আদিবাসী নারী, ঐতিহ্যবাহী সংষ্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস -জন হেম্ব্রম
বিশ্ব ১৯৯৪ সাল থেকে আদিবাসী দিবস পালন করে আসছে। ১৯৮২ সালের ৯ আগস্ট জেনেভায় জাতিসংঘের বৈঠকের পর আদিবাসী জনসংখ্যা বিষয়ক প্রথম ওয়ার্কিং গোষ্ঠী গঠিত হয়। বৈঠকে জাতিসংঘের সংস্থাকে আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। আদিবাসী জাতিসত্তার শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কাজ করাই এর প্রধান লক্ষ্য ছিল। যা মূলত ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালনে ৪৯/২১৪ বিধিমালায় স্বীকৃতি পায়। এই দিবস বিশ্বের ৯০ টির অধিক দেশে পালিত হয়ে আসলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। এর কারণ বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসী কথাটি উল্লেখ নেই অর্থাৎ স্বীকৃত নয়। ২০০৮ সালে বর্তমান ক্ষমতাশীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর নির্বাচনী ইসতেহারে (২৮ ক ধারায় একাধিকবার আদিবাসী শব্দটির ব্যবহার রয়েছে) আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির কথা উল্লেখ রয়েছে। সেই সাথে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক আদিবাসী উপলক্ষে দেওয়া বাণীতেও আদিবাসী আদিবাসী কথাটি উল্লেখ করেছেন এবং অধিকারের বিষয় সমূহ আলোকপাত করেছিলেন। কিন্তু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশের আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মূলত সরকারের বিভিন্ন সংশয় এবং সংকীর্ণতার জায়গা থেকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান না, তা বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। এক্ষেত্রে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র ২০০৭ অনুচ্ছেদ-৪ এবং অনুচ্ছেদ ৩৬ এর বিষয়বস্তু বিভিন্ন মহলে আলোচিত। তবে আদিবাসীরা চেয়েছে তাদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয়, চেয়েছে তাদের ন্যয্যতা ও ভূমি সুরক্ষা, সকল অন্যায়ের এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঠিক বিচার, বৃহত্তর সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চায় যার জন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা। অন্যথায় এই বৃহৎ আদিবাসী জাতিসত্তার মানুষকে পিছনে ফেলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়া অসম্ভব। আমাদের বিশ্বাস একসময় সরকার বাংলাদেশে বসবাসরতঃ সকল আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি সহ তাদের ন্যায্যতা এবং অধিকার রক্ষায় সকল পদক্ষেপ গ্রহন করবেন।
পূর্বের ন্যায় এবছরও রাষ্ট্র কর্তৃক আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাঁধা নিষেধ থাকলেও আদিবাসী জাতিসত্তার মানুষেরা নিজ উদ্যোগে ব্যপক উৎসাহ ও উদ্দিপনার সাথে পালন করেছে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে হয়েছে র্যালি, আলোচনা সভা ও ন্যায্যতার গান। এক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন গণ-সংগঠন সমূহ। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম, বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছাত্র সংগঠন সমূহ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এ সকল আন্দোলনকে বেগবান করতে বরাবর অগ্রনী ভূমিকা পালণ করে আসছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সুশীল ও প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ।
এবছর আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিলো-“ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষন ও বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা।” এক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের ঐতিহ্যগত বিদ্যা, ভাষা ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষনের বিষয় কে বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঐতিহ্যগত খাদ্যাভ্যাস সংরক্ষনে আদিবাসী নারীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। ঐতিগতভাবে গ্রামের আদিবাসী নারীরা এখনো নদী নালা খাল-বিলে শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া প্রভৃতি সংগ্রহ করে পরিবারের আমিষের চাহিদা