মতামত ও বিশ্লেষণ

প্রেক্ষিত: মুজিববর্ষ এবং ক্ষুদ্র প্রয়াসে সংবিধান পর্যালোচনা

বলে রাখা শ্রেয়- মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয়। প্রয়োজনেই সংবিধান সংশোধন করা যুক্তিযুক্ত। যেকোন দেশে সংবিধানই প্রধান বা মহান আইন। কারন এই সংবিধানকে মান্য করে দেশে অন্যান্য আইনগুলো প্রণিত হয়। বলা চলে একটি সংবিধান বিশ্লেষন করলে সেদেশের প্রকৃত অবস্থা অনেকটা মূল্যায়ন বা অনুধাবন করা যায়।

১৯৭২ সালে ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংবিধান গৃহীত হয় এবং একই বছর ১৬ ডিসেম্বর তা কার্যকর হয়। যা বর্তমানে ৪৭ বছর অধিক সময় পার করেছে। এটি ১০ এপ্রিল ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানে রয়েছে ১১ টি ভাগ। তার মধ্যে কিছু ভাগ খুব গুরুত্বপূর্ণ ও যৌক্তিক প্রয়োজনে আলোচনা সাপেক্ষ, যেমন – প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার ও অন্যান্য। এর বাইরে রয়েছে সংবিধানের একটি মুখবন্ধ বা প্রস্তাবনা, যা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বটে । ১৯৭২ সালে যখন সংবিধান রচনা করা হয়, রচয়িতা বা সংসদে আইন প্রনেতা (বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু’র) গণদের চাওয়া ছিলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সংবিধানে প্রতিফলিত করা। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে তার বেশিরভাগই ১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিলো। যেমন: সংবিধানে চার মূলনীতি- “জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র”। যার ভিত্তির উপরে ভর করে যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখতে পায় কিছু ব্যর্থশাসক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ঠিকে থাকার মানসে সংবিধান অযাচিতভাবে সংশোধন করে। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে শুরুতে নিয়ে আসা হয়” বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” এবং ১৯৮৮ সালে এরশাদ ক্ষমতায় অষ্টম সংশোধনীতে সংবিধানের ১ম ভাগে নিয়ে আসেন “রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম”। অনেকের মতে তখন থেকেই রাষ্ট্রে প্রশ্নবোধকের(?)সূত্রপাত – রাষ্ট্রের ধর্ম, নাকি ধর্মের রাষ্ট্র মুখোশের গব্বরে বঙ্গবন্ধুর কাঙ্খিত সোনার বাংলাদেশ?? সর্বোপরি এরশাদ শুধু স্বৈরশাসক ছিলেন না, মৌলবাদের বিষবাষ্পের রচয়িতাও তাকে বলা চলে!!

১৯৭২ সালে সংবিধান প্রথম যখন গৃহিত হয় তার আগে গণপরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রামের মহান পুরুষ তৎকালীন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংবিধানে জুম্ম জনগণের ভূমি অধিকার এবং জাতি হিসেবে স্বীকৃতিসহ সকল মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয়ে সোচ্ছার ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য শেখ মুজিব রহমানের সরকার যেভাবে হোক জুম্ম জাতি হিসেবে লারমা’র স্বীকৃতি চাওয়াটা গ্রহণ করেননি। লারমা সংসদে দাঁড়িয়ে আরও বলেছিলেন আমি চাকমা (আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম) হিসেবে রাষ্ট্রীয় সংবিধানে স্বীকৃতি চাই। কারন আমার বাপ দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠী কেউ আমাকে বাঙালী বলে নাই, আমি জাতিতে চাকমা। তিনি এও বলেছিলেন আমি জাতীয়তায় বাংলাদেশী, জাতিতে বাঙালী নয়। তার এই দাবি তখনকার কোন সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এবং স্পীকারও কর্ণপাত করেননি। তাকে বারবার কথা বলা থেকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার জন্য তিনি সংসদ অধিবেশন ওয়াকআউট করে বের হয়ে যান। শুধুমাত্র প্রয়াত মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নাগরিকত্ব বিষয়ক সাংবিধানিক অনুচ্ছেদটি সংসদে পূর্ণপ্রস্তাব আকারে পাশ করার আগে আলোচনার জন্য আরো কিছুদিনের জন্য সময় মুলতবী চেয়েছিলেন। জনাব ড. কামাল হোসেন, তখন আইন মন্ত্রী, কিন্তু সবকিছু জেনেও সেদিন সংসদে নিরুপায় ছিলেন, তিনিও কোন সহযোগিতা করেননি। যার পরস্পরায় বাংলাদেশে অপরাপর জাতিসত্বাকে এখনো সংবিধানে সুক্ষভাবে বাঙালী জাতি হিসেবে সন্নিবেশিত করা হয়েছে – দেখুন “অনুচ্ছেদ ৬(২) “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন”।

