে ৫০০-৫,০০০ টাকা, প্রতিবন্ধী ভাতা পেতে ১,০০০-৫,০০০ টাকা, বিধবা ভাতা পেতে ৫০০-২,০০০ টাকা, মাতৃত্বকালীন ভাতা পেতে ৫০০-৪,০০০ টাকা, ভিজিএফ/ভিজিডি ১,০০০-২,০০০ টাকা, গৃহ নির্মাণে ৬,০০০-২০,০০০ টাকা আদিবাসীদের কাছ থেকে উত্তোলন করা হয়। আদিবাসীরা অধিকাংশই প্রান্তিক ও গরীব। এমনও আদিবাসী জনগণ রয়েছে যে অভাবে বা খাদ্য সংকটে পড়ে, না খেয়ে মারা যাবে কিন্তু অন্যের কাছে হাত পাততে যাবে না। এই করোনা মহামারি সময়েও আমরা এর নজির দেখছি। তাদের কাছে এই নিয়মবহির্ভূতভাবে দেয়ার মতো অর্থ ও লবিং ক্ষমতা থাকে না বলে সরকারি সেবা থেকে তারা প্রায়শই বঞ্চিত হয়।
২০২০-২১ অর্থবছরে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ কত হওয়া উচিত
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ধরা হচ্ছে ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এ বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় বাদে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২,০৫,১৪৫ কোটি টাকা। এদেশে আদিবাসীর সংখ্যা ৩০ লক্ষ ধরা হলে আদিবাসীদের জনসংখ্যা অনুযায়ী বরাদ্দ হওয়ার কথা ৩ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। এটি জনসংখ্যা অনুযায়ী অংকের হিসাব। যেহেতু আদিবাসীরা ঐতিহাসিকভাবেই শোষণ, বৈষম্য ও মানবসৃষ্ট দারিদ্র্য ও বঞ্চনার শিকার, তাই আদিবাসীদের মাথাপিছু বরাদ্দ, জাতীয় উন্নয়ন বরাদ্দের মাথাপিছুর তুলনায় অন্তত ৩ গুন বেশি হওয়া উচিত। যেহেতু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) দর্শনানুযায়ী কাউকে পিছনে রাখা যাবে না, তাই আদিবাসী মানুষকে মূলধারার সাথে একই কাতারে আনতে হলে তাদের জন্য সমপরিমাণ বরাদ্দ দিলে হবে না। ‘ইতিবাচক বৈষম্য’ (চড়ংরঃরাব উরংপৎরসরহধঃরড়হ) নীতির আওতায় তাদেরকে অন্তত ৩ গুন বেশি বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। সে হিসেবে আমরা এবার দেশের ৩০ লক্ষ আদিবাসীদের জন্য ১১ হাজার কোটি টাকার অধিক বার্ষিক বরাদ্দ দাবি করতেই পারি।
কিন্তু ২০২০-২ অর্থবছরের বাজেটে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বাজেট ৮৬৪ কোটি টাকা এবং সমতলে থোক বরাদ্দ মাত্র ৮০ কোটি টাকা এবং মৎস ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৪৬ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা সবমিলিয়ে মোট ৯৯০ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা। যা এই করোনাকালে ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসীদের জন্য একেবারেই অপ্রতুল ও অসম্মানজনক বাজেট।
আমাদের সুপারিশমালা
বাংলাদেশে পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর, অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত-নির্যাতিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে এই করোনা মহামারি থেকে সুরক্ষা ও তাদের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে নিম্ন প্রস্তাবনাসমূহ সংশোধনী বাজেটসহ পরবর্তী বাজেটে বিবেচনা করার দাবি রাখছি:
কোভিড-১৯ মহামারির সময় ও মহামারি পরবর্তীকালে আদিবাসীদের সুরক্ষা ও তাদের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণে কমপক্ষে ১১ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক বরাদ্দদওয়া;
সমতলের আদিবাসীদের উন্নয়ন ও অংশগ্রহণমূলক বাজেট নিশ্চিতকরণে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করা;
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য খাতভিত্তিক ও মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা; সকল মন্ত্রণালয়ের/বিভাগের বাজেটে আদিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা এবং বরাদ্দের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে আদিবাসীদের সরাসরি সম্পৃক্ত করা এবং এ বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা;
জাতীয় বাজেট বক্তৃতায় আদিবাসী বিষয়ে স্পষ্ট বিবরণী রাখা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা নিরুপণ এবং বাজেট বরাদ্দ জনসংখ্যার ভিত্তিতে বৃদ্ধি করা;
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ এর পূর্ণ বাস্তবায়নে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর যথাযথ বাস্তবায়ন ও ভূমি কমিশনের কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ রাখা;
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদসমূহের বাজেট বৃদ্ধি করা। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা শক্তিশালীকরণে পর্যাপ্ত বাজেট রাখা। জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য ‘টাস্কফোর্স’ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ রাখা;
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কর্মসূচির সেবাসমূহে আদিবাসীদের অভিগম্যতা নিশ্চিত করণে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রাখা। আদিবাসীদের অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রকল্প গ্রহণ ও প্রকল্পের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাসহ জবাবাদিহির ব্যবস্থা রাখা
কোভিড-১৯ মহামারিতে কর্মহীন ও ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীদের বিশেষ প্রণোদনা রাখার ব্যবস্থা করা। দেশের প্রায় ৬০% দরিদ্র আদিবাসীদের জন্য করোনাকালে পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা রাখা;
আদিবাসী যুবদের কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। তাদের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৫% কোটা পুনর্বহাল করা। মহামারির পরবর্তী সময়ে সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে আদিবাসীদের নিজস্ব পেশা, কৃষি কার্যক্রম ও ব্যবসায় যোগদানে সহায়তা করা।
পর্যায়ক্রমে প্রত্যেকটি আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা ও আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া ও শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা;
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, ৮ম প বার্ষিকী পরিকল্পনা ও আদমশুমারি ২০২১-কার্যক্রমের সাথে আদিবাসীদের সরাসরি সম্পৃক্ত রাখা, সকল আদিবাসী জাতিসত্তার আর্থ-সামাজিক, সংস্কৃতি ও পরিচয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিভাজিত তথ্য সংগ্রহে উদ্যোগ নেওয়া এবং সকল উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাথে তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট রাখা ।
সোহেল হাজং, আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রিয় সদস্য।
১৫ জুন ২০২০।