পুরণ করে আসছে। এছাড়া প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা ডামরু, আড়হা, সাং প্রভৃতি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাবার এর যোগান পরিবারে দিয়ে আসছে। গ্রামীন আদিবাসী নারীদের দলবেধে শাক তুলতে যাওয়ার চিত্র এখনো চোখে পড়ে। তাছাড়া পাহাড় ও সমতলে বনে-জঙ্গলে যুগ যুগ ধরে বসবাসরতঃ আদিবাসী নারীরা সন্তান লালন ও পালনের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত ভেষজ ঔষুধপত্রের ব্যবহার করে আসছে। বিভিন্ন উৎস হতে আমরা জানতে পারি, বর্তমান সময়ের উল্লেখযোগ্য পরিমান ঔষুধপত্রের আবিষ্কারক হলেন আদিবাসীরা। আমাদের এলাকায় সাঁওতাল গ্রামে কারো জন্ডিস হলে কেই ডাক্তারের প্রদানকৃত ঔষুধ সেবন করেন না, এক নারী দীর্ঘ দিন থেকে বিনা পয়সায় এই রোগের চিকিৎসা প্রদান করে আসছেন। আমরা নিজ এলাকায় একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারি, পুরুষের পাশাপাশি নারীরা এই ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষন করে আসছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস এ বছর আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘এই দিনে আমরা ঐতিহ্যগত জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারীর অবদান ও ভূমিকাকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরছি। আদিবাসী নারীরাই ঐতিহ্যগত খাদ্য ব্যবস্থা এবং ঐতিহ্যগত ওষুধপত্রসহ বিশেষ জ্ঞানের ধারক। এই নারীরা নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে চ্যাম্পিয়ন। তারা পরিবেশ সংরক্ষণ ও নিজের জাতির মানবাধিকার সুরক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।’
বাংলাদেশের আদিবাসী জাতিসত্তার মানুষের বসবাস ভৌগলিক ভাবে কয়েকটি অঞ্চলে রয়েছে। উত্তরবঙ্গ তথা সমতলের (চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও,গাইবান্ধা, বগুড়া প্রভৃতি) আদিবাসী যার অন্যতম হচ্ছে সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, মাহাতো, ভুইমালী, রাজোয়ার, মুসহর, কোল, কড়া, মাল পাহাড়িয়া, মাহালী প্রভৃতি আদিবাসী জাতিস্বত্বার বসবাস রয়েছে । বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা অঞ্চলে গারো, কোচ, বর্মণ,হাজং প্রভৃতি আদিবাসদের বসবাস। সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে- জৈয়ন্তা, মণিপুরি, খাসিয়া, হাজং, সাঁওতাল প্রভৃতি আদিবাসদের বসবাস। এছাড়া বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে, যেখানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, খুমি, খেয়াং, ম্রো, প্রভৃতি আদিবাসী জাতিসত্বার বসবাস রয়েছে।
মূলত সাঁওতাল সমাজের মানুষেরা নিজেকে সান্তাল এবং আদিবাসী হিসেবে পরিচিত করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে প্রায় ৩৩ টি আদিবাসী জাতিস্বত্তার বসবাস রয়েছে। এদের রয়েছে নিজ কৃষ্টি-সংস্কৃতি, রয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী সংষ্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসব। সহরায়, বাহা, দাসাই, ফাগুয়া, মারহুল, আমলোবান, জিতিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন উৎসব এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, যা বাংলাদেশের সংস্কৃতিক বৈচিত্রতায় বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। তাদের এই ঐতিহবাহী সংস্কৃতি লালন, পালন ও সংরক্ষনে আদিবাসী নারীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদিবাসী নারীরা জন্মগত ভাবেই নাচ-গানে অত্যন্ত পারদর্শী। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী জাতিসত্বার মধ্যে বৃহত্তম(সংখ্যাগত) জাতি হল সাঁওতাল। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আমরা জানতে পারি সাঁওতারদের প্রায় ৫০ টির অধিক গানের সূর রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সকল গান বিভিন্ন উৎসব বা সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক। যার ফলে সেই সকল গান ও নাচ এর ধারার মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা। একটু স্পষ্ট করে বললে সাঁওতাল বিয়ের সময় গান করা হয় “দং” এবং এই গানের রয়েছে “দং” নাচ, অনুরুপ “লাগড়ে” গানের “লাগড়ে” নাচ, দাঁসায় গানের রয়েছে দাঁসায় নাচ অর্থাৎ প্রত্যেক গান ভিত্তিক রয়েছে আলাদা নাচের ছন্দ। এই সকল ঐতিহ্যবাহী গান ও নাচকে লালন ও সংরক্ষনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে আদিবাসী নারীরা। এক্ষেত্রে তাদের কোন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বংশ-পরম্পরায় এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম এই ঐতিহ্যবাহী গান ও নাচের চর্চা করে আসছে। বর্তমানে কিছু সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান আদিবাসীদের নাচ ও গানের চর্চার ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করলেও এই শিক্ষাটি মূলত আদিবাসীরা সমাজে বিভিন্ন উৎসব এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে চর্চার মাধ্যমে পেয়ে থাকে অর্থাৎ ঐতিহ্যগত ভাবে আদিবাসী সামাজে চর্চা হয়ে আসছে।
এখনো সাঁওতাল জাতিসত্তার মানুষেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির মাধ্যমে অতিথি বরন করে থাকে। সাঁওতালদের বাড়িতে যখন অতিথি আসে তখন বসতে দেওয়ার পর বাড়িতে অবস্থানকারী নারী “লটা” (কাঁসার তৈরি বিশেষ পাত্র) তে করে পানি নিয়ে আসে এবং অতিথিদের কর্তাকে পানি দিয়ে ডবঃ-জহার( এটি মূলত সাঁওতাল সমাজে সম্মান প্রদর্শনের এক বিশেষ পদ্ধতি যেখানে ডবঃ-জহারকারী নারী’র থেকে অতিথি বয়সে/সম্পর্কে বড় হলে ডবঃ বা প্রনাম করবেন এবং বয়সে/সম্পর্কে ছোট হলে জহার আতাং বা গ্রহণ করবেন) করে থাকে। এই পদ্ধতি যুগ-যুগ ধরে সাঁওতাল সমাজে চর্চা হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে“লটা দাঃ” এর গুরুত্ব এবং এর ব্যবহার সাঁওতাল সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়েছে। যেমন- শিশু জন্মগ্রহনের পর জানাম ছাটিয়ার( সাাঁওতাল সমাজের শিশু জন্মগ্রহনের পর ঐতিহ্যবাহী প্রথায় শুদ্ধিকরণ), বিয়ের সময় বর/কণে পক্ষকে দারাম বা বরণের সময়, দাঃ বাপলা (সাঁওতাল বিয়েতে ঐতিহ্যবাহী গুরুত্বপূর্ণ পর্ব) এর সময় “লটা” এর ব্যবহার রয়েছে। সেই সাথে খাওয়ার সময় বাড়ির কর্তাকে মূলত “লটা” তে করে পানি খেতে দেওয়া হয়। এই সকল বিষয় থেকে আমরা বুঝতে পারি “লটা দাঃ” মূলত সাঁওতাল সমাজে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এই সকল ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথা চর্চা ও লালনে রয়েছে আদিবাসী নারীর বিশেষ অবদান। অতিথি অপ্যায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যয় নারীকেই লটাতে দাঃ অতিথিদের প্রদান করতে হবে এবং প্রথমে ডবঃ- জহার প্রদান/গ্রহনকারী সাঁওতাল নারী ভূমিকাটি পালন করে, অতঃপর বাড়ির অন্যান্যরা ডবঃ- জহার প্রদান/ গ্রহন করবে। এছাড়া ছাটিয়ারের কার্য সম্পন্ন করে থাকে মূলত শিশুর “মা” এবং “দাই বুডি”( শিশু জন্ম গ্রহনের সময় যে মহিলা পাশে থাকেন- এক্ষেত্রে দাদি/নানিও হতে পারেন)।
প্রথাগত ঐতিহ্য পালনের সাথে সাথে আদিবাসীরা অত্যন্ত আনন্দ প্রিয়। যেকোন উৎসব বা সামাজিক অনুষ্ঠানের আগে সকল নারী বাড়ি-ঘর পরিষ্কার এর কাজ শুরু করেন। ছোট বেলায় মনে পড়ে মায়ের সাথে “পতাও হাসা” (আলপনা করার বিশেষ এক ধরনের মাটি) নেওয়ার জন্য মাঠে যেতাম। সেই সাথে গ্রামের সকল নারী তাদের সুবিধা মতো দিনে “পতাও হাসা” নেওয়ার জন্য মাঠে যেতেন। যদিও আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম এবং বাড়িটি ছিল মাটির। তথাপি ভাড়া বাড়ি বলে যে পরিষ্কার-পরিছন্ন এবং দেওয়াল লেপনের কাজ করা হবে না তা কিন্তু নয়। ছোটবেলাতে এটা মনে করতাম, আদিবাসী হিসেবে বছরে অন্তত একবার বাড়ি পরিষ্কার এবং দেওয়াল লেপন করতেই হবে। আমরা যেহেতু আদিবাসী তাই হয়তো মা বাড়ির দেওয়ালে আলপনা করে থাকেন। এখনো প্রত্যেক আদিবাসী শিশু-কিশোরের মনে হয়তো এই চিন্তাটা আসে যে আদিবাসী হওয়ায় বছরে অন্তত ১ বার বাড়ির দেওয়ার আল্পনা করে থাকেন নারীরা। গত ১১মে/২০২১ অফিসের কাজে “দেওয়াল আল্পনার” ভিডিও ডকুমেন্টশনের জন্য দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার মাতকুমপাড়া গ্রামে গিয়েছিলাম। বলে রাখা ভাল- এই ভিডিও ডকুমেন্টশনের কোন স্ক্রিপট আমাদের কাছে ছিলো না। আল্পনারত নারীদের যখন উপস্থাপিকা জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা এই যে দেওয়াল আলপনা করছেন এটি কোথা শিখছেন?
