বর্তমান সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরিণতি- বাচ্চু চাকমা
![](https://ipnewsbd.net/wp-content/uploads/2019/09/1076949_1571915243034014_4726622514820970147_o-1-690x400-1-1.jpg)
বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির সাথে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সম্পর্ক অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত রয়েছে। যার কারণে বাংলাদেশের কথা বলতে গিয়ে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের দিকে একটু ফিরে তাকাতে হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বস্তু পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং পরস্পরকে প্রভাবিত করে থাকে, যা ধ্রুব সত্য। আবার পার্বত্যা লের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে গেলে বাংলাদেশকে সেখানে অবশ্যই সংযুক্ত করতে হবে। যাহোক, এবার একটু বিশ্বের প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করি। পুঁজিবাদী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর পূঁজিবাদী দেশসমূহের প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকলেও, এ প্রভাব প্রতিপত্তি দিন দিন কমতে শুরু করেছে। বিশ্ব পূঁজিবাদী দেশসমূহের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পূঁজিবাদী অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দখল ও অন্যায়ভাবে আগ্রাসন চালিয়ে আসছে। সেই দখলকৃত অনেক দেশের সম্পদ লুন্ঠন করেছিল বা করছে।
পূঁজিবাদের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বিশ্বের পূঁজিবাদী দেশসমূহের অর্থনীতি দিন দিন দুর্বল হয়ে বিশ্ব অর্থনীতি মহামন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতি মহামন্দার দিকে ধাবিত হবার কারণে পূঁজিবাদী দেশের শিল্পপতিগণ তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ কিংবা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ চীন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি দেশের শিল্পপতির কাছে। বিশ্ব অর্থনীতির তালমাতাল অবস্থার প্রেক্ষাপটে আমেরিকার নেতৃত্বে চলা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বিপরীতে পাঁচটি দেশের নেতৃত্বে ব্রিকস, এআইআইবি ইত্যাদি ব্যাংক গড়ে উঠছে। বিশ্ব অর্থনীতির এহেন পরিস্থিতিতে রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া বিশ্ব রাজনীতি বা আ লিক রাজনীতির বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও পূঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহকে চ্যালেঞ্জ করছে। এভাবে সারা দুনিয়াকে ভাগ বাটোয়ারা করে সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলো তাদের একচেটিয়া ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এমনিতর অবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট কেমন হবে, একটু পর্যালোচনার দাবী রাখে বলে মনে করি।
বাংলাদেশের জাতীয় পরিস্থিতি সুখকর নয়। চারিদিকে শাসন শোষণের স্টিমরোলার চলমান রয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার তার ধারাবাহিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার হীন মানসিকতার কোন পরির্বতন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ এই আওয়ামীলীগ সরকারের শাসন, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের জর্জরিত। বলতে গেলে বিলুপ্ত প্রায় অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের কথা বললেও দেশে একদলীয় শাসন চলছে। গণতন্ত্রের লেবাসে এক ধরণের স্বৈরশাসন চলছে। বিগত সংসদে ‘জাতীয় পার্টি’ গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। সরকারের মধ্যে বামদলের অংশগ্রহণ ছিল। এসব দল নিজের দলীয় মার্কার পরিবর্তে আওয়ামী লীগের মার্কা ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা সরকারে অংশীভুক্ত হয়েছিল। বিএনপি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হলেও বর্তমানে এই দল নেতৃত্বের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের দু:শাসনের বিরুদ্ধে দেশের নাগরিক সমাজ, ছোট ছোট বাম সংগঠন ও জনগণ দাঁড়িয়ে গেলেও তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। তথাপি বিএনপি নেতৃত্বের সংকটের কারণে জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
