অন্যান্য

অনিশ্চিত বাস্তবতা থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করা সহজ ছিলনাঃ বিনোতাময় ধামাই

“আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের এমন একটি সমাজ ও পরিবার থেকে উঠে এসেছি যেখানে ‘অনিশ্চয়তা’ সবসময় নিত্যসঙ্গী। একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক অস্থিরতাতো আছেই তার সাথে নানা পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার সাথে লড়াই করে এই পিএইচডি’র যাত্রা সম্পন্ন করা সহজ ছিল না। একথাগুলো বলছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অষ্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে সাম্প্রতিক পিএইচডি সম্পন্ন করা আদিবাসী অধিকার কর্মী বিনোতাময় ধামাই । তিনি অষ্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কলেজ অব এশিয়া এন্ড প্যাসিপিক এর অধীনে স্কুল অব রেগুলেশন এন্ড গ্লোবাল গভর্নমেন্ট থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। তাঁর পিএইচডি’র বিষয় ছিল- “Whose Peace Agreement? Indigenous Peoples Perspectives on Bangladesh’s CHT Accord 1997.” 

বিনোতাময় ধামাই পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার ত্রিপুরা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর একজন সদস্য । পাহাড়ের অস্থির পরিস্থিতিতে তাঁর শরণার্থী জীবনের অভিজ্ঞতা তো আছেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগে পড়াশোনা করা বিনোতাময় ধামাই একসময় নেতৃত্ব দিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছা্ত্র পরিষদকে। পাহাড়ের মাঠে-ঘাটে নানা জায়গায় এ সংগঠনের হয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন জুম্ম জনগণের আধিকারের জন্য। ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার কাজ করে তিনি পালন করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। অন্যদিকে তিনি কাজ করেছেন বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদেও। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের আওতাধীন আদিবাসী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সংস্থা এমরিপ (এক্সপার্ট মেকানিজম অন দ্যা রাইট্স অফ ইন্ডিজেনাস পিপলস) এর সাতজন সদস্যের একজন এবং এশিয়া অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্য থেকে তিনিই প্রথম সদস্য। এছাড়া এই এমরিপ এর সভাপতি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এর আগে তিনি এশিয়া অঞ্চলের আদিবাসীদের সংগঠন এশিয়া ইন্ডিজেনাস পিপলস প্যাক্ট এর নির্বাহী সদস্য এবং জাতিসংঘের ভলান্টারি ফান্ড ফর ইন্ডিজেনাস পিপলস-এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন । তাছাড়া এর আগেও তিনি জাতিসংঘের এমরিপ ও আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের এশিয়া আদিবাসী ককাসের সমন্বয়কারী হিসেবে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহু সংগঠনে বিভিন্ন পদে দায়িত্বের সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

প্ল্যাকার্ড হাতে ড. বিনোতাময় ধামাই

পিএইচডি’র বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আইপিনিউজকে বিনোতাময় ধামাই বলেন, “আমার মূল বিষয় ছিল আদিবাসীদের সাথে রাষ্ট্রের “পাওয়ার শেয়ারিং”। তত্ত্বীও দৃষ্টিকোণ থেকে আমি ভূমি অধিকার, বেসামরিকীকরণ ও সুশাসন এই তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আমার অভিসন্ধর্ভে আলোচনা করেছি। আমি বিশ্বাস করি আমার এই গবেষণা এসব বিষয়ের উপর আগামী গবেষকদেরকে আরো নতুন দ্বার উন্মুক্ত করে দিবে এবং অণুপ্রাণিত করবে।”

একসময় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদে নেতৃত্বে দিয়ে এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে আদিবাসী অধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, “আমি দেখেছি যে, বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকার বাস্তবতা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে তেমন এডভোকেসী হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়েছে তবে তা সংগঠিত নয়। সেক্ষেত্রে আমি কাজ করবার চেষ্টা করছি। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন আদিবাসী হিসেবে আমি বলব, আমাদের একটি ইতিবাচক দিক আছে। সেটি হল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। যদিও এই চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তারপরেও এই চুক্তিতে আমাদের সংস্কৃতি, ভূমি, ঐতিহ্য, ভাষা, প্রশাসনিক ক্ষমতা এসব কিছু পার্বত্য চুক্তিতে সন্নিবেশিত রয়েছে। এখন এগুলো কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তার জন্য আমাদেরকে কাজ করতে হবে।”

তিনি আরো বলেন, “পার্বত্য চুক্তি নিয়ে আমাদের অনেক আশা, স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা ছিলো । কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। আদিবাসীদের নিয়ে এ ধরণের প্রতারণা কম-বেশি অনেক দেশে দেখা যায়। তবে আমাদের প্রতি যে প্রতারণা সেটা অনেক বেশি পরিমাণে হয়ে যাচ্ছে। আমি দেখেছি যে, জাতিসংঘের নানা ফোরামে কানাডা’র আদিবাসীরা যদি সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে তখন কানাডার সরকার সেটিকে আন্তরিকভাবে নেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা হয় উল্টো। আমাদের আদিবাসী নেতারা যখন আন্তর্জাতিক ফোরামে আদিবাসীদের মানবাধিকার এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো কথা বলে তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে টার্গেট করা হয়। তবে আমি আমার জায়গা থেকে বাংলাদেশের আদিবাসীদের সংগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন অধিবাসী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বাস্তবতা এবং প্রয়োজনীয়তাকে কে নানা পরিসরে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি এবং করে যাচ্ছি।”

