মতামত ও বিশ্লেষণ

এক আলফ্রেড সরেনঃ বিচারহীনতার ১৯ বছর

চেঙ্গী নদীর কান্না , ভীমপুরে মিশে গেলো আলফ্রেড সরেনের তাজা রক্তে – মাদল

২০০০ সালের ১৮ আগস্ট, ঘড়ির কাটায় সকাল এগারটা, ভূমি দস্যু হাতেম ও গদাই লস্কর তার দেড়শতাধিক ভাড়াটিয়া খুনি সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে নওগাঁ জেলার, মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর গ্রামের ১৩টি আদিবাসী পরিবারের উপর যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও তাণ্ডবলীলা চালায় তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানায়। অতর্কিত এই আক্রমণে আদিবাসীরা হত বিহ্বল হয়ে পড়ে। খুনিরা চিৎকার করে খুজতে থাকে আলফ্রেড সরেনকে। একেরপর এক বাড়ী আগুনে জ্বালিয়ে দিতে দিতে অগ্রসর হয় খুনিরা। সামনে যাকে পায় তার উপর চলে পৈশাচিক নির্যাতন। শিশুদের হাত পা ধরে পুকুরে ছুড়ে মারা হয়। আদিবাসী পরিষদের নেতা বৃদ্ধ জগন্নাথ সরেণ ও যতীন সরেণ নামে ৩০ বছরের এক যুবককে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। আলফ্রেড সরেনের বড় ভাইয়ের স্ত্রী পানসিরির পেটে লাথি দেবার ফলে তার গর্ভচ্যুতি ঘটে।

চারিদেকে যখন আদিবাসীদের আত্ম-চিৎকার আর আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে, তখন খুনিরা উন্মত্ত খুনের নেশা আলফ্রেড সরেনকে খুজছিল। তখন বোন রেবেকা সরেন ভাইকে নিয়ে বাঁচার জন্য পাশের বাড়ীর ভিতরে ধানের বস্তার ফাঁকে আশ্রয় নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ঘরেও আগুন ধরিয়ে দেয় খুনিরা। আগুনের উত্তাপে টিকতে না পেরে রেবেকা সরেন ঘরের জানালা ভেঙ্গে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই খুনিদের হাতে ধরা পড়ে আলফ্রেড সরেন। খুনিরা রামদা, চাইনিজ, কুড়াল, বল্লম দিয়ে একেরপর এক আঘাত করতে থাকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আলফ্রেড সরেন। আহত অবস্থায় খুনিদের কাছে হাত পা কেটে ফেললেও কিন্তু প্রাণে মেরে না ফেলার আকুতি জানালেও খুনীরা সে কথা শুনেনি। বরং সন্ত্রাসীরা উপর্যপুরি বর্শার ফালার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত আলফ্রেড সরেনের শরীরে আঘাত করতে থাকে পরে মৃত্যর কোলে ঢলে পড়ে। বোন রেবেকা সরেন মাত্র ৫০ গজ দুরে
দাঁড়িয়ে থেকে ভাইয়ের মৃত্যু দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি।

সেসময় আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে ছাই হয়ে যায় ভীমপুরের আদিবাসী পল্লীর ১৩টি পরিবার। ৩০/৩৫ জান আদিবাসী মারাত্বকভাবে আহত হয়। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিন ঘন্টা ব্যাপি চলে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। দীর্ঘ সময় ব্যাপী এই নারকীয় তাণ্ডব চললেও রহস্যজনকভাবে পুলিশ নিরব ও নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

ভীমপুর গ্রাম ও মৌজার ১৬৬ ও ১৬৮ দাগের এক একর জমির উপর তখন যে ১৩টি আদিবাসী সাঁওতাল পরিবার বসবাস করত। এর অল্প দুরে ৯০/৯৫ বিঘা খাস জমি ছিল। সেই জমি দরিদ্র আদিবাসী ও এলাকার ভূমিহীনদের কাছে বন্দোবস্ত দেবার জন্য আলফ্রেড সরেন এলাকার ভূমিহীন ও আদিবাসীদের সংগঠিত করে তাদের মাঝে বিতরণ করতে চেয়েছিল। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নওগাঁ জেলার এই নেতাকে ভূমি দস্যু হাতেম গদাই গং ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী নির্মমভাবে খুন করে। যে দিন আলফ্রেডকে হত্যা করা হয় সেই দিন স্থানীয় নওহাটা মোড়ে ভূমিহীনদের সমাবেশ হবার কথা ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে সমাবেশের মঞ্চ তৈরীর কাজ দেখাশুনা করে ১০টা ৩০ মিনিটের দিয়ে বাড়ীতে খেতে আসার পরপরই এই ঘটনা ঘটে।

আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় তার ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দু’টি মামলা করেন। মামলায় মহাদেবপুর থানা পুলিশ তদন্ত শেষে ৯১ জন আসামির নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পুলিশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতারও করে। ওই সময় নওগাঁ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছিল। মামলার প্রধান ২ আসামি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাতেম আলী ও সীতেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাইসহ ৬০ জনের অধিক আসামি জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে হাইকোর্ট ৩ মাসের জন্য মামলাটির স্থগিতাদেশ দেন। ওই সুযোগে আদালত থেকে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসেন। উচ্চ আদালতে রিটপিটিশন নম্বর ২৩২২/২০০১ এবং সিভিল পিটিশন নম্বর ৪২০/২০০৩ । আসামিরা বর্তমানে এলাকায় অবস্থান করছেন। উচ্চ আদালতে মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আছে।

ভীমপুর গ্রাম ও মৌজার ১৬৬ ও ১৬৮ দাগের এক একর জমির উপর তখন যে ১৩ আদিবাসী সাঁওতাল পরিবার বসবাস করত, তার অল্প দূরে ৯০/৯৫ বিঘা খাস জমি ছিল। সেই জমি দরিদ্র আদিবাসী ও এলাকার ভূমিহীনদের কাছে বন্দোবস্তো দেবার জন্য আলফ্রেড সরেন এলাকার ভূমিহীন ও আদিবাসীদের সংগঠিত করেছিলেন।

আলফ্রেড সরেন হত্যার আজ ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের কোন বিচার হয়নি। যে জমিকে কেন্দ্র করে আলফ্রেড সরেনকে জীবন দিতে হয়েছে, সেই জমি এখন খুনিদের দখলে। খুনিরা জমির ফসল বিক্রি করে মামলার খরচ চালাচ্ছে।

আজকের এই দিনে আলফ্রেড সরেনকে স্মরণ করছি বিনম্র ভালবাসা এবং শ্রদ্ধায়। আদিবাসীদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার চলমান জীবনে আলফ্রেড সরেন বেঁচে থাকবেন অগ্নি মশাল হয়ে ।

নিপুণ ত্রিপুরা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Back to top button