উন্নয়নের নামে প্রাণ প্রকৃতি বিনাশী প্রকল্পের জন্য জনগণের অর্থ বরাদ্দ দেয়া চলবে না
তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আয়োজিত ‘রামপাল, রূপপুর ও বাজেট ২০১৯-২০’ শীর্ষক পর্যালোচনা সভ ও প্রেস ব্রিফিংএ বলা হয়েছে, উন্নয়নের নামে প্রাণ প্রকৃতি বিনাশী বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য জনগণের অর্থ বরাদ্দ দেয়া চলবে না। রামপাল, রূপপুর, মাতারবাড়ীর এসব প্রকল্প উন্নয়ন নয়, ধ্বংস প্রকল্প।
আজ ২২ জুন সকাল ১১টায় পুরানা পল্টনস্থ মুক্তিভবনের প্রগতি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। বক্তব্য রাখেন জাতীয় কমিটির সংগঠক রুহিন হোসেন প্রিন্স, আব্দুস সাত্তার, আবুল হাসান রুবেল, মাহা মির্জা, প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা, খান আসাদুজ্জামান মাসুম। শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, মোশারেফ হোসেন নান্নু, জুলফিকার আলী, আকবর খান, শওকত আহমেদ, নাসির উদ্দিন নসু, জাহাঙ্গীর আলম ফজলু, শহিদুল ইসলাম সবুজ, সামসুল আলম, খালেকুজ্জামান লিপন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এসময় উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত বক্তব্যে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ’সরকার উন্নয়নের নামে এমন অনেক প্রকল্প নিয়ে এগুচ্ছে যেগুলো দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য শুধু আর্থিক বোঝাই সৃষ্টি করবে না, প্রাণ প্রকৃতি বিনাশ করে দেশ ও জননিরাপত্তাকে বিপর্যস্তও করবে। উন্নয়নের কথা বলেই সরকার এখনও সুন্দরবন বিনাশী রামপাল প্রকল্প অব্যাহত রেখেছে। বিশ্ব দরবারে মিথ্যাচার করে বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ আরও তিন শতাধিক বিপজ্জনক প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। ইউনেস্কোকে দেয়া বিশ্ব ঐতিহ্য রক্ষার অঙ্গীকার ভঙ্গ করে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে হেয় করেছে। সরকারের এই ভূমিকায় একদিকে বাংলাদেশ অরক্ষিত হচ্ছে অন্যদিকে সুন্দরবন তার বিশ্ব ঐতিহ্য মর্যাদা হারাতে বসেছে।’
তিনি বলেন, ‘পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অস্বাভাবিক খরচের বিষয়টি ইতিমধ্যে পৃথিবীর অনেক দেশের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাথমিক খরচ ধরা হয়েছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। গত ৯ বছরে এই খরচ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ১৮ হাজার কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের মোট বাজেটের ৫ ভাগের এক ভাগ। এখানে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজে ফিক্সড কস্ট মডেলের পরিবর্তে নির্মাণ চুক্তি হয়েছে ‘কস্ট প্লাস’ মডেলে। এর ফলে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রোসাটমের পক্ষে খরচের অঙ্ক দফায় দফায় বাড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে সারাবিশ্ব এগুচ্ছে। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়টি সামনে আনা হলে দাবি করা হয় যে, সৌর এবং বায়ু বিদ্যুতে বিপুল পরিমান ভর্তুকি দিতে হয়। অথচ, যে সত্যটি গোপন করা হয় তা হলো কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ আপাদমস্তক রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির উপর নির্ভরশীল। শুধুমাত্র নির্মাণ খরচই নয়, কয়লা এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের হিডেন কস্ট বা লুক্কায়িত খরচ, যেগুলো জনগণের সামনে আসেনা। যেমন রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের লক্ষে নৌপথ তৈরিতে সংলগ্ন নদীগুলোতে প্রয়োজনীয় ড্রেজিং করতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় ৯৫৬ কোটি টাকা। আবার শুধুমাত্র রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্যে বছরে প্রায় ৪৭ লাখ টন কয়লা আমদানি করতে হবে বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ২২টি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি হয়েছে। এই অবিশ্বাস্য মাত্রার কয়লা পরিবহণের জন্যে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপুল রাষ্ট্রীয় খরচে তৈরি হচ্ছে রেলওয়ে এবং নৌ রুট । আবার নদী পথে কয়লা পরিবহণের জন্যে নদীর নাব্যতা ঠিক রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং অপরিহার্য, সেখানেও বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বছরের পর বছর এই রাষ্ট্রীয় সাহায্য ছাড়া এবং জনগণের করের টাকায় নির্মিত এইসব নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহৃত পরিবহণ অবকাঠামো ছাড়া একটি কয়লা বা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও লাভজনক উপায়ে চালু রাখা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে পরিবেশ ও জনজীবনের জন্যে মারাত্বক হুমকিস্বরূপ এই বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণে প্রতিবছর বাজেটে বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ থাকলেও দেশের গ্যাস সম্পদ অনুসন্ধানে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল এবং নীতিমালা বৈরী। তুলনামূলক ভাবে সস্তা এবং পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে কোনো উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ আমরা এখন পর্যন্ত দেখিনি। শুধু বিশ্বের উন্নত দেশগুলোই নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোও অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বাজেট বরাদ্দ এবং রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। ভারতে বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৭০ হাজার মেগাওয়াট। ২০২২ সালের সৌর, বায়ু, ও বায়োগ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের টার্গেট রাখা হয়েছে এক লক্ষ্ ৭৫ হাজার মেগাওয়াট। ভারতে বর্তমানে প্রতি ইউনিট সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ ৩ টাকা (২.৪৪ রুপি) মূল্যে উৎপাদনের রেকর্ড তৈরি হয়েছে। বাণিজ্যিক ভাবেও যা ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে।
অথচ বাংলাদেশে আমরা দেখছি উল্টো চিত্র। এই মুহূর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আমরা পাচ্ছি মাত্র ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। নিম্নমানের সৌর প্যানেল বাজারে ছড়িয়ে পড়ায় গ্রামীণ মানুষ খুব দ্রুত সৌর বিদ্যুতে আগ্রহ হারাচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইউনিটপ্রতি প্রায় ১৫ থেকে ২২ টাকায়, অর্থাৎ অত্যন্ত উচ্চমূল্যে চুক্তি করেছে সরকার।’
তিনি রামপাল প্রকল্পসহ সুন্দরবনবিনাশী সকল অপতৎপরতা বন্ধ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সকল প্রকল্পের শ্বেতপত্র প্রকাশ করে জাতীয় স্বার্থবিরোধী প্রাণ প্রকৃতি বিনাশী সকল প্রকল্প বাতিল, মন্ত্রী ও জ্বালানি উপদেষ্টাদের ভূমিকা তদন্ত করে জ্বালানি অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করা, দুর্নীতি লুটপাটের ‘দায়মুক্তি আইন’ বাতিল, ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, নেতৃবৃন্দের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন এবং সারাদেশে সুলভে সার্বক্ষণিক গ্যাস ও বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে প্রস্তাবিত খসড়া মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবার জন্য বাজেট বরাদ্দ ও সরকারি নীতিমালা পুনর্বিন্যাসের দাবি জানান।