জাতীয়

আদিবাসীদের হত্যা, নিপীড়ন ও উচ্ছেদ ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্রদের বিক্ষোভ সমাবেশ

চেলসি রেমা: আজ ৮ জুলাই ঢাকার শাহবাগে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে কেএনএফ সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক ৩ জন নিরীহ ত্রিপুরা আদিবাসীকে হত্যা, খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে ৩৭ টি আদিবাসী পরিবারের বসত ঘরে অগ্নি সংযোগ ও লুটপাট, টাংগাইলের মধুপুরে বন বিভাগের দোখলা রেঞ্জ কর্মকর্তা কর্তৃক গারো আদিবাসীদেরকে গুলি করে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আজ সকালে রাজধানীর শাহবাগে, জাতীয় জাদুঘরের সামনে এ বিক্ষোভ সমাবেশে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ। এছাড়াও বিক্ষোভ সমাবেশে সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিল ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম ও হাজং স্টুডেন্টস কাউন্সিল।

বিক্ষোভ সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন, আদিবাসী যুব পরিষদের সভাপতি হরেন্দ্র নাথ সিং, আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি অনন্ত বিকাশ ধামাই, পিসিপি ঢাকা মহানগরের সভাপতি রেংইয়ং ম্রো, বাগাছাস কেন্দ্রীয় সংসদের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক বুশ নকরেক, মানবাধিকার কর্মী মাহবুল হক , বাংলাদেশ ত্রিপুরা খ্রিস্টান স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি গৌরব ত্রিপুরা প্রমুখ।

সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ, সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ডন জেত্রা।

সভাপতির বক্তব্যে আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ বলেন ‘’সামনে একটি উৎসব থাকলেও আমরা খুশি থাকতে পারছি না। কারণ আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। হত্যা, নির্যাতন নিপীড়ন, উচ্ছেদের ঘটনা অহরহ থাকলেও সন্ত্রাসীরা ধরা পরছে না। পাহাড়ে শান্তি-চুক্তি ঠিকঠাকমত বাস্তবায়িত করা হচ্ছে না।’’

তিনি আরও বলেন ‘সাজেকে যেয়ে সবাই হাসিমুখে ছবি তুলে ঘুরে আসছে। কিন্তু কেউ কি জানতে পারছে, সেখানে যে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে বিনোদন কেন্দ্র করা হচ্ছে।’’

বাংলাদেশ ত্রিপুরা খ্রিস্টান স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন, ঢাকা মহানগরের সভাপতি গৌরব ত্রিপুরা বলেন, গত ২১ জুনের ঘটনায় আমরা আতঙ্কিত। চারিদিকে আদিবাসীদের উপর যে নির্যাতন ও হামলা বেঁচে থাকার উপায় আমরা খুঁজে পাচ্ছিনা।

তিনি রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানিয়ে বলেন, আদিবাসীদের উপর নিপীড়নকারী ও নির্যাতনকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবি করা হোক।

বিক্ষোভ সমাবেশে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী মাহবুল হক বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে ৫৪ টিরও অধিক আদিবাসী বসবাস করছে। যদি সংখ্যায় ১ জনও হয় তাহলে তার মানবাধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্টের হয়ে থাকে। কিন্তু রাষ্ট সেই সব ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ।

বাগাছাস কেন্দ্রীয় সংসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বুশ নকরেক বলেন, মধুপুরে কৃত্রিম লেক খননের কাজ ঘোষণা দেওয়ার পর আমরা কেউ ঘুমাতে পারিনা। আমরা ভাবনাই থাকি আগামীকালের সকালটা দেখবো কিনা? রাষ্ট্র নিরাপত্তার বদলে আমাদের উচ্ছেদ করে চলেছে, জুলুম করে চলেছে ।

