মতামত ও বিশ্লেষণ

বান্দরবানের ম্রো জনগোষ্ঠী কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মানুষ নয়?

(১)
বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার তিনটি গ্রাম, লাকম ম্রো পাড়া,জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া,রেংয়ান ম্রো পাড়া। এই তিনটি গ্রামের মানুষের জুমের ফলন্ত ফসল আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে আপনারা খবরের কাগজে দেখেছেন, সেখানে রাবার চাষ করবে বলে একটি কোম্পানি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে পাহাড়ের বন। সাথে পুড়েছে পাহাড়ে বসবাসকারী আদিবাসী মানুষের চাষের ফলন, ওদের জীবন ধারণের একমাত্র উপায়। তিনটি গ্রামের চল্লিশটি পরিবারের এখন না আছে খাবার মতো শস্য, না আছে পানীয় জল। আর ওদের হাতে এমন কোন টাকা পয়সা নেই যে ওরা কিনে খাবে। এখন এই পরিবারগুলি সামান্য কিছু লতাপাতা সিদ্ধ করে প্রাণ ধারণ করছে।

আমরা তো সবাই মোটাদাগে নিয়মিতই বলি যে প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষা করতে হবে। মহাশ্বেতা দেবী উপন্যাস লিখেছেন বিরষা মুন্ডা বা বিরষা ভগবানকে নিয়ে। সেই উপন্যাস পড়ে অনেক তরুণকে আমি অরণ্যের অধিকার নিয়ে কথা বলতে শুনেছি। অনেককে আবার মায়াভরা কণ্ঠে ‘আহা পাহাড়ের লোকজন কতো ভাল’ এইরকম করে মিষ্টি সহানুভূতিও শুনেছি। এইগুলি কথার যে মূল্য নাই সেকথা বলি না। কিন্তু পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষের ভূমির অধিকার সেটা আপনাদের সহানুভূতি-নিরপেক্ষ একটা অধিকার। সেইটা যদি আপনারা একটু বুঝতে চেষ্টা করতেন তাইলে পাহাড়ি আদিবাসী মানুষের উপর চলমান নির্যাতন অনেকখানিই কমে যেতো।

পাহাড়ের মানুষ ওদের ভূমির ব্যবহার আর আমাদের সমতলের মানুষের ভূমির ব্যবহার এই দুইটার ধরন ঐতিহাসিকভাবে ভিন্ন ধরনের। সমতলের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরনও ভিন্ন ভিন্ন। আমাদের এই অঞ্চল যখন চূড়ান্তভাবে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে গেলো- আজকের বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভারত, পাকিস্তান সবাই- তখন ঔপনিবেশিক শাসকরাও ঠিকই উপলব্ধি করেছিল এই ভিন্নতা। ফলে ওরাও আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলির জন্যে সমতলের আইনের বাইরে ভিন্ন এক সেট বিধান তৈরি করলো। পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন নামে সেইসব বিধান এখনো কার্যকর আছে। এইসব বিধান আর সেই সাথে ঐতিহাসিক ভিন্নতা, সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরণের ভিন্নতা সব কিছু মিলিয়ে পাহাড়ের ভূমি ব্যবস্থা আর ঢাকা দিনাজপুর বা ফরিদপুরের ভূমি ব্যবস্থাপনা কখনোই একরকম ছিল না। সুতরাং পাহাড়ে আদিবাসীদের ভূমি অধিকারের প্রশ্নটি আপনি যদি সমতলের সাথে একরকম করে মিলিয়ে দেখেন তাইলে সেখানে অন্যায়ই হয়।

(২)
সারা দুনিয়াতেই আদিবাসী মানুষের ভূমির অধিকার নিয়ে এই সংগ্রামটা চলে আসছে। এখন আদিবাসী বললেই একদল লোক আঁতকে ওঠেন, ওদের জন্যে বলি। আদিবাসী কথাটার মানে হচ্ছে সেইসব সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী যাদের সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এবং ভূমি ব্যবহার ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরণ সংখ্যাগুরুর চেয়ে ভিন্ন এবং ওরা সেটা বজায় রাখতে চায়। পৃথিবীর নানা দেশে এইরকম জনগোষ্ঠীর অধিকার স্বীকৃতি লাভ করেছে, আমরা চাই যে বাংলাদেশেও এই অধিকার স্বীকৃতি লাভ করুক। কেননা এটা একটা ন্যায্য অধিকার। আমাদের এখানে ম্রো জনগোষ্ঠী এবং অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠী একেকটা কমিউনিটি হিসাবে ভূমির ব্যবহার করে আসছে বহুযুগ আগে থেকে। ওদের এই অধিকার থেকে ওদেরকে চট করে বঞ্চিত করা তো ন্যায় নয়।

বান্দরবানের পাহাড়গুলি যে রাবার চাষের জন্যে বরাদ্দ দিয়ে দেয়, আর যেভাবে এইসব বরাদ্দ হয় এটা তো ঠিক না। সংখ্যায় কম হলেও এইসব জনগোষ্ঠীর মানুষদের তো অধিকার আছে নিজেদের মতো করে নিজেদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। সেই অধিকারের ব্যাত্যয় হয় এমন কোন সিদ্ধান্ত একান্ত যদি নিতেই হয় সেটা তো ক্ষতিগ্রস্ত কমিউনিটির সাথে আলাপ করে, ওদের জন্যে বিকল্প ব্যবস্থা করে, যাতে পরিবেশ ও জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ধরন নষ্ট না হয় সেগুলি নিশ্চিত করেও নেওয়া যায়। একটা দুইটা বাণিজ্যিক কোম্পানির লাভের জন্যে এইরকম একেকটা রাজনৈতিক ও নীতিগত সিদ্ধান্ত কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তা মিলে নিয়ে ফেলবেন সেতার ফল তো ভাল হতে পারে না।

লামা উপজেলায় দেখেন এখন কি অবস্থা হয়েছে। ঐ তিনটা গ্রামের মানুষের জীবন ধারণের উপায় কেড়ে নিলেন আপনারা। ফলাফল হচ্ছে যে এখন এই গ্রামগুলির মানুষেরা ক্ষুধার্ত দিন কাটাচ্ছে। আমার বন্ধু দিপায়ন খিসা, রুপম চাকমা এবং আরও অনেকে এইসব ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে চেষ্টা করছেন। সেটা একটা জরুরী কাজ। আপাতত ওদের জন্যে খাবার পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা তো জরুরী। কিন্তু সেই সাথে এটাও কি আমাদের চিন্তা করা উচিৎ নয় যে কেন আমরা এইসব মানুষকে এইরকম বিপন্ন অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছি কিছুদিন পরপর? এই রাষ্ট্র কি ওদের নয়? বান্দরবানের ম্রো জনগোষ্ঠী কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মানুষ নয়? সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদ কি ওদের জন্যে প্রযোজ্য নয়?

(৩)
আমি জানি আদিবাসী শব্দটা শুনলেই অনেকে রেগে যান। কেউ কেউ বলেন যে সংবিধানে তো আদিবাসী কথাটা নাই। ঠিক আছে, সংবিধানে আদিবাসী কথাটা নাই। কিন্তু সংবিধানে কি বেঁচে থাকার অধিকার সংরক্ষিত নয়? সংবিধানে কি পেশা ও বৃত্তির অধিকার সংরক্ষিত নাই? সংবিধানে কি সম্পদের মালিকানার অধিকার সংরক্ষিত নাই? সংবিধান কি রাষ্ট্রের উপর মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, অন্ন বস্ত্র বাসথান এইসব নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে আরোপ করা হয়নি? সংবিধানের একটা বিশেষ্য সর্বনাম বা বিশেষণ ব্যাত্যয় হলে রেগে ওঠেন, তাঁর আগে যে জীবন ধারণের অধিকার রাষ্ট্রের দায়িত্ব এইসব গুরুগম্ভীর অন্যান্য পদ আছে সেগুলি আগে নিশ্চিত করতে হবে না?

আমরা সংখ্যাগুরু হয়েছি বলে এইসব জনগোষ্ঠীর জীবন ধারণের উপায়টুকুও কেড়ে নিব? এইটা কিরকম কথা? আরে অন্যসব কথা বাদ দেন- বাদ দেন আদিবাসী অধিকার বা ঐসব নানা কথা। কিছু লোক একটা পাহাড়ে বাস করে আর সেই পাহাড় ও অরণ্য থেকে ওদের জীবন ধারণ হয়। সেই লোকগুলির জীবন ধারণের ব্যবস্থা না করে আপনি অরণ্যে আগান লাগিয়ে দিতে অনুমতি দিচ্ছেন বাণিজ্যিক কোম্পানিকে কেবল মুনাফার জন্যে? এটা কি ন্যায় হচ্ছে?

এই অধীন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মত প্রকাশ করছে- এটা অন্যায় হয়েছে। অন্যায় হয়েছে। অন্যায় হয়েছে। এই অন্যায়ের প্রতিকার দাবী করি। দাবি করি সকলের কাছে।


ইমতিয়াজ মাহমুদের ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত

Back to top button