সাঁওতাল নারীদের সরল উত্তর “মায়ের কাছে”।
উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া নারীরা কোন প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছাড়াই কি চমৎকার ভাবে বিভিন্ন রং দিয়ে দেওয়াল আলপনা করছে। উল্লেখ্য গোটা গ্রামটিই ছিলো আলপনা করা। তারা মূলত দেওয়াল লেপনের শিক্ষাটা তার মায়ের কাছ থেকে শিখে থাকে এবং এই ভাবেই আবহমান কাল থেকে এক প্রজন্মেন পর পরের প্রজন্মের কাছে চলে আসছে। সমাজকর্মী ও গবেষক, সারা মারান্ডী উনার এক লেখাতে উল্লেখ করেছিলেন “আদিবাসী গ্রামকে দূর থেকে দেখলেই চেনা যায় যে, এটি আদিবাসী পাড়া/গ্রাম এর প্রধান কারণ প্রত্যেক বাড়িগুলোতে অলপনা করা থাকে। একজন আদিবাসী নারী তাঁর সুনিপূণ হাতের ছোয়ায় তার কল্পনায় আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্ম এর চিত্র ফুটিয়ে তুলেন দেওয়াল লেপনের মাধ্যমে।” সাঁওতালি ব্যান্ড দল “সেঙ্গেল” এর গানের ভাষায় “ফাগুন বঙ্গাই বলয়েনা, নানা হুনার বাহায়েন, অন্তর রুপতেম সাজাও রাকাপ ওড়াঃ পতাওরে” এর আভিধানিক অর্থ হল- ফাল্গুন মাসে বিভিন্ন ধরনের ফুল-ফলে ফুটে উঠে গ্রামের প্রকৃতি ফুটে ওঠে, এই ফুলের সৌন্দর্য়ের চিত্র নারী দেওয়ার আলপনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলে। আদিবাসী নারীদের জ্ঞানের বিশালতা ফুটে ওঠে এই সকল দেওয়াল অল্পনার মাধ্যমে। আদিবাসী নারীরা আজও টিকিয়ে রেখেছেন ঐতিহ্যবাহী এই সংস্কৃতিকে।
যুগ যুগ থেকে আদিবাসী নারীরা সকালে বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার করার পর যখন তারা রান্না ঘরে সকালের খাবার তৈরি করে, তার আগে অবশ্য রান্না ঘরের চুলা “তরচ” বা ছাই দিয়ে পরিষ্কার করে। এই “তরচ” বা ছাই মূলত ধানের খড় পুড়িয়ে তৈরি করে থাকে। এই ঐতিহ্যগত প্রথাটি আদিবাসী গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতেই দিনের প্রথম প্রহরে লক্ষ্য করা যায়। গ্রামের আদিবাসী নারীরা “চুলহা ছঁচ”(রান্না ঘরের চুলা “তরচ” বা ছাই দিয়ে পরিষ্কার সাঁতালি ভাষায় “চুলহা ছঁচ” বলা হয়ে থাকে) এর জন্য অলাদা পাত্রও ব্যবহার করে থাকেন।
এছাড়া আদিবাসী নারীরা পরিবারের পরিচালনায় ঐতিহ্যগত ভাবে পুরুষের পাশাপাশি সমান অবদান দিয়ে আসছে। কিন্তু বিংশ শতাব্দিতেও কৃষিকাজের ক্ষেত্রে নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। যেখানে বর্তমানে একজন পুরুষ ধান লাগানো বাবদ দৈনিক মজুরি ৪০০-৫০০ টাকা হারে পেয়ে থাকেন, সেখানে নারীরা মজুরি হিসেবে ৩০০-৩৫০ টাকা পেয়ে থাকেন। এছাড়া গারো ও খাসি আদিবাসী জাতিসত্তা বাদে নারীরা ভূমির অধিকার পায়না। আদিবাসী সমাজের নারীরা বিয়ের পর সাধারনত পুরুষের পদবী গ্রহন করেন না। কিন্তু বর্তমানে সাঁওতাল সমাজে নারীদের মধ্যে স্বামীর পদবী ব্যবহারের বিষয়টি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি সাঁওতাল সমাজের ইতিবাচক না নেতিবাচক সংষ্কৃতি পরিবর্তন তা হইতো সময় বলে দেবে। আদিবাসী নারী মানে এক প্রতিবাদী, শত বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে জানা এক চরিত্রের চিত্র ফুটে ওঠে। আশাকরি একসময় এই সকল বৈষম্যের অবসান ঘটবে।
আদিবাসী নারী, সাঁওতাল নারী নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া আলোচিত বিষয় ভারতের ১৫ তম মহামান্য রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদি মূর্মূ এর বিজয় সম্পর্কে কথা বলতে হবে। তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় পর থেকেই বিভিন্ন মহলে রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বেশ বিশ্লেষণ হচ্ছে। অনেকেই এটিকে আদিবাসীদের বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন আবার অনেকেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রদান করছেন। মূলত ক্ষমতাশীন