কে শুনে কার কথা!! তবে জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে কিছুটা সংশোধিত হয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মসহ বাংলাদেশে অপরাপর জাতিদের কোন সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছিলনা। অথচ আমরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্য অনেক দেশে তাকালে দেখতে পাই তাদের সংবিধানে বৃহৎ জাতির পাশাপাশি অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর সুস্পষ্ট সাংবিধানিক স্বীকৃতি রয়েছে। তাদের রয়েছে আইনগত আলাদা রক্ষাকবচ।

২০১১ সালে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে পাহাড়ের জুম্মজনগণ ও অন্যান্য প্রান্তিক জাতি’রা নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রেক্ষিতে সংবিধানে “আদিবাসী যা ইংরেজিতে Indigenous” হিসেবে স্বীকৃতি চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার সংবিধান সংশোধন করে করলো উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্বা, নৃ-গোষ্ঠী (যা বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় “ক্ষুদ্র মানুষের গোষ্ঠী বা জাতি আবার সাথে “উপ’ উপাদি কারন “নৃ” মানে মানুষ); দেখুন বাংলাদেশ সংবিধান অনুচ্ছেদ ২৩(ক)- “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন”)। বেশিরভাগ আইনপ্রণেতা ও আমলাদের যুক্তি যতদূর জানা যায় আদিবাসী নাকি দেশে বৃহৎ বাঙালীরা!! তাই আদিবাসী কোন অর্থেই অন্যদের ব্যবহার করা যাবেনা। তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পায় সরকারি গেজেট প্রকাশ করে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, গারো দেরকে আদিবাসী বলা যাবে না বা নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি দেশের প্রধান প্রধান অনেক মিডিয়াগুলোও এখন আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। সত্যি এর চেয়ে অাশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু থাকে না! অথচ ১৯৫০ সালের জমিদারী অধিগ্রহন ও প্রজাস্বত্ব আইনে সুষ্পষ্ঠভাবে আদিবাসী হিসেবে জমি-জমা হস্তান্তরের বিধি-নিষেধের কথা বলা আছে। যেখানে উল্লেখিত অপরাপর জাতিদের কথা কিন্তু বলা হয়েছে। এমনকি ২০০৮ সালের বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও স্পষ্ট করে আদিবাসীর কথা বলা ছিল।তবে এটা ঠিক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতিদের Indigenous হিসেবে স্বীকৃতি বা গণ্য করে আসছে বহুদিনযাবৎ। সরকারের কতিপয় ব্যক্তির বাংলা আদিবাসী শব্দটিতে যেহেতু এত এলার্জি তবে ইংরেজিতে Indigenous শব্দটি বাংলায় “ইন্ডিজিনাস” হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বোধহয় বাঁধা ছিলো না। কিন্তু তা করা হলো না। সংবিধান পরিচালনার মূলনীতিতে নিয়ে এসে আদিবাসীদের বিবেচনা করা হলো অনেকটা সংসদে নারী সংরক্ষিত আসনের মতো, ভিন্ন নামে অভিহিত করে ঐতিহ্য সংরক্ষণ!!

