মতামত ও বিশ্লেষণ

এম এন লারমা’র গণ জিজ্ঞাসা ও সর্বাঙ্গ সুন্দর দেশের ভাবনাঃ কেন সেটি এখনও প্রাসঙ্গিক?- সতেজ চাকমা*

‘গণ’ শব্দটির অর্থবোধক ব্যাপকতা বহুদূর বিস্তৃত। এই গণ পদটির বহুল ব্যবহৃত প্রতিশব্দ হল জনগণ। রাজনৈতিক অঙ্গনের সকল ব্যক্তি প্রায় সময় বলে থাকেন তাদের যত ত্যাগ, যত কাজ, যত ভাবনা সমস্ত কিছুই জনগণকে কেন্দ্র করেই। সাংবাদিক সমাজও বলে থাকেন তাদেরও লেখালেখি জনগণের জন্য এবং অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করবার নিমিত্তে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে মেরুকরণ দৃশ্যমান তার প্রধান দু’টি প্রতিপক্ষ আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র যুক্তি ও বক্তৃতাবাজি (Rherotic) শুনলে বোঝা যায় যে দলগুলো বলার চেষ্টা করে তাঁদের সমস্ত কর্মসূচী ‘জনগণের জন্য’। আওয়ামীলীগ ক্ষমতা ঠিকিয়ে রাখতে চায় বাংলাদেশের জনগণের জন্য আর বিএনপিও আওয়ামীলীগকে ক্ষমতা থেকে হঠাতে চায় ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য’। প্রশ্ন হল- জনগণের আসল বন্ধু কারা ? যাইহোক, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একধরণের অনিশ্চয়তা ও কিঞ্চিত অস্থিরতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ বলছে তারা ‘গণতন্ত্র অব্যাহত রাখার’ সংগ্রাম করছে আবার প্রতিপক্ষ বিএনপি বলছে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ সংগ্রাম করছে তারা। কাজেই এই যে গণতন্ত্রের খেলায় অর্থাৎ, গণতন্ত্র অব্যাহত রাখা বা পুনরুদ্ধারের যে সংগ্রাম তাতে আসলে বার্গারের মাঝখানে চাপা পড়ে থাকা মাংস টুকরার মত হাঁপিয়ে উঠে রুদ্ধ হয়ে পড়েছে জনগণ। কথায় আছে, রাজা আসে রাজা যায়। কিন্তু জনগণের দোহায় দিয়ে যারা ক্ষমতার মসনদে বসে বা মসনদ তছনছ করার ফন্দি আঁটে আসলে সেখানে ‘জনগণ’ বলতে যাদের বোঝানো হয়, তাদের ভাগ্য করটা পরিবর্তন হয়। কিন্তু তার আগেও জরুরী প্রশ্ন হল মানুষের ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ নিশ্চিত করবার মহান শপথ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যে দেশ স্বাধীন করেছিল সেখানে ‘জনগণ’ বলতে যাদেরকে বোঝানো হয়েছে তার অর্থবোধকতা, পরিধি বা বিস্তৃতি আসলে কতটুকু?