জাতিসংঘের একটি অধিবেশনে বক্তব্য প্রদানের সময় বিনোতাময় ধামায়।

পিএইচডি সম্পন্ন করার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পিএইচডি জার্নি একটি ইমোশনাল জার্নি। এখানে উত্থান-পতন তো আছেই। তবে পিএইচডি সম্পন্ন করতে পারার অনুভূতি কেবল ব্যক্তিগত নয়, একটি সামগ্রিক সফলতাও। এখানে পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন পরিস্থিতি যেমন রয়েছে, তেমনি বন্ধু-বান্ধব এবং শুভাকাংখীদের সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। আমার ক্ষেত্রেও তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে অভিসন্ধর্ভ লেখা পর্যন্ত আমাকে বহুজন সহায়তা করেছেন। আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি এমন একটি সমাজ ও পরিবার থেকে উঠে এসেছি যেখানে আমরা সবসময় একটি অনিশ্চিত বাস্তবতার মধ্যে থাকি। সেখান থেকে উঠে এসে পিএইচডি সম্পন্ন করা এত সোজা নয়।”

যারা নানাভাবে সহযোগীতা করেছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন, “পাহাড় থেকে উঠে এসে আমি আন্তর্জাতিক নানা পরিসরে কাজ করার সুযোগ পেলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী তথা সমগ্র বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার, সরকারের সাথে আদিবাসীদের চুক্তি নিয়ে কাজ করার যে দর্শন, আদর্শ ও অনুপ্রেরণা আমি পেয়েছি তা হলো পার্বত্য চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা স্যারের কাছ থেকে। আমি তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”

জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক এক্সপার্ট ম্যাকানিজম এর একটি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার সময়ে বিনোমাতয় ধামাই।

আদিবাসী তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের একটি প্রজন্ম গড়ে উঠছে সেটি কেবল চাকুরীমুখী। কিন্তু তারা কি ভাবছে, সে যাদের চাকুরী করছে তারা আমাদের আদিবাসী জাতি, সংস্কৃতি ও নিজের পরিচিতি নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারকে পদদলিত করে কীভাবে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে? এই প্রজন্মকে অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াতে হবে, চিন্তা করতে হবে, একজন আদর্শবান ব্যক্তি হয়ে উঠতে হবে। সরকার এযাবৎ পর্যন্ত যেটি করে এসেছে সেটি হল ‘এসিমিলেশন পলিসি’। আমরা কেউ চাইনা সরকারের এই নীতির কারণে আমাদের ভাষা, শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি মিশে যাক, আমরা ধ্বংস হয়ে যায়। আমি নিজেও এটি চাইনা বলেই আজ নানা ফোরামে আমাদের মানবাধিকারের কথা বলছি, আমাদের বাস্তবতাকে গঠনমূলকভাবে তুলে ধরছি যেন আমাদের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হয়।”

আদিবাসী তরুণদের প্রতি তাঁর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রথমত তরুণদের জন্য আমাদের প্রথম পরামর্শ হল জ্ঞান অর্জন। এখন পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে চতুর্দিক দিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে আমরা যেন টিকে থাকতে পারি এবং লড়াই করতে পারি তার জন্য সক্ষম হয়ে উঠতে হবে। দ্বিতীয়ত, তরুণদেরকে অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠতে হবে। মানবসত্তার একজন সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক জীব হিসেবে রাজনৈতিকভাবে সচেতন না হওয়ার ক্ষেত্রে আমি ব্যর্থতা দেখি। কেননা, নিজের জাতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সমাজ ও আদিবাসীদের সামগ্রিক বাস্তবতা নিয়ে যদি কোনো সচেতনতা না থাকে তবে সেখানে কীভাবে অবদান রাখবো তা আমরা নির্ধারণ করতে পারবো না। ‍তৃতীয়ত, আমি তরুণ প্রজন্মকে গবেষণা নিয়ে পড়াশোনা এবং কাজ করার উপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানাবো। কেননা, যেভাবে শাসকগোষ্ঠী আমাদের উপর আগ্রাসন জোরদার করছে তাতে যদি আমরা গবেষণার মাধ্যমে সেসব নিয়ে ডকুমেন্টেশন না করি তবে পরবর্তীতে সবকিছু হারিয়ে যাবে, এবং আগামী ৫০ বছরে আমরা আমাদের পরিচিতি নিয়ে থাকতে পারবো কিনা তা খুবই আতংকিত একটি বিষয় ।”

চলমান সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কেবল এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে কথা বললে হবে না। এই প্রকল্পের কারণে আদিবাসীদের ‍উপর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত ও মানবাধিকার সম্পর্কিত কী প্রভাব পড়ছে তা তরুণ আদিবাসীদেরকে গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। তবেই আমাদের দাবীগুলো আরো বেশি মূল্যায়িত হবে এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন এসব নিয়ে জানতে পারে তা যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে ।”

Back to top button