দেশে রাজনৈতিক সরকার বিরাজমান থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সরকার চলছে সেনা আমলাদের কর্তৃত্বে ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। দেশে সেনা ক্যান্টনমেন্ট বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সেনা আমলা ও সেনা সংস্থা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির উপর প্রভাব বিস্তার করছে। যার কারণে দেশে দুর্নীতি, দু:শাসন ও দুর্বৃত্তায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ধনী আরো ধনী হচ্ছে, গরীব আরো গরীব হচ্ছে। দু’টি বড় দলের মধ্যে অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির চর্চা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে আমি মনে করি। আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশ্নেও দু:শাসন চাপিয়ে দিচ্ছে। এ সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন না করে চুক্তি লংঘন করে জুম্ম জাতিসমূহের নির্মূলীকরণের কার্যক্রমকে তীব্রতর করে চলেছে। পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠা কিংবা অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যেসব ক্ষেত্র অর্জন ও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে সেসব অর্জন ও সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে চলেছে। সমতলের আদিবাসী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী মানুষের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। দেশে নারী ধর্ষণসহ নারী সমাজের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি অব্যাহত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশের বর্তমান চালচিত্রের মধ্যে তেমন কোন পরিলক্ষিত হয় না।
বর্তমানে একদলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশ চলছে, যেখানে বিরোধী দল ছাড়াই একচেটিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। এই আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর পর বাংলাদেশের ধনীদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের সব দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধনীর সংখ্যা বা পুঁজিপতিদের সম্পত্তি বৃদ্ধি কি করে হল? এই সরকার কাদের সরকার? রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার একশ্রেণি লুটপাটকারী ঠাঁই পাচ্ছে এই ধনীদের দলে। ফলে এরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। যাদের সম্পত্তির পরিমাণ তিন কোটি ডলার বা আড়াইশ কোটি টাকার বেশি যুক্তরাষ্ট্রীয় ভিত্তিক এক গবেষণা সংস্থা ওয়েলটেক্সের বলছে তারাই অতি ধনী। গবেষণায় উঠেছে, ২০১২ হতে ২০১৭ সালের মধ্যে বিশ্বের ধনীদের সংখ্যা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। তাদের সম্পত্তি বৃদ্ধিকে দেশের অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এটা স্বজনপ্রীতির পুঁজিবাদ উত্থানের চিত্র। বৈষম্যের একটা প্রচন্ড বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের সম্পত্তি বাড়েনি অথবা ধনীর সংখ্যা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৃদ্ধি ঘটেনি। রাজনৈতিক ক্ষমতার আশির্বাদপুষ্ট হয়ে লোভনীয় সুযোগগুলো একচেটিয়া ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর কাছে যাচ্ছে, ফলে ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার এই প্রবণতা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে, বুঝা যায় না যে, রাষ্ট্রের দায়িত্বে কি সরকার, নাকি ধনীরা? অনেক ছোট ছোট বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে একটা বড় বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, এবং সেটা নিয়ে সরকার সেখানে পড়ে থাকে। তাহলে আমরা সহজে অনুমান করতে পারি এই সরকার ধনীদেরই সরকার।
