নারী দিবসঃ সমাজের সংস্কার নাকি বিপ্লবী পরিবর্তন
![](https://ipnewsbd.net/wp-content/uploads/2020/03/s-1.png)
আন্তর্জাতিক নারী দিবস। পৃথিবীর সব নারীর অধিকার রক্ষায় ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয় এবং তা যথাযথভাবে পালনের জন্য পৃথিবীর সব রাষ্ট্রকে আহ্বান জানানো হয়। প্রতি বছর সারা বিশ্বে ৮ মার্চ একটি স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে পালিত হয়ে আসছে। কোনো কোনো দেশে দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবেও পালিত হয়। যেমন- রাশিয়া, কিউবা, ভিয়েতনাম, ইউক্রেনসহ বেশ কয়েকটি দেশ। আবার চীন, মেসিডোনিয়া, নেপাল ও মাদাগাস্কারসহ অনেক দেশে এ দিনটিতে কেবল নারীরা সরকারি ছুটি ভোগ করেন। যদিও বাংলাদেশে এ দুটি ব্যবস্থার কোনোটিই নেই; তবে র্যালি, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের মধ্যে দিনটি পালিত হয়ে আসছে।
আজ সারা পুঁজিবাদী বিশ্ব ঘটা করে যে নারী দিবসটি পালন করে তার সৃষ্টি কিন্তু নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের নিরন্তর সংগ্রামে। নারীরা প্রাথমিকভাবে যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে তখন সেখানে মজুরি বৈষম্য ছিল, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট ছিল না, কাজের পরিবেশও ছিল অমানবিক। এসব অরাজক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে নারী শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে পড়ে। ১৮৫৭ সালে আমেরিকার নিউইয়র্কের রাস্তায় নামেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা, প্রতিবাদী মিছিল বের হয়; দমন-নিপীড়নের জন্য সে মিছিলে গুলি চালাতে দ্বিধা করেনি সে সময়কার শাসকগোষ্ঠী। ‘১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্রেট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হল। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন।
এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সমঅধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই এ দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ।’
তবে এর গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। নারী শ্রমিকদের কিছু সুনির্দিষ্ট দাবি-দাওয়া দিয়ে এ আন্দোলনের সূচনা হলেও এখন তা সব নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। পুঁজিবাদ যে কোনো সমস্যার আপাত সমাধান দেয়, তবে স্থায়ী সমাধান দেয় না। এই পুঁজিবাদী সমাজ হতে স্থায়ী সমাধান আশা করাটাই হবে বৃথা। তাই প্রতি বছরই পুঁজিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে নারী সমাজের অবস্থান বিবেচনা করে জাতিসংঘ দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে। বছর অনুযায়ী প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন- ১৯৯৬ সালে প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, ‘অতীত উদযাপন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’।
১৯৯৭ সালে ‘নারী ও শান্তি’; ১৯৯৯ সালে ‘নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত পৃথিবী’; ২০০০ সালে ‘শান্তি স্থাপনে একতাবদ্ধ নারী’; ২০০১ সালে ‘নারী ও শান্তি : সংঘাতের সময় নারীর অবস্থান’; ২০০২ সালে ‘আফগানিস্তানের নারীদের বাস্তব অবস্থা ও ভবিষ্যৎ’; ২০০৩ সালে ‘লিঙ্গ সমতা ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’; ২০০৪ সালে ‘নারী এবং এইচআইভি-এইডস’; ২০০৫ সালে ‘লিঙ্গ সমতার মাধ্যমে নিরাপদ ভবিষ্যৎ’; ২০০৬ সালে ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী’; ২০০৭ সালে ‘নারী ও নারীশিশুর ওপর সহিংসতার দায়মুক্তির সমাপ্তি’; ২০০৮ সালে ‘নারী ও কিশোরীদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ’; ২০০৯ সালে ‘নারী ও কিশোরীদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে নারী-পুরুষের একতা’; ২০১০ সালে ‘সমান অধিকার, সমান সুযোগ- সকলের অগ্রগতি’; ২০১১ সালে ‘শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ’; ২০১২ সালে ‘গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন- ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সমাপ্তি’; ২০১৩ সালে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়’; ২০১৪ সালে ‘নারীর সমান অধিকার সকলের অগ্রগতির নিশ্চয়তা’; ২০১৫ সালে ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবতার উন্নয়ন’; ২০১৬ সালে ‘অধিকার মর্যাদায় নারী-পুরুষ সমানে সমান’; ২০১৭ সালে ‘নারী-পুরুষ সমতায় উন্নয়নের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্বে কর্মে নতুন মাত্রা’; ২০১৮ সালে ‘সময় এখন নারীর : উন্নয়নে তারা, বদলে যাচ্ছে গ্রাম-শহরে কর্ম-জীবনধারা’; ২০১৯ সালে ‘সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু করো, নারী-পুরুষ সমতার নতুন বিশ্ব গড়ো’ এবং ২০২০ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় হল, ‘প্রজন্ম হোক সমতার : সকল নারীর অধিকার’।
গত ২৫ বছর ধরে অনেক সুন্দর সুন্দর প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে এর কোনোটিই সফলতার মুখ দেখেনি। কিছু কিছু পরিবর্তন হয়েছে বলা যায়। সামগ্রিকভাবে এখনও কোন পরিবর্তন হয়নি। সেজন্য নারী বরাবরের মতোই থেকে গেছে অধিকারবঞ্চিত, ক্ষেত্রবিশেষে আরও অধিকতর। এর কারণ হল, আমাদের মননে যা ক্রিয়াশীল তা হল নারীকে বাঁচিয়ে রাখা, অধিকার না দেওয়া এবং নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে না পারা। এ সমাজে নারীরা শারীরিকভাবে যতটা না নির্যাতিত তার চেয়ে ঢের বেশি হয় মানসিক নির্যাতনের শিকার। পদে পদে তাকে অপমান সইতে হয়। আসল কথা হল, এ সমাজে এখনও আমরা নারীকে ‘মেয়েলোকের’ বেশি ভাবতে পারিনি। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হল, পুঁজিবাদই নারীকে তার সীমাবদ্ধ ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এসেছিল। তবে তা নারীর প্রতি যথাযথ মর্যাদা বা সম্মান বিবেচনায় নয়; সস্তা শ্রমের বিপরীতে পাহাড় সমান মুনাফা লাভের আশায় বাইরে নিয়ে এসেছিল পুঁজিবাদ। আমরা জানি, মুনাফার সঙ্গে মজুরির বিপরীত সম্পর্ক; মজুরি কম হলে মুনাফা বাড়ে আর মজুরি বেশি হলে মুনাফা কমে।
সুতরাং পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য অর্থনীতিতে যে পরিমাণ পুরুষ ছিল তা যথেষ্ট নয়। তাই মজুরির ওপর ঊর্ধ্বমুখী চাপ কমাতেই নারীকে শ্রমবাজারে আনা হয়। সেজন্য দেখবেন কলকারখানায় হাজার হাজার নারী শ্রমিক কাজ করছে, সস্তায় শ্রম প্রয়োগ করছে। নারী সস্তায় শ্রমের ফলে পুঁজিপতি মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলেছে। প্রাথমিকভাবে এবং এখনও নারী শ্রমিকের মজুরির ওপর মালিকদের একটা বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই শ্রমবাজারকে স্থিতিশীল রেখে অর্থনীতিকে মুনাফা উপযোগী করে রাখার স্বার্থেই বিভিন্ন নামকাওয়াস্তে ‘স্লোগান’ দেয়া হয়। এ ব্যবস্থায় মুনাফাবিহীন নারী অধিকার নিয়ে যদি ভাবা হতো তাহলে পতিতাবৃত্তি আইনগত বৈধতা পেত না। নারীর প্রকৃত অধিকারকে আড়াল করে পুঁজিবাদ বাণিজ্যিক স্বার্থে নারীকে পণ্য বানাতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। আমরা বুঝে হোক, না বুঝে হোক, তাদের ‘স্নোগান’ ও ‘বুলিতে’ বিমোহিত হয়ে পড়ি। তারপরও আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে শ্রদ্ধার সাথে দেখতে হবে।
আমরা সাধারণত নারী দিবসে যে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসি তা হল- নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ। এ অবস্থা থেকে উন্নয়নশীল আর উন্নত বিশ্ব, কারোরই নিস্তার নেই। সংগৃহীত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি লাখে ৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন; ভারতে ২ জন; আমেরিকায় ২৭ জন এবং ব্রিটেনে ২৯ জন। গবেষকরা বলছেন, আমাদের সমাজ একজন ধর্ষণের শিকার নারী নির্দোষ হলেও তার প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়ে অনেকটাই ‘ঘৃণার’ চোখে দেখে। ফলে এক্ষেত্রে নারীরা অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হন। আমাদের উচিত ধর্ষণের শিকার একজন নারীকে সহানুভূতিশীল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা এবং যথাযথ মূল্যায়ন করা। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এখনও সে স্তরে পৌঁছাতে পারেনি, যেই স্তরে গিয়ে নারীরা নারী হিসেবে মূল্যায়ন করা নয়, নারীকেল মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হবে। এছাড়া আইনি সহায়তার ক্ষেত্রেও রয়েছে অবহেলা। তা যাই হোক, ধর্ষণের বিষয়টি আর্থিক নয় বরং মনস্তাত্ত্বিক; পুঁজিবাদ এখানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, পৃথিবীতে যদি আর একটিও ধর্ষণের ঘটনা না ঘটে, আর একজন নারীও যদি শারীরিক নির্যাতনের শিকার না হন, তারপরও নারী অধিকারের প্রশ্নটি থেকেই যাবে। কেননা উত্তরাধিকারসহ নানা সামাজিক সিদ্ধান্তের এখনও সুরাহা হয়নি। তাই আমাদের দেখতে হবে নারীর প্রকৃত অধিকার নিশ্চিত হওয়া এবং নারীমুক্তি বিষয়টি আসলে কীসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সমাজের সংস্কার নাকি আমূল পরিবর্তন?
‘মানবসমাজে বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশ ঘটেছিল, সমাজতন্ত্র নামে ভিন্ন একটি সমাজ অর্থনীতি কাঠামোর বিকাশ ও তার বাস্তবায়ন চেষ্টা হয়েছিল। সারা বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্যে তো গলধ রয়ে গেছে। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নারীর প্রকৃত অধিকার আশা করাটাই যথাযথ নয়। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে নানা রকম পরিবর্তন হলেও নারীর প্রকৃত অধিকার প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব নয়। সমাজের সব দিক পর্যালোচনা করে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সমাজের আমূল পরিবর্তন ব্যতীত নারীমুক্তি হবে আকাশ কুসুম কল্পনা। একদিকে বৈপ্লবিক রূপান্তর ছাড়া নারী প্রশ্নের সমাধান সম্ভব নয়, অন্যদিকে নারী প্রশ্নকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা ছাড়া সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর, এমনকি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কার্যকর বিকাশও সম্ভব নয়’ (আনু মুহাম্মদ; নারী, পুরুষ ও সমাজ; পৃষ্ঠা: ১৫০)। সুতরাং সমাজ কাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিপরীতে আমরা যতই ‘স্লোগান’ তুলি না কেন, তার দ্বারা নারীমুক্তির বিষয়টি অধরাই থেকে যাবে। তাই বলে কি আমরা চুপ করে বসে থাকবো? না, আন্দোলন সংগ্রাম নিরন্তরভাবে চালিয়ে যেতে হবে।
সমতায় বিশ্বাসী প্রজন্ম: লড়বে আদিবাসী অধিকার সুরক্ষায়
এবং জুম্ম নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা নিশ্চিতকরণে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হউন” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উদ্যোগে ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়েছে।
…………………….
বাচ্চু চাকমা, সাবেক ছাত্রনেতা