জাতীয়

আদিবাসী ইস্যু নিয়ে মিডিয়ায় কাজ করার জন্য ১২ সাংবাদিককে সম্মাননা প্রদান

অমর শান্তি চাকমা: গত ২০ জুন, ২০১৯ ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি) র উদ্যোগে আদিবাসী ইস্যুতে বিগত আগস্ট ২০১৮- এপ্রিল ২০১৯ সময়ে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য ১২ জন সাংবাদিককে সম্মাননা প্রদান করা হয়। সেই ১২ জন সাংবাদিকদের কাজ ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিয়েই আমাদের এই আয়োজন-

১ম স্থান: নাঈমুল করিম
নাঈমুল করিম বর্তমানে থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশের সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করছেন। এর আগে তিনি দেশের ইংরেজী সংবাদপত্র দ্যা ডেইলী স্টার এ সাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করতেন। তিনি ২০১৮ সালের ১৭ আগস্ট দ্যা ডেইলী স্টার পত্রিকায় বান্দরবানের আলিকদম, লামা, থানচি থেকে ম্রো, মারমা, চাকমা এবং তঞ্চঙ্গ্যা আদিবাসীদের নিরবে নিভৃতে মায়ানমারে অভিগমন করার চিত্র তুলে ধরার জন্য এ সম্মাননা পান। তিনি তার প্রকাশিত সংবাদ “A Story Unheard” লিখেন বান্দরবানের আলিকদম থেকে ম্রো আদিবাসীরা অনিশ্চিত, অনিরাপদ জীবন থেকে উন্নততর জীবনের লক্ষ্যে নিজ বাস্তুভিটা ছেড়ে মায়ানমার পাড়ি জমাচ্ছেন।

২য় স্থান: বিশাখা দেবনাথ
নিজস্বতায় বিশ্বাসী এ সাংবাদিক বর্তমানে দেশের ইংরেজী সংবাদমাধ্যম দ্যা ডেইলী স্টার-এ কাজ করছেন। তিনি মাতৃভাষা সংরক্ষণের জন্য সংগ্রাম করে যাওয়া তিন আদিবাসী তরুণ বিভূতী চাকমা, জ্যোতি চাকমা এবং মানিক সরেনের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরার জন্য সম্মাননা অর্জন করেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০১৯ এ দ্যা ডেইলী স্টার পত্রিকায় “Battling to keep mother tongue alive: 3 Adivasi youths work online to preserve Chakma, Santal languages” শিরোনামে একটি রিপোর্টে অনলাইনে চাকমা এবং সান্তাল ভাষা সংরক্ষণের লক্ষ্যে তিন আদিবাসী তরুণের নিরলস প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন।

৩য় স্থান: ছাইফুল ইসলাম মাছুম
নোয়াখালী জেলার প্রত্যন্ত হাতিয় দ্বীপের ছেলে ছাইফুল ইসলাম মাছুম। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েল সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি দৈনিক খোলা কাগজ পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবেও কাজ করছেন। এ বছরের ২১ মার্চে দৈনিক খোলা কাগজ পত্রিকায় “কড়া” আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের ভূমির উপড় ভূমিদস্যুদের ক্রমাগত বেদখলের চিত্র তুলে ধরার জন্য এ সম্মাননা অর্জন করেন।
তিনি তার “কড়ার ধনও চুরি করছে রাজারা” শিরোনামে করা রিপোর্টে লেখেন, দিনাজপুরের বিরলে তিনটি গ্রামে কড়াদের বসবাস। জনসংখ্যা ৭০ জনের কাছাকাছি। এক সময় ক্ষুদ্র এ নৃ-গোষ্ঠীর মালিকানায় ৫২ একর জমি থাকলেও ভূমিদস্যুদের ক্রমাগত দখলে এর পরিমাণ কমতে কমতে ৫ একরে এসে ঠেকেছে। সামান্য এ জমিতেই চাষাবাদ করে বেচেবর্তে আছেন তারা।

