মতামত ও বিশ্লেষণ

রাঙ্গামটিতে সচেতন নাগরিক সমাজের নামে জেলা আওয়ামী লীগের জেএসএস বিরোধী সমাবেশ: এস জে চাকমা

নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে রাঙ্গামাটিতে নানা ছলচাতুরি শুরু করেছে দীপংকর তালুকদার। কখনও সচেতন নাগরিক সমাজের নামে আবার কখনো নির্যাতিত নিপীড়িত পার্বত্যবাসীর ব্যানার ব্যবহার করে একের পর এক সাম্প্রদায়িক সমাবেশ করছেন। আর নির্লজ্জভাবে সমর্থন দিচ্ছে নিরাপত্তাবাহিনী ও প্রশাসন যন্ত্র। গত ১৪ মে ২০১৭ সকাল ১০টায় রাঙ্গামাটি শহরের জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘নির্যাতিত নিপীড়িত পার্বত্যবাসী’ নামে বাঙালি সংগঠনগুলোর এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, গুম অপহরণের প্রতিবাদে এবং অবিলম্বে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবিতে’ এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত করা হয়। একই দাবিতে একই কায়দায় ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ রাঙ্গামাটির নিউমার্কেট প্রাঙ্গণে আরেকটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সচেতন নাগরিক সমাজ নামে সমাবেশ হলেও নির্বাচনী বছরের প্রারম্ভে মূলত দীপংকর তালুকদারের জেলা আওয়ামী লীগই এই সমাবেশের আয়োজন করেছে এটা পার্বত্যবাসীর না বুঝার কোন কারণ ছিল না।
সমাবেশ চাঁদাবাজি বন্ধ করা, খুন-অপহরণ বন্ধ করাসহ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবিতে করা হলেও মুলত এটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বিরোধী একটি সাম্প্রদায়িক সমাবেশ। সমাবেশ থেকে জনসংহতি সমিতি -এর প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানো হয়। জনসংহতি সমিতি -কে নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়। সমাবেশে বিভিন্ন উপজেলা থেকে সমঅধিকারের কিছু নেতাকর্মী এবং পাহাড়িদের মধ্য থেকে কিছু দালাল সুবিধাবাদী লোক অংশ নিয়েছে। রাঙ্গামাটি পৌর প্রাঙ্গণ থেকে মিছিল শুরু করে নিউমার্কেট প্রাঙ্গণে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এখানেই জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, মহিলা সাংসদ ফিরোজা বেগম চিনু, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা,রাঙ্গামাটির মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী, কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগের অংসুই চাইন চৌধুরী, লংগদু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জানে আলম, কাউখালী আওয়ামী লীগের সভাপতি অংসুইপ্রু চৌধুরী, চেম্বার অব কর্মাস এর সভাপতি বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া, বিলাইছড়ি আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি রাসেল মারমাসহ অনেকে।
সমাবেশে দীপংকর তালুকদার সংরক্ষিত মহিলা সাংসদ ফিরোজা বেগম চিনুসহ সকলেই উস্কানিমুলক সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়েছেন, যা রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার বহি:প্রকাশ ঘটেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কোন সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী ছিল না, এখনো নয়। যেই না ঊষাতন তালুকদার স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়ী হন তখন থেকে দীপংকর তালুকদার জনসংহতি সমিতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মধ্যকার দূরত্ব তৈরি করে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মন্ত্রী এমপি কোনটিই না হওয়া সত্ত্বেও সরকারি ক্ষমতার দাপটে পুলিশি প্রহরায় ঘুরে বেড়ান। বিভিন্ন গির্জা প্যাগোডা মজসিদ মন্দিরে গিয়ে বরাদ্দ ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাহাড়ি-বাঙালি সবাইকে জনসংহতি সমিতি বিরোধী বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছেন নিরলসভাবে। প্রশাসনে প্রভাব খাতিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না হলেও উদ্বোধন করছেন বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচি, কালভার্ট, রাস্তা, স্কুল ইত্যাদি। তার হীনচেষ্টা যেকোন উপায়ে জনসংহতি সমিতিকে একটি সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রধারী সংগঠনে পরিণত করা। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে বুঝিয়ে ভুল ধারণা সৃষ্টি করা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা। সেই জন্য দীপংকর তালুকদার ফেইসবুক থেকে বহু পুরানো একটি ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে মাইকে বাজিয়ে শুনিয়েছেন। যদিও সাউন্ড স্পষ্ট হয়নি। ভিডিও ফুটেজটি ছিল চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ-এর একটি বিচারের চিত্র।
রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের ঘুষ, দুর্নীতি, টেণ্ডারবাজি, চাকরি বাণিজ্য ক্ষমতার অপব্যবহারে মানুষ যখন অতীষ্ট, সর্বোপরি ৯ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকেও পার্র্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করায় আওয়ামী লীগের প্রতি পার্বত্যবাসীর যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও অসন্তোষ্ট, তখনই দীপংকর তালুকদার আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার না করে সচেতন নাগরিক সমাজের নাম দিয়ে সমাবেশ করেছেন। নাম দিয়েছেন মহাসমাবেশ। কিন্তু তেমন লাভবান হয়েছেন বলে মনে হয় না। মহাসমাবেশের মতো জনসমাগমের ছিল না লেশমাত্র চিহ্ন। মহাসমাবেশের আগের ক’টা দিন যেভাবে বেশ কয়েকটি গাড়িতে হর্ন লাগিয়ে উচ্চ স্বরে প্রচারনা করেছেন আওয়ামী লীগ না হয়ে অন্য কোন দলের সমাবেশ হলে পুলিশ প্রচারকারীদের গ্রেপ্তার করে থানা হাজত পূর্ণ করতেন। আওয়ামী লীগ হওয়ায় তেমনটা ঘটেনি। পুলিশের নির্দেশে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রামের সড়ক পুরাতন বাস স্টেশন থেকে ভেদভেদী পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবলছড়ি-আসামবস্তী-রাঙ্গাপানি-ভেদভেদী হয়ে সকল যানবাহন চলাচল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে জন চলাচলের যেমনি ভোগান্তি তার চেয়ে বেশি আতঙ্কিত ছিল রাঙ্গামাটির মানুষ। কারণ সমাবেশে গুটিকয়েক জুম্ম দালাল আর সমঅধিকারকামী সেটেলার বাঙালিরা অংশ নিয়েছে। দীপংকর তালুকদার আর চিনু এমপিদের উস্কানিমুলক সাম্প্রদায়িক বক্তব্য শুনলে যে কেউ ভয় পেতে পারে তা স্বাভাবিক।
অথচ জেএসএস কর্তৃক পার্বত্য চুক্তির বর্ষপূতি উপলক্ষ্যে আহুত গণসমাবেশ বা বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ঐতিহ্যবাহী বিজু-সাংগ্রাই-বৈসু-বিষু অনুষ্ঠানের সময় রাস্তাঘাট বন্ধ করে সমাবেশ বা অনুষ্ঠান করা যাবে না বলে কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়। হলের মধ্যে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠান কিংবা হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ইনডোর কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানে বাধা দেয়া হয়। এই হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী, জেলা প্রশাসনের নির্লজ্জ ও জঘন্য সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী।
দীপংকর তালুকদারের সমাবেশ থেকে বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি বিপ্লবী নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ও জনসংহতি সমিতি বিরোধী অনেক কথা বলেছেন। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে পরিশ্রমের কথা বলেছেন। নাম উল্লেখ না করে রাঙ্গামাটির নির্বাচিত সাংসদ ঊষাতন তালুকদারের কুৎসা রটিয়েছেন। চাকমা রাজ পরিবারের কুৎসা রটিয়েছেন। বাদ যাননি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য শিক্ষাবিদ বাঞ্ছিতা চাকমাও। সবচেয়ে আশ্চর্য হতে হয় যখন সমাবেশ থেকে বলা হয় রাণী য়েন য়েন আর বাঞ্ছিতা চাকমা জনসংহতি সমিতির প্ররোচনায় হাসপাতালে গিয়ে তুচ্ছ ঘটনাকে নিয়ে রাজনীতি করছে সেই রকম অসত্য বানোয়াট কথা শুনে। সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে এ ধরনের অসত্য কথা বলেছেন। বিলাইছড়িতে সেনা সদস্য কর্তৃক একজন আদিবাসী তরুণী ধর্ষণ ও একজন কিশোরীর শ্লীলতাহানির ঘটানেেক তুচ্ছ ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ঘটনাকে নিয়ে রাজনীতি করছে বলে অভিযোগ করেছেন, যা সবই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা বৈ কিছু নয়।
মানবতাই হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আদর্শ। এই সংগঠনই সকল সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসনের দাবি করে আসছে। যাদেরকে দীপংকর তালুকদারেরা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু আমার দেশের ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ এবং সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তায় নিয়োজিত সকল বাহিনী এই দলকে একটি চাঁদাবাজী সন্ত্রাসী দল বানানোর অপচেষ্টা করে আসছে প্রতিষ্ঠা থেকে। যা দু:খজনক। জনসংহতি সমিতি সন্ত্রাসী কিংবা চাঁদাবাজী দল নয়। এটি একটি অধিকারকামী সংগঠন। জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত সচেতন নাগরিক সমাবেশে মহিলা সাংসদ ফিরোজা বেগম চিনু বলেছেন, আমাদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে সেই টাকা দিয়ে অস্ত্র কিনে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় (প্রথম আলো ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮)। যদি তাই হয়, আপনি চাঁদা দেন কেন? সংরক্ষিত আসন হলেও আপনি তো ক্ষমতাসীন দলের মহিলা সাংসদ। তাদেরকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দিতে পারেন না?