হরেন্দ্র নাথ সিং বলেন, আদিবাসীদের উপর শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের ধরণে মধুপুরে রেঞ্জার কর্তৃক প্রকাশ্যে আদিবাসীদের গুলি করে হত্যা করার হুমকি তা মোটেও আশ্চর্যজনক নয়। আইন শৃঙ্খলাবাহিনী পোশাক পরে সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্মে আদিবাসীদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে, গুলি করে হত্যা করেছে কিন্তু ৭ বছর হয়ে গেলো তাদের কোন বিচার করা হয়নি। উল্টো আদিবাসীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে। তবে বিচারের দাবিতে আমরাও লড়ে যাব। আজীবন লড়াই চালিয়ে যাব।

পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি রেংইয়ং ম্রো বলেন, অতীতে ব্রিটিশরা যেভাবে এখানকার ভারতবর্ষের উপর অন্যায় ভাবে “ভাগ কর, শাসন কর” নীতি প্রয়োগ করেছিল ঠিক একইভাবে বাংলদেশ শাসক গোষ্ঠীও জুুম্মদের উপর উভয়নীতি প্রয়োগ করছে। যার ফলস্বরূপ সম্প্রতি কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) যে সশস্ত্র গোষ্ঠী তা লক্ষণীয়।

তিনি আরো জোর দিয়ে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সশস্ত্র গোষ্ঠী সন্ত্রাসী কার্যক্রম তা কোনো ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের শান্তি বয়ে আনবে না। যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা তাই রাজনৈতিক ভাবে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব। রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। মধুপুরের আদিবাসীদের যারা প্রকৃতিকে রক্ষা করে জীবন নির্বাহ করেন, তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করে কৃত্রিম একটা উন্নয়ন সেটাকে বাস্তবায়নের চেষ্টা তা কখনোই আদিবাসীরা মেনে নিবেনা।

আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি অনন্ত ধামাই বলেন, ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এই চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দিনদিন অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে।
তিনি আরো বলেন, যেভাবে একটি স্বাধীন দেশে দিন দুপুরে টাংগাইল মধুপুরে বন বিভাগ কর্মকর্তা কর্তৃক সেখানকার আদিবাসীদের খুমকি দেওয়া হয় তা মোটেও কাম্য নয়।

উল্যেখ্য, গত ২১জুন রাঙামাটির বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ৩জন ত্রিপুরা ব্যক্তিদের গুলি করে হত্যা করে এবং ২জন শিশু গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আহত হয়। এই সস্ত্রাসীদের হুমকিতে বড়থলি ইউনিয়নের ৩টি পাড়ার ৯২টি পরিবার পালিয়ে গ্রাম ছেড়ে বান্দরবানের বিভিন্ন পাড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে।

৫ জুলাই খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ির মাইসছড়ি ইউনিয়নের জয়সেন পাড়ায় স্থানীয় বাঙালী সেটেলার কর্তৃক আদিবাসী বসতিতে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সকালে আদিবাসী পুরুষরা যখন পাশের বাজারে গেছেন তখন সেটেলারদের ২শ জনের একটি দল ধারালো অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে জয়সেন পাড়ায় আদিবাসী নারী ও বসতিতে হামলা চালায়। এ সময় আদিবাসিদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট করে অন্তত ৩৭টি বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীদের বর্ণনা অনুযায়ী ঘটনার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকলেও তারা হামলাকারীদের প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ জানিয়েছে স্থানীয়রা। পরবর্তীতে হামলাকারীদের সাথে স্থানীয় আাদিবাসী জনগোষ্ঠীদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে এবং হামলাকারীরা চলে যায়।

৬ জুলাই, বুধবার মধুপুরে গারো আদিবাসীদের জমি চাষে গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়ে বাধা দেয়া হয়। ঘটনার সময় একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় টাঙ্গাইল বনবিভাগের দোখলা রেঞ্জ কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বন্দুক হাতে নিয়ে জমিতে চাষ করতে বাঁধা দিচ্ছে। এ সময় কৃষক কৌশলা নকরেক ও তাঁর পরিবার এর প্রতিবাদ করতে থাকেন।

অপরদিকে সংবাদপত্রে সিপিবি, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন ও বিশিষ্টজনেরা পৃথক বিবৃতি দিয়ে মহালছড়িতে আদিবাসীদের বসতিতে অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের দ্রুত বিচার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছে।

Back to top button