এর উত্তর খুঁজতে গেলে যেতে হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময়ে করা তৎকালীন জনপ্রতিনিধিদের গণপরিষদ বিতর্ক এবং ১৯৭৩ সালে নবগঠিত জাতীয় সংসদের আলোচনাগুলোতে। তখন বোঝা যাবে যারা সেসময় দেশের মানুষ আগামী দিনে কীভাবে পরিচালিত হবে তার রোডম্যাপ হিসেবে সংবিধান রচনার মহান দায়িত্বে ছিলেন তাঁদের বোধের মধ্যে ‘জনগণ’ বলতে আসলে কারা ছিল। এই প্রশ্নগুলো সামনে নিয়ে আসছি যখন দেশের দ্রব্যমূল্যের বাজার চড়া। সংবাদ মাধ্যম খুললে বোঝা যাচ্ছে, একেবারেই জনগণ বলতে যাদের বোঝানো হয় তারা আজ অসহায়। আয়ের পরিসীমার সাথে ব্যয় করার জন্য যে নিত্য পণ্যের দর তার মধ্যে বহু ফারাক। ফলে রিক্সাচালক, কুলি, মজুর, শ্রমিকসহ নি¤œ আয়ের মানুষ আজ নাজেহাল। অন্যদিকে গোটা দেশের এমনি একটা অর্থনৈতিক টানপোড়নের মধ্যে গত ১১ অক্টোবর ২০২৩, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের জন্য ২৬১ টি গাড়ি ক্রয়ের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে সরকারের অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি । এসব গাড়ি ক্রয়ে ব্যয় হবে তিনশ’ একাশি কোটি আটান্ন লাখ টাকা। দেশের অর্থনৈতিক বিভাজনের এটি কেবল একটি ছোট নমুনা। এরকম ভুরি ভুরি নানা উদাহরণ টানা যাবে। মোদ্দাকথা হল ধনীরা এমশ ধনী হচ্ছে এবং গরীব ক্রমশ গরীব হতে হতে প্রান্তিকতায় পর্যবসিত হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে- তার উত্তর অর্থনৈতিক ব্যাখ্যায়ও পাওয়া যাবে। তবে আমার আলোচনা ইতিহাসের নিরিখে। ঐতিহাসিক কাল ধরে দেশে যারা ‘জনগণ’ এর দোহায় দিয়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করছে আর শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেছে এবং নানা পলিসি প্রণয়ণ করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে তাঁদের ভাবনার ক্যানভাসে ‘জনগণ’ বলতে আসলে কারা থাকে? কারণ তারাই তো নির্ধারণ করছে কার জন্য কত টাকা দরের লাক্সারি গাড়ি ক্রয় করা হবে আর কাঁচা সবজির ভ্যানের পাশে গিয়ে গোমড়ামুখো হবে কারা!

এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে পেছনে ফিরতে হবে। ১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন একটি দেশ। বাঙালি জাতীয়তাবাদে টইটুম্বুর এবং তরতাজা চেতনায় স্বাধীন হওয়া একটি দেশের সংবিধান রচনা হচ্ছে গণপরিষদে। গণপরিষদের পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ যেটি এখন বাংলাদেশ তার অংশে যে ১৬৯ টি আসন ছিল সেখানে ১৬৭ টি আসন লাভ করেছিল বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ। এ ১৬৭ টি আওয়ামী গণপরিষদ সদস্যের বিপরীতে দু’জন কেবল স্বতন্ত্র সদস্য। একজন বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (ন্যাপ থেকে নির্বাচিত) অপরজন সংখ্যালঘুরও সংখ্যালঘু জনের প্রতিনিধি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, সংবিধান রচনার সময় সংঘটিত গণপরিষদ বিতর্ক অনেকটা তৎকালীন সংবিধান প্রণয়ণ কমিটির সভাপতি ও আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বনাম সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও এম. এন লারমা এর সংলাপ। এসব সংলাপগুলোতে পাহাড় থেকে নির্বাচিত সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ‘গণ’ জিজ্ঞাসা বারংবার তৎকালীন জাত্যাভিমানী আইন প্রণেতাদের ‘জনগণ’ বিষয়ক ভাবনার জগতে যে ব্যাপ্তি তাতে করেছে বারংবার আঘাত। গণপরিষদ বিতর্কের সময় সর্বমোট ১৬৩ টি সংশোধনী প্রস্তার উত্থাপিত হয়। তার মধ্যে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ছিল ২৫ টি সংশোধনী প্রস্তার যার একটিও পাস করেনি সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি ও দলের সদস্যরা ।

মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা

পাহাড়ের প্রান্তজনের প্রতিনিধি হিসেবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নানাভাবে তাঁর এই সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন এবং আঘাত করেছেন তৎকালীন শাসকদলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের চিন্তাকাঠামোতে। সেদিন ছিল ৭ এপ্রিল ১৯৭৩। নবগঠিত জাতীয় সংসদের সদস্যদের শপথ গ্রহনের পূর্বে পবিত্র কোরান থেকে সুরা ও গীতা থেকে শ্লোক পাঠ করে সংসদে দিনের কর্মসূচী শুরু হল । যারা শাসক চেয়ারে ছিল তাঁদের কাছে সেটি হয়ত স্বাভাবিকই ঠেকেছে। কিন্তু সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র গণ জিজ্ঞাসার জাল সেটিকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করল। তিনি দেখলেন, যে দুই ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হল সেগুলো পুরো দেশের মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করে না। তাঁর প্রশ্ন- “দেশে কেবল হিন্দু ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী লোক নেই। বাংলাদেশে বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী লোকজনও বসবাস করেন। কাজেই কেন ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকেও পাঠ করা হবে না?

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র এই প্রস্তাবের পক্ষে আইনমন্ত্রী আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ২ জুন ১৯৭৩ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে আবার একই বিষয়ে পুন:দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হচ্ছে। তবে এবার তাঁকে অনেকটা কটাক্ষ করা হল। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর (যিনি পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের নির্মম হত্যাকান্ডের পর গঠিত খন্ডকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায়ও আইনমন্ত্রী ছিলেন) মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’কে কটাক্ষের সুরে বলছেন- “ত্রিপিটক পাঠ করার মত একমাত্র মাননীয় লারমা ছাড়া এখানে কেউ নাই। তিনি যদি পাঠ করতে চান তবে মাননীয় স্পীকার সাহেব পড়ার অনুমতি দেবেন। কাজেই পরিষ্কার ঘোষণার কোনো প্রশ্ন নাই”। মনোরঞ্জন বাবুর আরেক মত হল- ‘হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মে কোনো প্রভেদ নাই’। এই হল তৎকালীন আইন প্রণেতাদের যুক্তি।

কিন্তু মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ক্ষুরধার যুক্তি “ত্রিপিটক পাঠ করার জন্য” তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসেননি। তাঁর কথা স্পষ্ট, যে দেশের মানুষের জন্য তারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদে পলিসি প্রণয়ণ করছেন, কথা বলছেন, আলোচনা করছেন সেই সকল রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম, ভাবনা, চিন্তা, চর্চা ও মনস্তত্বে সকল জনগণের প্রতিনিধিত্ব আছে কী না, সেটা নিশ্চিত করা। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ‘গণ’ জিজ্ঞাসার কেন্দ্রে তাই সবসময় ছিল সার্বজনীনতা। তাইতো আবার ১৫ জানুয়ারি ১৯৭৪ সালে দেখা যাচ্ছে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আবারও পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁিড়য়ে স্পীকারকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন- কেন পবিত্র বাইবেল থেকে পাঠ করা হবে না? কারণ, সেদিন কেবল কোরান, গীতা ও ত্রিপিটক থেকে পবিত্র বাণী পাঠ করা হয়েছিল।

কেবল সকল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের প্রস্তাবনা দিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ক্ষান্ত থাকেন নি। তাঁর প্রস্তাবনা ছিল দেশের সকল শ্রেণী, পেশা, বর্ণ, জাতি ও লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে। তিনি যেসময় এই প্রশ্নগুলো সংসদে তুলছেন তখন যদি বাংলাদেশকে কল্পনা করা যায় তা হবে এরকম- যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ। যুদ্ধ পীড়িত মানুষ স্বপ্নের খোঁজে ছুটছে নানা প্রান্তে। প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো সেভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। সমস্ত ক্ষেত্রেই হা-ভাতে মানুষের হাহাকার। এমনি একটা সময়ে ১৩ জুলাই ১৯৭৪ সালে সংসদে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তৎকালীন সমাজকল্যাণমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছেন- “দেশে ভবঘুরে মানুষের সংখ্যা কত?” সমাজকল্যানমন্ত্রী আব্দুল মান্নানের উত্তরে বোঝা যায় তিনি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রশ্নের মধ্যে যে চিন্তা সেটাকে গুরুত্বই দেননি। বরং বললেন, “এরকম সংখ্যা নির্ধারণে সরকার ভবিষ্যতে ব্যবস্থা গ্রহন করবে কী না তা বিবেচনা করবে।” এমনি উপক্ষিত জবাবেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’কে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব চিন্তার মধ্য দিয়ে যদি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’কে পাঠ করা যায় তবে দেখা যাবে যে, তিনি রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন নানাভাবে। যে জনগণের জন্য রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা আইন প্রণয়ণ করেন, নীতি-কৌশল নির্ধারণ করেন তাঁদের চিন্তা ও মনস্তত্বে সমস্ত জনের প্রতিনিধিত্ব যেন সেগুলোতে থাকে। কিন্তু সমাজের কোন স্তরে কারা কীভাবে পড়ে আছে, কতজন কোন অবস্থায় আছে সেসব যদি নাইবা জানি তবে সে ‘জনগণ’ এর জীবন বদলের জন্য আইন বা নীতি প্রণয়ণ করবে কীভাবে?

