নিপীড়িত আদিবাসীদের নেতা অনিল মারান্ডী
বিশিষ্ট আদিবাসী নেতা অনিল মারান্ডী [জন্ম : ৯ জুলাই ১৯৫৭ প্রয়াণ: ৭ জানুয়ারি ২০১৯] রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের রাজাবাড়ীহাটের পাশে বাদুড়ঝোলা গ্রামে এক সাঁওতাল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। একসময় বাড়িতে ডাকাতি হওয়ার পর তাঁদের পরিবার বসবাসের জন্য চলে আসে পাশের কাঁকনহাট ইউনিয়নের পাঁচগাছিয়া গ্রামে। এখানেই তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বাবার নাম সুবল মারান্ডী, মায়ের নাম মেরী ম্যাগডালিনা হেমব্রম। বাবা-মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে অনিল মারান্ডী ছিলেন প্রথম। তাঁর স্ত্রীর নাম অগাস্টিনা মুর্মু। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন দুই পুত্র ও এক কন্যার জনক।
অনিল মারান্ডী পবা উপজেলার আন্ধারকোটা মিশন স্কুলে প্রাথমিক, হরিপুর কসবা উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক ও গোদাগাড়ির প্রেমতলী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। নানা কারণে তাঁর উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তাই বলে কখনো উচ্চাশা করা থেকে বিরত থাকেন নি। স্পষ্টভাষী ও জোরালো কণ্ঠ ছিল তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য। তিনি কখনো চুপিচুপি বা আস্তে কথা বলতেন না। তা সত্ত্বেও তিনি একদিকে অনেক বিনয়ী, সুভাষী ও অন্যদিকে সকল মানুষের প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন। ১৯৭১ সালে ১৪ বছর বয়সে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য যান। কিন্তু নানাকারণে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি একজন আদিবাসী যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৯২ সালে উত্তরবঙ্গের আদিবাসী নেতা রবীন্দ্রনাথ সরেনের সাথে দেখা হলে তাঁরা যৌথভাবে সমতলের আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের জন্য গণসংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ ৯ আগস্টকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ঘোষণা করার পর তাঁরা ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ জাতীয় আদিবাসী পরিষদ গঠন করেন। অনিল মারান্ডী জাতীয় আদিবাসী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপ্রধান হিসেবে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আন্তরিকতা ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। সভাপ্রধানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর তিনি আজীবন প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। পরবর্তীকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু)-এর নেতৃত্বে ২০০০ সালে আদিবাসীদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম গঠিত হলে তিনি ফোরামের সহ-সভাপতির দায়িত্ব নেন। আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি সোচ্চার ছিলেন এবং দেশে ও দেশের বাইরে আদিবাসীদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। আদিবাসীদের জান-মাল, ভূমি, সম্পদ, অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় রাজপথে থেকেছেন। প্রয়াত এই নেতা সবসময় আদিবাসী ছাত্র-যুব বিশেষ করে আদিবাসী ছাত্র পরিষদ ও আদিবাসী যুব পরিষদ সদস্যদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করতেন।
বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই এই ধরনের ঘোষণা আদিবাসীরা মেনে নিতে পারেনি। তাই এর প্রতিবাদে যখন আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে, সেই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন অনিল মারান্ডী। তাই তিনি শুধু সাঁওতালদের নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন সকল নিপীড়িত আদিবাসী মানুষের নেতা।
২০১০ সালে জাতীয় সংসদে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০ পাস হলে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, এতদিনে আমাদের মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। তারা কি তাহলে এই বিল পাস হবার পুর্বে আমাদের জন্তু-জানোয়ার মনে করতেন?’
তিনি রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি ছিলেন বলে অনুধাবন করেছিলেন রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন হয়ে ও সকল ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে জাতীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধিত্ব করতে না পারলে আদিবাসীদের মুক্তি ঘটানো সম্ভব নয়। তাই তিনি ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। আদিবাসী হিসেবে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন তিনি লালন করতেন বলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০৮এ নওগাঁ-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আদিবাসীদের পক্ষে ভোটযুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত অনিল মারান্ডী ছিলেন সমতলের অবিসম্বাদিত আদিবাসী নেতা।
…………………………………………………
হরেন্দ্রনাথ সিং, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম