প্যারিসের উপকণ্ঠে পাহাড়ের ঘুমপাড়ানি গান: তুফান চাকমার ১ম একক চিত্র প্রদর্শনী

শিল্প ও সংস্কৃতির বিশ্বপীঠ ফ্রান্সের প্যারিসের অদূরে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা মনোরম শহর মোরেট-লোইং-এট-অরভান-এর রোল্যান্ড ড্যাগনাউড মিলনায়তনে শেষ হলো তরুণ চিত্রশিল্পী তুফান চাকমার প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী। দুই দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল “Lullabies of the Hill” বা “পাহাড়ের ঘুমপাড়ানি গান”—যা ছিল এক ধরনের নিঃশব্দ আর্তনাদের চিত্ররূপ, ইতিহাস আর সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জুম্ম জীবনের এক ভিজ্যুয়াল ক্যানভাস।
প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল মোট ৩০টি শিল্পকর্ম, যার মধ্যে ছিল জলরং, স্কেচ, তেলরং ও ডিজিটাল পেইন্টিং। দর্শকদের জন্য ছিল একটি অ্যানিমেশন ভিডিওও। আয়োজক ছিল ‘লা ভোয়া দো জুম্ম’ (La Voix des Jumma বা ‘জুম্মদের কণ্ঠস্বর’) নামক ফ্রান্সে বসবাসরত আদিবাসীদের একটি সংগঠন। একাধিক দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নিলেও, এটি ছিল তুফানের প্রথম একক প্রদর্শনী—তা-ও আবার শিল্পের রাজধানী ফ্রান্সে। তাই এটি ছিল তাঁর জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
গত ৭ জুন শনিবার, এ আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সার্কেলের রানী ও উপদেষ্টা ইয়ান ইয়ান এবং উপস্থিত ছিলেন মেয়র ডিক্রান জাকিওসিয়ান, ফ্রান্সে বসবাসরত জুম্ম কমিউনিটির সদস্যরা। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন শিল্পী তুফান চাকমা, যিনি তার প্রতিটি শিল্পকর্মের অন্তর্নিহিত গল্প, রঙের ব্যবহার ও প্রতীকী ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেন সমাপ্তি চাকমা বগ্নি। এই প্রদর্শনী ছিল কেবল একটি ভিজ্যুয়াল আয়োজন নয়- বরং জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয়ের এক শক্তিশালী দলিল।
চিত্রশিল্পী তুফান চাকমা জানান, এই এক্সিবিশন শুধু আমার ব্যক্তিগত অর্জন ছিল না, বরং ছিল আমাদের অস্তিত্বের সংকট, পাহাড়ের নিঃশব্দ আর্তনাদ আর প্রজন্মের জমে থাকা বেদনার প্রতিধ্বনি। দূর দেশে দাঁড়িয়ে আমি তুলে ধরেছি সেইসব না-বলা গল্প, যেগুলো পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে নীরব যন্ত্রণার হাহাকার হয়ে, যুগ যুগ ধরে অবহেলিত ও উপেক্ষিত হয়ে।
এছাড়া আয়োজনে জুম্মদের মানবাধিকার, ঐতিহ্যগত সংগ্রাম এবং শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে অধিকারের দাবি তোলেন বক্তারা।
পরদিন ৮ জুন, রবিবার সকাল ১১টায়, একই ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয় জুম্ম জনগণের মিলনমেলা ও মুক্ত আলোচনা। উপস্থিত ছিলেন ‘ লা ভোয়া দো জুম্ম মুখপাত্র বাপ্পি চাকমা, সভাপতি রেমি ফ্লেগিয়ের, সাধারণ সম্পাদক পার্থ দেওয়ান সহ কমিঊনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ । রবিবারের মুক্ত আলোচনায় উঠে আসে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও কৌশল। আলোচকেরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ করে জাতিসংঘের আদিবাসী ফোরামে জুম্ম জনগণের অধিকারের বিষয়টি আরও গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপনের ওপর জোর দেন। তুফান চাকমার শিল্পকে একটি শক্তিশালী প্রতিবাদমাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা জুম্ম চেতনা ও নিপীড়নের ইতিহাসকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে সক্ষম। ‘লা ভোয়া দো জুম্ম’ এর সাধারণ সম্পাদক পার্থ দেওয়ান তাঁর বক্তব্যে রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতর থেকেই শান্তিপূর্ণ উপায়ে অধিকার আদায়ের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। আলোচনা শেষে দুপুরের পর আয়োজন করা হয় এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সংগীত, নৃত্য ও সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ‘লা ভোয়া দো জুম্ম’ এর নির্বাহী সদস্য রিগ্যান চাকমা।
খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালার উদালবাগানে জন্ম নেওয়া তুফানের ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি বেশ ঝোঁক। ২০১২ সালে উদাল বাগান হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন তুফান। এরপর খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে ভর্তি হন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পেইন্টিংয়ে ভর্তি হন। ২০২৩ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন তুফান। এরপর আবেদন করেন Erasmus Mundus স্কলারশিপের জন্য। ফুল ফান্ডেড সেই স্কলারশিপের অধীনে বেলজিয়ামের লুকা স্কুল অব আর্টস, ফিনল্যান্ডের আলটো ইউনিভার্সিটি আর পর্তুগালের ইউনিভার্সিটি অব লুসোপনায় অ্যানিমেশন বিষয়ে দুই বছর মেয়াদি মাস্টার্সের সুযোগ পান তুফান । বর্তমানে তিনি ফিনল্যান্ডে মাস্টার্সের সেকেন্ড সেমিস্টারে অধ্যয়নরত।