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে দু’জনই সমান অপরাধী আপনার নিশ্চয় জানা আছে। যদি বলি চাঁদা যে দেয় আর যে নেয় দুই জনই সমান অপরাধী। এর অর্থ দাঁড়ায় আপনি চাঁদা যেমন দেন তেমনি নেনও বটে। ১০ টাকা চাঁদা দিয়ে ১০০ টাকার সুবিধা নেন। তাই এত দিন চুপ আছেন। এখন বুঝি ভাগে কম যাচ্ছে। তাই সমাবেশ, মহাসমাবেশ করা। পার্বত্য জেলা পরিষদের কোটি টাকার চাকরি বাণিজ্য কি কে করে? উন্নয়ন কাজের ১৫% থেকে ২০% সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হয় তা ঠিকাদাররা চোখ বুঝে হিসাব করে রাখেন। উক্ত পারসেন্টেজ বা চাঁদা পিডি থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ার, প্রকল্প কর্মকর্তা, কর্মচারিদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়ে থাকে। বনজ সম্পদের জোত পারমিট, পার্বত্য এলাকা থেকে ঢাকা পর্যন্ত বনজ সম্পদ পরিবহনে ঘাটে ঘাটে মোটা অংকের যে পারসেন্টেজ বা চাঁদা দিতে হয়, তা তো দীপংকর বাবু বা চিনু আপুদের নতুন করে স্মরণ করে দেয়ার প্রয়োজন পড়বে না। কারণ এসব পারসেন্টেজ বা চাঁদাবাজি যার তার পক্ষে করা সম্ভব নয়, এগুলো ক্ষমতার সাথে ওত:প্রোতভাবে জড়িত। যারাই ক্ষমতা কেন্দ্রের ভারবিন্দুতে অবস্থান করেন তাদের না চাইতেই এসব পারসেন্টেজ বা চাঁদা আপনা আপনি চলে আসে। অথচ দীপংকর বাবু বা চিনু আপুরা থাকেন এক্ষেত্রে একেবারেই বোবা।
চিনু আপু আরো বলেছেন, তিনি সন্তু লারমাকে শ্রদ্ধা করেন, সম্মান করেন। কিন্তু যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন তার উচ্চারিত শ্রদ্ধাবোধে অশ্রদ্ধা ও অসম্মানই নিহিত। সন্তু লারমা রাঙ্গামাটির ভোটার নয় উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, যারা পাহাড়ি-বাঙালি সহাবস্থান চান না তারা দেশ ছেড়ে যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যেতে পারেন। আপু, আয়নায় নিজের চেহারা দেখলে এইভাবে উগ্র সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা মুখ থেকে বের হবে না। আপনার বাবা তো চাকরি করতে এসেছিলেন। আপনি তো এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা নন। আপনিও একজন সেটেলার। উড়ে এসে জুড়ে বসে আপনি ভূমিপুত্রদের এখান থেকে চলে যেতে চোরের মায়ের গলা করে চিৎকার করছেন।
জনসংহতি সমিতি জুম্ম জনগণসহ মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে। সংগ্রাম করে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তির ফলে দীপংকর বাবুরা মন্ত্রী হয়েছেন। না হয় মন্ত্রী হওয়ার মতো সুযোগ পেতেন কিনা সন্দেহ। বর্তমানে গণতান্ত্রিক উপায়ে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন করছে। দীপংকর বাবুদের মত অকৃতজ্ঞদের আঘাতে এই সংগঠনকে অনেক বন্ধুরতা অতিক্রম করতে হচ্ছে তথাপিও সেনাবাহিনী ও দীপংকর বাবুদের অসৎ উদ্দেশ্য সফল হবে বলে মনে হয়না। কারণ বিগত সময়েও বহুবার তারা এই সংগঠনের অস্তিত্ব শেষ করতে মরিয়া ছিলেন। দীপংকর বাবু রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনে জনসংহতি সমিতির আপত্তির কথা তুলে বলেছেন এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। কিন্ত স্থানীয়দের মতামত উপেক্ষা করে সামগ্রিক স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করতে কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে এমন দৃষ্টান্তও তো পৃথিবীতে বিরল। ভারতের রাজ্য আমাদের প্রতিবেশী মণিপুরেও তাদের স্বার্থ বিরোধী বলে স্থানীয় আদিবাসী জনগণ একসময় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল দীপংকর বাবুদের মনে হয় অজ্ঞাতই থেকে গেছে। তিনি আরো বলেছেন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা না দিতে চাইলেও জনসংহতি সমিতির লোকজন জায়গা মালিকদের সরকার প্রদেয় অর্থের পারসেন্টেজ বসিয়েছেন। যদি দেখে থাকেন ধরার ব্যবস্থা করলেন না কেন? বলেছেন অবৈধ অস্ত্রের ভয়। কিন্তু আপনার বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করলেন না কেন? আপনার পারসেন্টেজ কমবে কিংবা থাকবে না বলে?
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাজনৈতিক শত্রু নয়। আওয়ামী লীগ মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে বলে দাবি করে। এই দলের সাথে জনসংহতি সমিতির চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এই দলের মহাবুবুল আলম হানিফসহ দায়িত্বশীল নেতারা যখন হঠাৎ করে পাহাড়ে এসে চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনরত সংগঠন ও এর নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজী ও অবৈধ অস্ত্রের কথা বলে হুমকি দিয়ে যায় তখন বুঝতে বাকী থাকেনা তারা পাহাড় নিয়ে ন্যূনতম জ্ঞান রাখেন না। আমরা আর্শ্চয হই, এই দলের নেতারা যখন বিলাইছড়িতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কর্তৃক মারমা তরুণী ধর্ষণ ও কিশোরীর শ্লীলতাহানির ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে তৎপর হয়। সেনাবাহিনী হোক বা অসেনাবাহিনী হোক ধর্ষণ করলে আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হয়। ক্ষমতাসীনদের এহেন পক্ষপাতিত্ব সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সমাবেশে নিলর্জভাবে মিথ্যাচার করেছেন এই তুচ্ছ ঘটনাকে নিয়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি করছে। আওয়ামীলীগ নেতা রাসেল মারমার সংবাদ সম্মেলনে ধর্ষণের মত ভয়ংকর ঘটনাকে আড়াল করা কিছের ইঙ্গিতবহ? অথচ সেখানে ভিকটিমদের ছোট ভাই মারমা ভাষায় স্পষ্টই বলেছে তার বোনদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটিয়েছে সেনা সদস্যরাই। মারমা দিয়েই মারমার বিরুদ্ধে সত্য ঘটনাকে মিথ্যা বানানো ষড়যন্ত্র করা এবং রাসেল মারমা দিয়েই এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনীতিকরণের কাজ আওয়ামী লীগই শুরু করে।
দীপংকর বাবু ও চিনু আপুরা তথাকথিত চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী, অবৈধ অস্ত্র ইত্যাদি ইস্যু হরহামেশাই বিবৃতি-বক্তব্য প্রদান করবে বা সভা-সমাবেশ আয়োজন করতে সক্রিয় থাকতে দেখা গেলে পার্বত্যবাসীর অধিকার সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সোচ্চার হতে কখনোই দেখা যায় না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়সমূহ- যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম (উপজাতীয়) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ; পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য আইনসমূহ সংশোধন; পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দাঁড় করানো; তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, মাধ্যমিক শিক্ষা, উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর; সেটেলার বাঙালি, অস্থানীয় ব্যক্তি ও কোম্পানী, সেনাবাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ভূমি বেদখল বন্ধ করা এবং বেদখলের ফলে উদ্ভূত পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা; ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ সেনাশাসনের অবসান করা; ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ র্প্বূক যথাযথ পুনর্বাসন করা; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকুরিতে পাহাড়িদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ করা; সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন করা ইত্যাদি বিষয়সমূহ বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার হতে একেবারেই দেখা যায় না, যা তাদের পার্বত্য চুক্তি পরিপন্থী ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী ভূমিকারই প্রতিফলন বলে নি:সন্দেহে বলা যেতে পারে।

Back to top button