এবার আলোচনায় চলে আসি সরকারের মূল পয়েন্টে। বাংলাদেশ সরকার কোন ধরনের সরকার। বিগত সময়ে বিএনপিকে এই একই রূপে দেখেছি আর বর্তমানে আওয়ামীলীগ সরকারকে তার চেয়ে বেশি দেখছি স্বৈরাচারী রূপে, একনায়কতান্ত্রিক সরকারের রূপে। অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী ও একনায়কতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্যগুলো এখানে পরিষ্কার করে জনগণের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি। মূলত এই সরকার হল এক জাতি, এক দেশ, এক নেতা একনায়কতান্ত্রিক সরকারের আদর্শ। এতে মনে করা হয় সবকিছু রাষ্ট্রের জন্য, এর বাইরে বা তাদের বিরুদ্ধে কিছুই নেয়। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে এরা নির্বাচিত হলেও এই সরকার জনগণের নিকট জবাবদিহিতা করে না। এতে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকে। এই দলের নেতাই হল সরকার প্রধান। তার ইচ্ছানুযায়ী সরকার পরিচালিত হয়। অন্ধ অনুসারীদের নিয়ে দল গঠন করে। গণমাধ্যম, রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদি ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে থাকে।এগুলো নিরপেক্ষভাবে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয় না। এই সরকার ব্যবস্থায় আইন ও বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। একনায়কের ইচ্ছা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন ও বিচারকার্য করা হয়। একনায়কতন্ত্র গণতন্ত্র বিরোধী। এটি ব্যক্তি স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না। এটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার খর্ব করে। যার কারণে ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। একনায়কতন্ত্র স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠা করে। কারণ একনায়ককে কারও নিকট জবাব দিহি করতে হয় না। তার কথায় আইন হয়, এতে ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও মুক্ত বুদ্ধি চর্চার সুযোগ নেই। এ শাসন ব্যবস্থা একক নেতার নেতৃত্বে চলে বলে বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে উঠার সুযোগ থাকে না। আবার রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় রাজনৈতিক সচেতনতাও তৈরি হয় না।একনায়কতন্ত্রে উগ্র জাতীয়তাবোধ ধারণ ও লালন করা হয়। ক্ষমতা ও ক্ষমতার লোভ একনায়কের মধ্যে যুদ্ধাংদেহী মনোভাব সৃষ্টি করে। হিটলার এধরনের মনোভাব পোষণ করে সারা পৃথিবীতে ধ্বংস ডেকে এনেছিলেন। এধরনের মনোভাব আন্তর্জাতিক শান্তির পরিপন্থী।
আমি লক্ষ্য করেছিলাম, বিভিন্ন সংস্থা হতে অনেকবার প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। সেই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পূরণ করছে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা, তথাকথিত ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, সাদা পোষাকধারী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক জোরপূর্বক অপহরণ ও গুম, নারীর উপর সহিংসতা, নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা এবং মৌলবাদীদের হামলা সংগঠিত করতে দেখা যায়। দিন দিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের ভিত ক্রমাগত দুর্বল হতে দুর্বলতর হয়ে পড়ছে। যার কারণে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। যুদ্ধ করে যারা বাংলাদেশকে অর্জন করেছিল; গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চার মূলনীতির জন্য লড়াই করেছেন যারা, তারা আজ পদদলিত হচ্ছে। বাংলাদেশ আজ গণতন্ত্রহীন হয়ে পড়েছে। চারিদিকে স্বৈরাচারের উত্থান ঘটেছে, যার কারণে জনগণ আজ অসহায়, নিরুপায় হয়ে পড়েছে। চরম নিরাপত্তাহীন অবস্থা বিরাজ করছে। আজ প্রশ্ন করতে চাই, কেমন আছে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ? আর জনগণই বা কেমন আছে? এক কথায় ভাল নেই! অথচ দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর এক সাগর রক্ত ঝরিয়ে অর্জন করা হয়েছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে অর্জন করতে গিয়ে ঝরেছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ আর ইজ্জত দিতে হয়েছে লক্ষ লক্ষ মা বোনের। এতো ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের মানুষ আজ স্বৈরাচারী, একনায়কতান্ত্রিক শাসনে বন্দী থাকবে কেন? স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য তো এটাই ছিল না। বরং গণতন্ত্রের বিপরীতে মুসোলিনী, হিটলার আর মেকিয়াভেলীদের মতোই কেন দেশ চলবে? পৃথিবীর সভ্য দেশের মানুষ যখন এই একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরোধীতা করছে তখন বাংলাদেশের ক্ষমতালোভী শাসকগোষ্ঠী কেনইবা এই জনবিরোধী শাসন আকড়ে থাকতে চায়?