ভবঘুরের সংখ্যা জানার চেষ্টা করা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা একবার সমাজকল্যান মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন- “বাংলাদেশর যে যে শহরে পৌর কর্তৃপক্ষের অনুমতিপ্রাপ্ত পতিতালয় চালু আছে সেসব শহরের প্রত্যেকটিতে অনুমোদিত বারবণিতার সংখ্যা কত?” মলত, বাংলাদেশের পল্লীর আনাচে কানাচে যেসব নারীরা দেহ বিক্রি করে জীবন অতিবাহিত করছে তাঁদের সংখ্যা জানতে চান মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। সেদন ছিল ২৭ জুন, ১৯৭৩। সংসদে তিনি প্রশ্ন করছেন- “সরকার সম্প্রতি কোন কোন শহরে বারবণিতাদের উচ্ছেদ করিয়াছেন? তাহাদের পুনর্বাসনের জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহন করা হইয়াছে?” একই জিজ্ঞাসায় তিনি উত্থাপন করেন, “সরকার সামগ্রিকভাবে বারবণিতাদের (পতিতাদের) পুনর্বাসনের জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহনের ইচ্ছা রাখেন কী না? ”

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র এমনি জিজ্ঞাসায় তৎকালীন সমাজকল্যাণমন্ত্রী বলেছেন- “তথ্যগুলি সংগ্রহ করা হচ্ছে।” আমি অনেকটা নিশ্চিত যে, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ভাষ্যে ‘নরক যন্ত্রণায় থাকা’ পতিতাবৃত্তির সাথে যুক্ত নারীদের সংখ্যা এখনো সরকারের তালিকায় নেই এবং তাদের জীবন বদলের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা এখনও প্রণয়ণ করা হয়নি।

সমাজের নানা স্তরের মানুষের জীবন বদলের প্রস্তাবনা ছাড়াও বাক স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার বিষয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নানা প্রশ্ন সংসদে উত্থাপন করেছেন যেগুলো বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতৃত্বের জন্য অবশ্য পাঠ্য বলে মনে করি। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখেছি দেশে সরকারী টেলিভিশন ও বেতার ব্যবহৃত হয় ক্ষমতার মসনদে থাকা দলটির প্রচার মাধ্যম হিসেবে। অথচ নাম দেয়া হয় বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতার। কিন্তু এই দুই প্রতিষ্ঠান যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের প্রচার প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশ বেতার রাঙ্গামাটি থেকে প্রচারিত নানা খবরগুলো আমিও অনুসরণ করবার চেষ্টা করি। বাংলা ছাড়াও চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় নানা অনুষ্ঠান ও খবর প্রচারিত হয় সেখানে। তবে খবরগুলো অনেকটা রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগের নিয়মিত কর্মসূচীর আপডেট হিসেবেই আমি দেখেছি। এ বিষয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ৪ জুলাই ১৯৭৩ সালে তথ্য ও বেতার মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন- “রাষ্ট্রায়ত্ত¡ সংবাদ, বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে সরকার বিরোধী মতামত উপস্থাপনের সুযোগ-সুবিধা আছে কী না? থাকলে উহা কী? ”

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র এমনি প্রশ্নে দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী শেখ আব্দুল আজিজ খান যদিও “বাংলাদেশের সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বার্ধীনতা রহিয়াছে” বলে যে গালমন্দ করেছেন তা আজকের বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার দেখলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। কেননা, বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দা খুললেই আমরা শাসক দলের নানা কর্মসূচী ও উন্নয়ন ফিরিস্তি প্রচার বৈ আর কিছু দেখি না। তাইতো প্রায় সময় দেশের বিরোধী মতের উপর নানা দমন পীড়ন চলমান থাকলেও এবং সমাজে নানা অসঙ্গতি চোখে পড়লেও বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় এসব খবরের বিপরীতে দেশের নানা প্রান্তের বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলনের কথা বারংবার চোখে পড়ে।