দল “বিজেপি” চালিকা শক্তি “আরএসএস” এর নেতা মোহন ভাগবত স্বাধীনতার ৭৫ তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ১৫ আগষ্ট নাগপুরে এক অনুষ্ঠানে ‘অখন্ড ভারত’ গঠনের কথা বলেন। সেই “হিন্দু রাষ্ট্রের” প্রস্তাবিত নতুন সংবিধান এর খসড়াতে মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের ভোটাধিকার না থাকার বিষয়ে স্পষ্ট করা হয়। সেই সাথে হিন্দুত্ববাদী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল “আরএসএস” স্পষ্ট করে ২০৪৭ সালের মিশন সম্পর্কে, যা ভারতের বৈচিত্রতায় ধর্ম-বর্ণের জন্য হুমকি। এছাড়া বাংলাদেশই সহ স্বাধীন সার্বভৌম সত্তা হারানোর শঙ্কা থাকবে আফগানিস্থান, পাকিস্থান, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা। ক্ষমতাসীন বিজেপির শীর্ষ নেতারা “আরএসএস” এর এরুপ ঘোষনায় নিরবতা মূলত সম্পূর্ণ সমর্থনকে স্পষ্ট করে। এই থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদি মূর্ম অবস্থান নিয়ে আলোচনা আরো জোরালো হয়। কিন্তু আমার মতে দ্রৌপদি মূর্মূ এর এই অর্জন কে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। ১৯৫৮ সালের ২০ জুন ভারতের ওড়িশা রাজ্যের ময়ুরভঞ্জ জেলার উপরবেদা গ্রামে অতি দরিদ্র এক সাঁওতাল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, স্বামী-সন্তান হারানো আদিবাসী সমাজে বেড়ে ওঠা একজন নারীর, সেই সাথে এক স্কুল শিক্ষিকা থেকে বিশে^র সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের (জনসংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটির ওপরে) রাষ্ট্রপতি হওয়াটা আবশ্যয় এক উজ্জল দৃষ্টান্ত সকল আদিবাসী নারী তথা সমাজের জন্য। বিজেপি যদি ‘অখন্ড ভারত’ নির্মান সমর্থন করে সেখানে দ্রৌপদি মূর্মূ কিংবা অন্য যেকেউ রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করলেও নিশ্চয় সেই অবস্থান থেকে সরে আসতো না। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের সতন্ত্র বৈশিষ্ট রয়েছে, অবশ্যয় সেই দলে নেতা/নেত্রী হতে গেলে সেই বৈশিষ্টে দীক্ষিত হতে হবে এটি খুবই স্বাভাবিক বিষয়। একজন সুশিল নাগরিক হিসেবে “অখন্ড ভারতে” বিরোধিতা করা উচিৎ। তাই বলে কারো অর্জনকে ছোট করে দেখার কিছু নেই। হাজার প্রতিকূলতা অতিক্রম করে, যোগ্যতার বলেই দ্রৌপদি মূর্মূ ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতির হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর এই অর্জন ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে। তিনি শুধু আদিবাসী নারীর প্রতিনিধিত্ব করছেন না তিনি ভারতের প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সকল নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন। রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বা মতাদর্শ যাই হোক না কেন আদিবাসী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজ করবেন বলে আশা করি। বাংলাদেশের আদিবাসী নারীরাও নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে বিভিন্ন ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। গত ১৯ মে, চাকমা সম্প্রদায়ের মেয়ে শ্রাবন্তী রায় কে প্রথম নারী জেলা প্রশাসক হিসেবে দ্বায়িত্ব প্রদান করা হয়। এছাড়া নেতৃত্ব পর্যায়ে আদিবাসী নারীদের অবস্থান সমীহ করার পর্যায়ে রয়েছে। সেই সাথে আদিবাসী সমাজের বৈচিত্রপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সংরক্ষনে আদিবাসী নারীদের ভূমিকা অপরিসীম। পরিশেষে একথা বলতে চাই, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস শুধুমাত্র একটি দিবস নয়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আদিবাসীদের ন্যায্যতা ও অধিকার আদায়ে সংঘবদ্ধ হওয়া দিন।
জন হেম্ব্রম, আদিবাসী সাংস্কৃতিক কর্মী