বিশেষ সম্মাননা

সঞ্জয় কুমার বড়ুয়া
১২ বছর ধরে দ্যা ডেইলী স্টার পত্রিকায় সাংবাদিকতা করে আসা এ সাংবাদিক ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় পিছিয়ে পরা আদিবাসী ছাত্রীদের জন্য মংহ্লা মারমা এবং তার স্ত্রী মাহ্লা মিনের অবদানের কথা তুলে ধরার জন্য এ সম্মাননা পান।

তিনি ‘‘Torchbearers in remote hills: Couple give shelter, education to unprivileged indigenous girls” শিরোনামে লেখা রিপোর্টে সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক আদিবাসী মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য মংহ্লা মারমা এবং তার স্ত্রী মাহ্লা মিনের পরিচালনায় অনাথ আশ্রমের কথা তুলে ধরেন।

মেহেদী হাসান
প্রথম আলো পত্রিকায় কাজ করা এই সাংবাদিক বান্দরবানের থানচি উপজেলার বলিপাড়া ইউনিয়নে নিশৈমং মারমার গড়ে তোলা পাঠাগার নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য এ সম্মাননা পান। তিনি বলেন, সংবাদপত্রে ফিচার বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকর সুবাদেই মানুষের গল্প বলা শুরু। খুব বেশিদিন হয়নি, তবু এ কাজটিই আমি সবচেয়ে ভালোবাসি। আমার কিংবা আমাদের কাজ হলো মানুষের গল্প তুলে ধরা।

তিনি ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকার ফিচার বিভাগে বান্দরবানের থানচি উপজেলার বলিপাড়া ইউনিয়নের ছেলে নিশৈমং মারমার করুণা শিশু সদনে নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলা “জ্ঞানশ্রী মহাথেরো পাঠাগার” নিয়ে অন্ধকার পাহাড়ে নিশৈমংয়ের আলো শিরোনামে এক ফিচার লেখেন।

হালিম আল রাজি
দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর এলাকার মো. হালিম আল রাজী একাধারে বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা ট্রিবিউন, বণিক বার্তা ও মাছরাঙা টেলিভিশনে হিলি প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন। ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী ঢাকা ট্রিবিউনে “Flatland small ethnic groups losing language, culture due to lack of textbook” শিরোনামে লেখা রিপোর্টটির জন্য এ সম্মাননা পান।
তিনি তার এ প্রতিবেদনে লেখেন, দিনাজপুরের চারটি উপজেলা হাকিমপুর, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ ও ঘোড়াঘাটে বসবাস করা এক লক্ষাধিক আদিবাসী ধীরে ধীরে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি হারিয়ে পরিচয় সংকটে আছে । প্রাইমারী স্কুলে যাওয়া আদিবাসী শিক্ষার্থীরাও নিজস্ব ভাষায় পড়ালেখা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সাইদ শাহীন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স শেষ করার পর তিনি বণিক বার্তা সংবাদপত্রে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে তিনি এ পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছেন। এছাড়াও তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ এগ্রিকালচারিষ্টস ফোরাম (ইঅঔচ) তে সাধারণ সম্পাদক এবং দ্যা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব এগ্রিকালচারাল জার্নালিস্ট-এ সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
২০১৯ সালের ৮ মার্চ বণিকবার্তায় লেখা “সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের ৮০ শতাংশই দরিদ্র: নারীরাই বেশী ভঙ্গুর” শিরোনামে লেখা প্রতিবেদনটির জন্য এ সম্মাননা পান।

মোস্তফা সবুজ
সার্ক ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করে মোস্তফা সবুজ বগুড়া জেলার দ্যা ডেইলী স্টার পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি দেশে ও আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনে কবিতা, কলাম, মতামত প্রভৃতি লেখালেখি করেন।
২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্চের বাগদাফার্ম থেকে উচ্ছেদ হওয়া সান্তাল আদিবাসীদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে লেখা “Trapped in uncertaintity” শিরোনামের প্রতিবেদনটির জন্য এ সম্মাননা অর্জন করেন।

মো: সাইফুল ইসলাম
মো: সাইফুল ইসলাম ঢাকা ট্রিবিউনে সাংবাদিকতার পাশাপাশি একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবেও কাজ করেন। তিনি সাংবাদিকতাকে সমাজের রুঢ় সত্য তুলে ধরার মাধ্যমে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যম মনে করেন। ২০১৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী ঢাকা ট্রিবিউনে “Indigenous languages on brink of extinction in Sylhet” শিরোনামে লেখা প্রতিবেদনটির জন্য এ সম্মাননা অর্জন করেন। তিনি এ প্রতিবেদনে সিলেটের মৌলভীবাজার উপজেলার খাসিয়া পুঞ্জিতে খাসি আদিবাসীদের ধীরে ধীরে ভাষা হারিয়ে ফেলার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

শাকিল মুরাদ
শাকিল মুরাদ ২০১২ সালে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজকের বাংলাদেশ পত্রিকায় জেলা প্রতিনিধি, পরে ২০১৭ সালে কালেরকন্ঠ উপজেলা প্রতিনিধি, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে উপজেলা প্রতিনিধি ও ২০১৮ সালেই দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি এবং একই সালে বাংলা টিভিতে জেলা প্রতিনিধি থাকার পর ২০১৯ সালে একাত্তর টেলিভিশনে শেরপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে একাত্তর টেলিভিশনের শেরপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি ২০১৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী আদিবাসী ভাষা নিয়ে একাত্তর টেলিভিশনে একটি প্রতিবেদনের জন্য এ সম্মাননাটি অর্জন করেন।

মো: মালেক মিঠু
মো: মালেক মিঠু বর্তমানে সংবাদ ভিত্তিক বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসি নিউজ ও জনপ্রিয় ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি অবজারভারের বরগুনা জেলা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের বরগুনা.কম এর নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও বরগুনার বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত। মোঃ মালেক মিঠু ১৯৯৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বরগুনা জেলা শহরের থানা পাড়া এলাকায় জন্মগ্রহণ করণে। বাবা মোঃ মোস্তফা কামাল একজন ব্যাবসায়ী। মা মোসাঃ কহিনুর বেগম গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি ২য়। ২০০৮ সালে বরগুনা জিলা স্কুল থেকে এসএসসি ও ২০১৮ সালে বরগুনা সরকারি কলেজ থেকে এমবিএ পাশ করেন। বর্তমানে এলএলবি ১ম বর্ষে আধ্যয়নরত।
২০১৮ সালের ৯ আগস্ট পটুয়াখালী, বরগুনার রাখাইন জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প নিয়ে ডিবিসি নিউজে করা অস্তিত্ব হারাচ্ছে রাখাইনদের তাঁতশিল্প নামের প্রতিবেদনের জন্য এ সম্মাননা লাভ করেন।

উড়ালমনি চাকমা
পুরো নাম উড়ালমনি চাকমা। ডাক নাম হিমেল। মিডিয়াতে হিমেল চাকমা হিসেবে পরিচিত। ১৯৮৬ সালে ২১ নভেম্বর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মহালছড়ি উপজেলার কায়াংঘাট ইউনিয়নে পূর্ব মানিকছড়ি গ্রামে জন্ম। ২০০৩ সালে মাইসছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে এসএসসি, ২০০৫-এ খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজ থেকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে এইচএসসি, ২০১১সালে রাঙামাটি সরকারী কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স ও ২০১২ সালে চট্টগ্রাম হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি করতেন। তিনি বলেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার কথা, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত ভেদাভেদ ও বৈষম্য দূর করতে লেখালেখির প্রতি ঝুঁকে পড়ি।
২০১০ সালে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের মাধ্যমে জাতীয়ভাবে তার সাংবাদিকতা শুরু। পরে দৈনিক সকালের খবর, মানবকন্ঠে কাজ করেন। ২০১১ সাল থেকে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে রাঙামাটি প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। বর্তমানে রাঙামাটি শহরের লুম্বিনীতে স্ত্রী ও এক পুত্র নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
২০১৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী রাঙ্গামাটির বালুখালী ইউনিয়নে অবস্থিত ৩০০ বছরের পুরনো বসন্ত পাংখুয়া পাড়ার অবহেলিত, পিছিয়ে পরা পাংখুয়া আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিয়ে প্রতিবেদনের জন্য এ সম্মাননা অর্জন করেন।

Back to top button