নানা জনের লেখায় ও আলোচনায় সংসদে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দাবি করা ‘আমি বাঙালি নই’ এমন বাস্তবসিদ্ধ আলাপগুলো প্রায় মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু তিনি কেবল পাহাড়ের মানুষের জন্য নয় । বরং মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র চিন্তা ও মনস্তত্তে¡র ক্যানভাসে ‘জনগণ’ বলতে যারা আছে তার ব্যাপ্তি বেশ প্রসারিত। তিনি যে অঞ্চল থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাঁদের অধিকারের কথা যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি মেথরের জন্যও নতুন ভোরের স্বপ্ন এঁকেছেন তাঁর প্রস্তাবনায়। একই সাথে বেদে, কামার, কুমোর, পতিতা এমনকি ভবঘুরে মানুষের জীবন বদলের কথাও তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর নানা প্রস্তাবনায়। কাজেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র গণ জিজ্ঞাসার জাল সমাজের সকল শ্রেণী, পেশা, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতি ও ধর্মকে নিয়েই বিস্তৃত। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র এই ‘গণ’ ভাবনার বহিপ্রকাশ পাওয়া যায় গণপরিষদে দেওয়া তাঁর প্রথম প্রস্তাবনার মধ্যেও। সেদিন ছিল ১৯ অক্টোবর ১৯৭২। তাঁর বন্ধু গণপরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রস্তাবনা দিয়েছেন সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধান যেহেতু প্রণয়ণ হচ্ছে সেই খসড়া সংবিধানটির পক্ষে-বিপক্ষে জনমত যাচাইয়ের জন্য ৩০ অক্টোবর ১৯৭৩ পর্যন্ত প্রচার করা হোক । সেই প্রস্তাবের একমাত্র সমর্থনকারী হিসেবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদে দাড়িয়ে বলেছেন- “এই মহান গণপরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নর-নারীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। তাই যেসব নীতির উপর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে চলেছে সেসব নীতি যদি ঠিক ভাবে সংযোজিত না হয়, তাহলে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে ।”
কিন্তু কার কথা কে রাখে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রস্তাবকে ‘মূল্যবান সময় নষ্ট করার’ সামিল বলে উল্লেখ করেছেন। ফলে গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠদের কন্ঠভোটে সেই প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়।

একই বক্তৃতায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলেছেন, “তাড়াহুড়ো করে সংবিধান পাশ না করে, একদিন দেরী করে, প্রয়োজন হলে দশ দিন দেরি করে আলোচনার মাধ্যমে সংবিধানকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করতে চেষ্টা করবো।” কিন্তু যিনি সর্বাঙ্গ সুন্দর সংবিধানের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে একটি সর্বাঙ্গ সুন্দর দেশ কল্পনা করেছেন সেই দেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি আজ নানা গোঁজামিলে পূর্ণ। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র প্রতিনিধিত্ব করা জুম্ম জনগণের ভাগ্য আজ অনিশ্চিত এক পথে ধাবমান, দেশের অপরাপর আদিবাসী মানুষের অধিকার আজ ভুলুন্ঠিত। নি¤œ আয়ের মানুষসহ নানা ক্ষেত্রে যারা প্রান্তিকতার সীমায় যাপন করছে নিজেদের জীবন তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নীতি বা কর্মপরিকল্পনা নেই সরকারের নীতি নির্ধারকদের। তাঁদের কাছে ‘জনগণ’ বা ‘গণ’ অর্থে যাদের বোঝানো হয় তার পরিধি খুবই সীমিত। অথচ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র গণ জিজ্ঞাসায় আছে সর্বজন । কানা, বোবা, খোঁড়া, জুম্ম, আদিবাসী, বাঙালি, অ-বাঙালি, সরকারী দল, বিরোধী দল, পুরুষ, নারী, প্রতিষ্ঠিত মানুষ কিংবা ভবঘুরে, মেথর, জেলে, কামার এমনকি বেদে । ত্ইা এখনও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র গণ জিজ্ঞাসা সর্বাঙ্গ সুন্দর দেশ নির্মাণের জন্য অতিঅবশ্যই প্রাসঙ্গিক।

*তরুণ লেখক ও আদিবাসী অধিকার কর্মী

(নোট: লেখাটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত “১০ নভেম্বর স্মরণে ২০২৩” স্মরণিকায় প্রকাশিত)

Back to top button