আমি সত্যিই অবাক হই, যখন দেখি ফ্যাসিবাদের বক্তব্য সুরে সরকার দেশ শাসন করে! অর্থাৎ সব কিছুই রাষ্ট্রের জন্য, রাষ্ট্রের উপর কোন কিছুই না, আর রাষ্ট্রের বাইরে কোন কিছুই নেই। ফ্যাসিবাদের মতে রাষ্ট্রই সর্বশক্তিমান। ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয় বরং রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি। এই ফ্যাসিবাদ ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার বিশ্বাসী নয়। সমগ্র রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে একটি মাত্র দল। মুসোলিনী, হিটলার এদের কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়। পৃথিবীর নৃশংস হত্যাকারীদের মধ্যে হিটলারই সবচেয়ে বেশি কুখ্যাত ছিলেন। হিটলারের তথ্য উপদেষ্টা ছিলেন জোসেফ গোয়েবলস। এই গোয়েবলসের রূপটি ছিল একটা মিথ্যাকে বার বার বলতে থাকলে এবং প্রচার করতে থাকলে এক সময় তা সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেজন্য স্বৈরশাসকেরা মিথ্যাকে বার বার গোয়েবলসের প্রোপাগান্ডা চালিয়ে গিয়ে সত্য প্রমাণিত করতে মরিয়া হয়ে উঠে। কিন্তু মিথ্যার বিপরীতে সত্য কোনদিন মিথ্যা হয়নি। সত্য একদিন তার আসল জায়গায় পৌঁছে যায় এবং তারজন্যে সংগ্রামই অনিবার্য। ভুল আর নির্ভুলের মধ্যেকার সংগ্রামের ফলে এক পর্যায়ে বাস্তব সত্যটাই প্রমাণিত হয়। ইতিহাস তাই বলে দেয়।
এবার চলে আসি প্রিয় মাতৃভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি কেমন চলছে? এক কথায় পাহাড় কিংবা সমতল সকল আদিবাসীদের অবস্থা ভাল নয়। তারপরও পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির বুলেট পয়েন্ট কিছু তোলে ধরতে চাইছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বিচারে ভূমি বেদখল হচ্ছে। ভূমিহীন ও দরিদ্রের সংখ্যাও ব্যাপকহারে বেড়ে চলেছে। আদিবাসী নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। জুম্ম নারীর সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক অবক্ষয় আর অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে। অবাধে সেনাশাসন, সেনা নির্যাতন চলছে। নিপীড়ন নির্যাতন অব্যাহত আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের কারোরই নিরাপত্তা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সংস্কারপন্থীর সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জুম্ম জাতীয় বেঈমানসূলভ কার্যক্রম হিসেবে অধিক পরিচিত। জুম্ম দালাল-প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও তাদের নানা ষড়যন্ত্র আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে রক্তে কেনা তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোকে। জুম্মদের জন্য ক্ষতিকর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, পর্যটন, রাস্তাঘাট, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি অবাধে বাস্তবায়ন করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কার্যত বন্ধ রেখেছে; বরং চুক্তি লংঘন করে জুম্ম জাতিসমূহকে নির্মূলীকরণের কার্যক্রমকে সংহত ও সম্প্রসারিত করা হচ্ছে।
আঞ্চলিক পরিষদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। জেলা পরিষদের সমস্ত বিভাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। বিশেষ করে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সম্বলিত বিষয়গুলো হস্তান্তর করেনি। যেগুলো হস্তান্তরিত হয়েছে, সেগুলো জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য ও আওয়ামীলীগ এর প্রভাবশালী দালালীপনা ও ভন্ডামীরা লুটেপুটে খাচ্ছে। যার কারণে জুম্ম জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সুফল পাচ্ছে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে ৬টি ক্যান্টমেন্ট ব্যতীত বাকী সকল অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করার কথা থাকলেও কার্যত উল্টোটাই দেখা যায়। ২০০১ সালে ‘অপারেশন উত্তরণ’ জারির মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন, সেনা নির্যাতনসহ সেনাবাহিনীর কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারকামী সংগঠন জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দকে পাইকারী হারে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে অন্তরীন, ঘরছাড়া, এলাকা ছাড়া করে রেখেছে। শতশত জেএসএস কর্মীকে আজ জেলে অন্তরীন, ঘরছাড়া ও এলাকা ছাড়া করে জুম্ম জনগণের ন্যায্য আন্দোলনকে নস্যাৎ করার হীন তৎপরতা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ মানুষ, জুম্ম হলেই সেনাবাহিনীর নির্যাতন, ধরপাকড়, মিথ্যা মামলা ও ঘর থেকে তুলে নিয়ে “সেনাবাহিনী আর সন্ত্রাসীর মধ্যেকার গোলাগুলি অথবা বন্দুকযুদ্ধ নামে” ক্রশফায়ার দিয়ে পশু-পাখির মত গুলি করে মেরে ফেলছে। ভূমি বেদখল অব্যাহত রয়েছে। চুক্তির পর শাসকগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত পূঁজিপতি শ্রেণি ও আমলা শ্রেণি আদিবাসীদের ভূমি বেদখল করে বিভিন্ন বাগান গড়ে তুলেছে। ভূমি কমিশন আইন সংশোধন ও ভূমি বেদখল উদ্ধারের ক্ষেত্রে এই শ্রেণি কঠিন বাধা হিসেবে কাজ করেছিল। বর্তমানে ভূমি কমিশনের বিধি প্রণয়নে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে।
সরকার কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন বন্ধ রাখেনি, তার সাথে প্রতি পদে পদে চুক্তি পদদলিত ও লঙ্ঘন করে চলেছে। আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ স্থাপনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান করা হয়েছিল চুক্তিতে, যার মূল লক্ষ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীরা নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন করবে। কিন্তু আ লিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আলোচনা ও সম্মতি ব্যতিরেকে সরকার সীমান্ত সড়ক, বিজিবির অর্ধ-শতাধিক বিওপি স্থাপন, ঠেগা স্থল বন্দর স্থাপন ও ঠেগা-চট্টগ্রাম সংযোগ সড়ক, সাজেকে ট্রানজিট সড়ক, গুইমারা উপজেলা ও সাজেক থানাসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট স্থাপন, রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, অস্থানীয়দের নিকট ভূমি ইজারা প্রদান, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য আইন প্রণয়ন ও সংশোধন, জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে আ লিক পরিষদের কোন ধরনের সার্বিক তত্ত¡াবধান ও সমন্বয়ের কর্তৃত্বকে উপেক্ষা করে।
আঞ্চলিক পরিষদের সাথে পরামর্শ ব্যতিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে কোন আইন প্রণয়ন করা যাবে না। কিন্তু আঞ্চলিক পরিষদের পরামর্শ ব্যতিরেকে আইন সংশোধন ও প্রণয়ন চলছে যা পরিষ্কারভাবে চুক্তি লংঘন। সরকার ইচ্ছামত রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন করেছিলো, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধন করেছিলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়নবোর্ড আইন প্রণয়ন করেছিলো এবং নানা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলো, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির লংঘন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। চুক্তি লংঘন করে সীমিত ক্ষমতা দিয়ে ‘পর্যটন বিভাগ’ জেলা পরিষদে হস্তান্তর করেছিলো। চুক্তি লংঘন করে ডেপুটি কমিশনারের নিকট ‘স্থায়ী বাসিন্দা সার্টিফিকেট’ প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেছিলো। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী স্থায়ী বাসিন্দা সার্টিফিকেট প্রদান করতে পারবেন একমাত্র তিন সার্কেল চীফ তিন পার্বত্য জেলায়। তাহলে এবার দেখুন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী কিভাবে স্বৈরাচারের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন শোষণ করে চলেছে। এটা কি জুম্ম জাতিসমূহকে নির্মূলীকরণের কার্যক্রম নয়?
সেটেলার বাঙালি বসতিস্থাপন ও গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গা বসতিস্থাপন ও ভোটার হিসেবে অন্তর্ভূক্তকরণ করতে শাসকগোষ্ঠী মরিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষিত সেটেলার পুনর্বাসনের কার্যক্রম শুরু করেছিলো। সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বে ‘শান্তকরণ প্রকল্প’ অব্যাহত রেখেছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে রাস্তা নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। জুম্মস্বার্থ বিরোধী ও সংস্কৃতি বিরোধী ক্ষতিকর পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা হয়েছে। অপারেশন উত্তরণ ও সেনাশাসন অব্যাহতভাবে চলছে। যার কারণে সকল প্রকার সরকারী প্রশাসনের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। নির্বাচনে হস্তক্ষেপ, বাঘাইছড়ি উপজেলা, বরকল উপজেলায় ভূষণছড়া ইউনিয়নের নির্বাচন, রাঙ্গামাটি সদর উপজেলাসহ আরও অনেক জায়গায় সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ প্রশাসন, সামরিক বেসামরিক প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় নজিরবিহীন ভোট ডাকাতি করেছিলো শাসকগোষ্ঠী। বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন, বিভিন্ন উপজেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্যসহ সাধারণ জুম্ম জনগণকে গ্রেফতার করে পুলিশে হস্তান্তর ও মিথ্যা মামলা, জেলে প্রেরণ, হুমকি-ধামকি, নির্যাতন নিপীড়নের মাধ্যমে গোটা জুম্ম জাতিসমূহকে নির্মূলীকরণ অব্যাহত রেখেছে। ভূমি বেদখল কওে নূতন ক্যাম্প স্থাপন ও ক্যাম্প সম্প্রসারণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রশ্ন হল এহেন পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় জুম্ম জাতির করণীয় কি হবে? জুম্ম জাতির মধ্যেও ছাত্র ও যুব সমাজের করণীয় কি হবে? একটা উদাহারণ দিয়ে ছাত্র ও যুব সমাজকে জানাতে চাই, কোন একটা এলাকায় ঘরবাড়িতে ব্যাপক আগুন লেগেছে। এখন আগুন নেবাতে না পারলে এলাকার সব ঘরবাড়ি পুড়ে ছাঁই হয়ে যাবে। তাহলে সবার আগে কারা সেই আগুন নেবাতে যাবে? নিশ্চয়ই সেই এলাকার ছাত্র ও যুব সমাজকে সবার আগে এগিয়ে যেতে হবে। কেননা ছাত্র ও যুব সমাজের মধ্যে শক্তি, সাহস আর অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। এমতাবস্থায় পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, উগ্র জাতীয়বাদ ও মৌলবাদের ধারক-বাহক সরকার তথা শাসকগোষ্ঠীর যে কোন ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের বিকাশ সাধন এবং জুম্ম জনগণের ঐক্য সংহতি জোরদার করার কোন বিকল্প নেই।
তাই আবারও বলছি আসুন- প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রদর্শিত নীতি-আদর্শে অধিকতর সজ্জিত হয়ে পার্টি নেতৃত্বকে শক্তিশালী করি। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে জোরদার করার লক্ষ্যে জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতি অধিকতর জোরদার করি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম জনগণের বেঁচে থাকার ভিত্তিভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন জোরদার করি। চুক্তি বিরোধী অপশক্তি এর সংস্কারপন্থীর সশস্ত্র সন্ত্রাস নির্মূলীকরণের কার্যক্রম জোরদার করি। স্বৈরাচারী সরকারের অপশক্তিসহ দেশের উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদী তৎপরতা প্রতিরোধ আন্দোলনে অধিকতর একাত্ম হই। দেশের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক দল ও সংগঠনসমূহের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে অধিকতর সামিল হতে না পারলে গোটা বাংলাদেশ একটা কসাইখানায় পরিণত হতে তেমন সময় লাগবে না। সারা বিশ্বের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আরও একাত্ম হওয়ার জন্য ছাত্র যুব সমাজের অধিকতর প্রয়োজন মনে করি। সারা দুনিয়ার মুক্তিকামী আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক, জুম্ম জাতির মুক্তি অনিবার্য। পরিশেষে চারু মজুমদার এর সুরে সুর মিলিয়ে জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজকে আহবান করতে চাই, “টিকে থাকার অর্থই হল বিজয়” ছাত্র ও যুব সমাজের জীবনের লক্ষ্যবস্তু যেন তাই হয়। মুক্তিকামী আন্দোলনের অনিবার্য পরিণতি পর্যন্ত লড়াই চলবে, এ লড়াই হোক জুম্ম জাতির মুক্তির লড়াই।
বাচ্চু চাকমা : সাবেক সভাপতি, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ।