জাতীয়

রাঙ্গামাটিতে ভূমি কমিশনের সভাঃ বাঙালিদের উস্কানিমূলক ঘেরাও

গত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ সকাল ১১:০০ ঘটিকায় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ভবনে সম্প্রতি স্থাপিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের রাঙ্গামাটি শাখা অফিসে ভূমি কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আনোয়ার-উল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, বোমাং সার্কেল চীফ উ চ প্রু চৌধুরী, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা প্রমুখ কমিশনের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। কমিশনের অপর সদস্যবৃন্দ যথাক্রমে মং সার্কেল চীফ সাচিং প্রু চৌধুরী, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার সভায় অনুপস্থিত ছিলেন।

সভার প্রারম্ভে ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এছাড়া সভায় বান্দরবান জেলায় লাদেন বাহিনী কর্তৃক শত শত একর ভূমি বেদখল, বাঘাইছড়ি উপজেলায় শিজকমুখ বৌদ্ধ বিহারের জায়গায় সেনা ক্যাম্প স্থাপন, দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়ায় কথিত সোনামিয়া টিলায় পুনর্বাসিত বাঙালিদের ভূমি দখলের পাঁয়তারা, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের গোয়েন্দা পরিদপ্তর হতে ইস্যুকৃত সার্কুলেশনের বরাত দিয়ে ১লা নভেম্বর ২০১৮ “সাধারণ বাঙালি জনগোষ্ঠী এবং বাঙালি আঞ্চলিক দলসমূহের প্রতি নিরাপত্তা বাহিনী ও অসামরিক প্রশাসনের বর্তমান মনোভাব এবং সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব প্রসঙ্গে” শীর্ষক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রদায়িক ও পার্বত্য চুক্তি পরিপন্থী নির্দেশনা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পরিশেষে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে বান্দরবানে কমিশনের পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান-সদস্যদেরকে পুনর্বাসিত বাঙালিদের ব্যারিকেড
………………………………………………………..

ভূমি কমিশনের সভায় যোগদান করতে যাওয়ার পথে সকাল ৯:৩০ ঘটিকার দিকে রাঙ্গামাটি প্রধান সড়কের পাবলিক হেল্থ এলাকায় ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল হকসহ কমিশনের অন্যতম সদস্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ও চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়কে সদ্য গঠিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’-এর ব্যানারে পুনর্বাসিত বাঙালিরা অবরোধ করে। এ সময় পুনর্বাসিত বাঙালিরা ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান-সদস্যদেরকে প্রায় পৌনে একঘন্টা আটকে রাখে। ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান-সদস্য, ভূমি কমিশনের আইন ও বিধিমালার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকে এবং উস্কানীমূলক ও হুমকিমূলক বক্তব্য প্রদান করতে থাকে।

উল্লেখ্য যে, ২১ ডিসেম্বর ২০১৯ বিকালে রাঙ্গামাটি শহরের বনরূপায় আহুত এক সমাবেশে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’-এর ব্যানারে পুনর্বাসিত বাঙালিরা ২৩ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান-সদস্যদের ঘেরাও করার ঘোষণা করে। তদনুসারে বাঙালিরা সকাল থেকে পাবলিক হেলথ এলাকায় সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে ভূমি কমিশনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে থাকে।

এমতাবস্থায় শহরের কল্যাণপুরস্থ বাসভবন থেকে সভাস্থলে আসার পথে পাবলিক হেলথ এলাকায় পৌঁছলে প্রথমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান পুনর্বাসিত বাঙালিদের ঘেরাওতে আটকে পড়েন। এরপর রাজবাড়ি থেকে চাকমা সার্কেল চীফ রওনা দিলে তিনিও পাবলিক হেলথ এলাকায় বাঙালিদের ব্যারিকেডে আটকে পড়েন। অপরদিকে রাঙ্গামাটি সার্কিট হাউজ থেকে রওনা দিলে সর্বশেষ ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান সেটেলার বাঙালিদের অবরোধে অবরুদ্ধ হন। এভাবে আটকে পড়ার পর পার্বত্য মন্ত্রণালয়, ঢাকাস্থ উর্ধতন কর্তৃপক্ষ, রাঙ্গামাটির ডিসি-এসপিসহ বিভিন্ন মহলের সাথে যোগাযোগ করা হলে ’পরে পৌনে এক ঘন্টা আটকে থাকার পর ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান-সদস্যরা ঘেরাও থেকে মুক্ত হয়ে সভাস্থলে যেতে সক্ষম হন। পুনর্বাসিত বাঙালিদের ব্যারিকেডের কারণে ভূমি কমিশনের সভা একঘন্টা পরে শুরু হয়।

সচেতন মহলের পর্যবেক্ষণ, ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান-সদস্যদের ঘেরাও করার জন্য পুনর্বাসিত বাঙালিরা আগে থেকে ঘোষণা দিলেও এবং সকাল থেকে মাইক টাঙিয়ে ভূমি কমিশনের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক, হুমকিমূলক ও সাম্প্রদায়িক বক্তব্য বক্তব্য দিতে থাকলেও প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে নিরাপত্তামূলক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান এমনকি সকাল থেকে চলমান বাঙালিদের ব্যারিকেডের আশেপাশেও কোন পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী আরো জানান অথচ সেসময় সাদা পোশাকের বিভিন্ন বাহিনীর অনেক সদস্য ব্যারিকেড প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন। এলাকার অভিজ্ঞ মহলের অভিমত বাঙালিদের এই বিক্ষোভের পেছনে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের ইন্ধন থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায়না। তাদের ইন্ধন ব্যতীত প্রশাসনের নাগের ডগায় নির্বিঘ্নে ও অবাধে এভাবে বাঙালিরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে সক্ষম হতো না বলে সচেতন মহল অভিমত ব্যক্ত করেন।

ভূমি কমিশনের সভা শেষ হওয়ার অব্যবহিত পর ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যানের সাথে পুনর্বাসিত বাঙালিদের এক প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তারা ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যানের নিকট বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সম্বলিত এক স্মারকলিপি প্রদান করেন। দাবি-দাওয়ার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- বর্তমান ভূমি কমিশন বাতিল করা, ভূমি কমিশনের আইন সংশোধন করা, ভূমি কমিশনে সমসংখ্যক বাঙালি সদস্য নিয়োগ করা, ভূমি কমিশনের কার্যক্রম বন্ধ রাখা ইত্যাদি। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ভূমি কমিশনে বাঙালিদের কোন প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি। ভূমি কমিশন আইন বৈষম্যমূলক। যার ফলে ভূমি কমিশনের কার্যক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে বলে পুনর্বাসিত বাঙালি প্রতিনিধিরা যুক্তি তুলে ধরেন।

উল্লেখ্য যে, আশি দশকে সরকারি উদ্যোগে বসতিকারী পুনর্বাসিত বাঙালিদের দ্বারা আদিবাসী জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখল, অনুপ্রবেশকারী বাঙালিদের নামে অবৈধ বন্দোবস্ত প্রদান, সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে জুম্মদের উচ্ছেদ ইত্যাদির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা জটিল হয়ে উঠে। জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠনের বিধান পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে রাখা হয়েছিল।

Back to top button