এখন দেখা যাক সংবিধানের অন্য জায়গায়: একেবারে শুরুতে সংবিধানে -” বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম,” এরপর আবার “দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে)/ আবার পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে (দেখু: প্রস্তা:)”।

আবার অন্যদিকে প্রথমভাগে- “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্ম পালনে সমান অধিকার (অনু:২)”।
এছাড়া-“বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি, আবার নাগরিকত্বে বাংলাদেশী (অনু: ৬)”।
আবার রাষ্ট্র, পরিচালনার মূলনীতিতে রাখা হয়েছে- “জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা (অনু:৮)”।
এমনকি সংবিধান সংশোধন করে অযাচিতভাবে সর্বোচ্চ দন্ডের কথাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (দেখুন পঞ্চদশ সংশোধনী ৭ক অনুচ্ছেদে)। তাই মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে এটা কি দেশের মহান আইনগ্রন্থ, নাকি সর্বোচ্চ দন্ডের বিধান, নাকি জখাখিচুরির নাগরিক গ্রন্থ!! নাকি আইন প্রণেতারা খুব বেশি উভয় সংকটে ভোগেন? এই দ্বিধাদন্দগুলো দূর করা জরুরি। কারন ৭২ এর সংবিধানে এমন ছিলনা। শুধু নাগরিকত্ব বিষয়ক অনুচ্ছেদটি একটু সংশোধন দরকার ছিল- যেখানে বলা যেতো “বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ বাঙালী; তার পাশাপাশি অপরাপর চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, গারো সহ বেশ কিছু জাতির বসবাস রয়েছে এবং সকল জনগন জাতীয়তায় বাংলাদেশী”।

আসলে শেখ মুজিবুর রহমানের ভালো কাজের প্রশংসা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। তেমনি তিনি হয়তো ভূল ত্রুটির ঊর্ধ্বেও নন। কিছু কিছু স্লোগান ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে বড় হয়েছি-” শেখ শেখ শেখ মুজিব, লও লও লও সালাম; এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে, মুজিব তুমি কোটি মানুষের অন্তরে”। অনেক সময় আমিও এই স্লোগানে সামিল হয়েছি! কিন্তু বাস্তবতায় প্রশ্ন? জাগে এখন ২০২০ সাল মুজিবের শতবর্ষের সন্নিকটে বাংলাদেশ- লক্ষ মুজিব যদি ঘরে ঘরে হয় তবে কেন এত খুন, গুম, ধর্ষণ, হানাহানি, আদিবাসী সহ জুম পাহাড়ের মানুষ অধিকার হারা?? মুজিব যদি কোটি মানুষের অন্তরে হয় তবে কেন এত নৈরাজ্য, আইন অমান্যতা, বেকারত্ব, ঘুষ, প্রশাসনিক দুর্নীতি, মাদকের ছড়াছড়ি?? তাই শুধু মুজিববর্ষের ক্ষন গণনা করা নয়। বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে স্বপ্নের বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, যে আদর্শ লালন করতেন- আইনে সকল মানুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার, তা বাস্তবে নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও কাজকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানবাধিকারকে সমুন্নত করতে হবে। যোগ্য ও গ্রহনযোগ্য লোক নিয়োগ দিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে; কোনমতেই ঠুঁথো জগন্নাথ ও সরকারের মুখাপেক্ষী করে রাখা ঠিক হবেনা। সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক চাহিদাগুলো (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা) মৌলিক অধিকারের সহিত অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করার রুপরেখা করতে হবে। পাকাপোক্ত আইন করে প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষার জন্য দূরদর্শী পদক্ষেপ দ্রুত নিতে হবে। সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ দেশের অপরাপর অন্যান্য জাতিদের সাংবিধানিক গ্যারান্টিসহ ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির (কথায় শান্তি চুক্তি) পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। কেননা স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও দেশে প্রান্তিক আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা না পাওয়া সত্যিই অনেক কষ্টের।

ধর্মীয়তন্ত্র, পাকমন্ত্র নয়, চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মৌলিক ধর্মনিরপেক্ষতায় বাংলাদেশ। চাই রাষ্ট্রে মানুষে মানুষে সমান অধিকার ও গণতন্ত্র, সর্বোপরি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুষ্পষ্ঠ দিক নির্দেশনা। অতএব ২০২০ মুজিববর্ষের অঙ্গীকার হোক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’কে ইতিহাসে স্মরণীয় করে রাখার মতো অহংকার। যেভাবে মুজিব লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে গেথে আছেন।

লেখক: মেকসুয়েল চাকমা

আইনজীবি ও মানবাধিকার কর্মী

Back to top button