মতামত ও বিশ্লেষণ

আদিবাসীদের রাজপথের নেতা রবীন্দ্রনাথ সরেন- তরুণ মুন্ডা

৯০’র দশক কিংবা তারও আগে উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের জীবন ছিল অত্যাচার নিপীড়নের। আদিবাসীরা হয় সেসব নিশ্চুপে সহ্য করত না হয় পাশের দেশ ভারতে চলে যেত। সে সময় আদিবাসীদের ভূমি, সহায়-সম্পদ দখল করা যেন কোন ব্যাপারই ছিল না। ন্যায় বিচার আদিবাসীদের জন্য অধরা ছিল।
আদিবাসীদের উপর এমনভাবে অত্যাচার করা হত যে তাদেরকে বাধ্য হয়ে দেশ ত্যাগ করতে হত। অনেককে বলতে শুনেছি, প্রভাবশালী বাঙালি প্রতিবেশিরা ইচ্ছে হলেই আদিবাসীদের ফসলি জমি থেকে পাকা ধান কেটে নিয়ে গেছে। মাঠ থেকে গরু ছাগল জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। হাঁস-মুরগী নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেতে ভালো সবজী হয়েছে, সেসব নিয়ে গেছে। আদিবাসী গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে হুঙ্কার দিতে দিতে চলে গেছে। আদিবাসীদের চোখের সামনে এ ধরনের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। কিছুই করতে পারতো না আদিবাসীরা। প্রতিবাদ করলেই তাদের উপর সহিংস হামলা হত। পুলিশের কাছে বিচার চাইতে গেলে তারা আদিবাসীদেরকেই শাসাতো, জনপ্রতিনিধিরা নির্বিকার থাকতো। এলাকার জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রশাসন, আমলা সবাই তাদের পক্ষে। টিকে থাকতে হলে অত্যাচার নিপীড়ন সয্য কর না হয় দেশ থেকে চলে যাও এমন অবস্থা ছিল আদিবাসীদের। অসহায়ের মত বেচে থাকতে হয়েছে আদিবাসীদের।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সদ্য প্রয়াত সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন তখন যুবক। উত্তরবঙ্গের আদিবাসী অধ্যুষিত প্রায় প্রতিটি এলাকায় তার যাওয়া আসা ছিল। আদিবাসীদের যে গ্রামে গেছেন সেখানেই দেখেছেন আদিবাসীদের অসহায় মানবেতর জীবন। প্রতিদিন আদিবাসীরা অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। জমি হারাচ্ছে, ঘর-বাড়ি, ভিটা-মাটি হারাচ্ছে। আদিবাসীদের দলে দলে দেশ ত্যাগ করতে দেখেছেন। আর বৈষম্য তো আছেই। আদিবাসীদের এরকম অবস্থা দেখে তিনি সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। পরিত্রানের উপায় খুজেছেন। কিন্তু আদিবাসীদের ঘুরে দাড়ানো ব্যতিত কোন সমাধান খুজে পান নি। তাই যে গ্রামে যেতেন আদিবাসীদের সাহস দিতেন, রুখে দাড়াতে বলতেন। তিনি আদিবাসীদের সংঘবদ্ধ রুখে দাড়ানোর তাগিদ অনুভব করলেও পরিস্থিতি সহায়ক ছিল না।

ইতোমধ্যে ১৯৯৩ সালের দিকে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বাবুল ডাইং গ্রামে কয়েকটি আদিবাসী পরিবার উচ্ছেদের ঘটনা এই অঞ্চলের আদিবাসীদেরকে ঐক্যবদ্ধ এবং সংগঠিত করে। বাবুল ডাইংসহ আশপাশের এলাকার আদিবাসীরা এই ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসে। আদিবাসীরা তাদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করে। অন্যদিকে জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালকে আদিবাসী বর্ষ ঘোষনা করে। কিন্তু তৎকালীন সরকার বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই বলে রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসী বর্ষ পালন করতে অস্বীকার করে। ফলে আদিবাসীদের আন্দোলন সংগ্রামকে বৃহত্তর করা ও সাংগঠনিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা প্রকট হতে থাকে। এই তাগিদ থেকে বাবুল ডাইং’র পাশের গ্রাম সুন্দরপুরে ঐ বছরের ৩রা সেপ্টেম্বর রাজশাহীর আদিবাসী নেতা অনিল মারান্ডী এবং নাটোরের সুরেন্দ্রনাথ সরদারের (উরাও) নেতৃত্বে সমতল আদিবাসীদের প্রথম বৃহৎ গণসংগঠন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ প্রতিষ্ঠা পায়। সে সময় রবীন্দ্রনাথ সরেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের শুভাকাঙ্খী হিসেবে যুক্তি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করতেন। এমন কি জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ৯দফা দাবি প্রণয়নেও তিনি সহযোগীতা করেছিলেন।

লেখক তরুণ মুন্ডা
রবীন্দ্রনাথ সরেন সব সময় চাইতেন এরকম একটি প্রতিবাদী সংগঠন যার পতাকাতলে উত্তরবঙ্গসহ সমতলের আদিবাসীরা তাদের মুক্তির কথা বলতে পারবে। তাদের উপর নির্বিচারে সংঘটিত অত্যাচার নির্যাতন, শোষন নিপীড়নের প্রতিবাদ এবং বিচার চাইতে পারবেন। আদিবাসীরা তাদের অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগ্রাম করতে পারবে। তাদের দু:খ কষ্টের কথা দেশের জনগন, সরকার ও রাষ্ট্রকে জানাতে পারবে। বিধায় রবীন্দ্রনাথ সরেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদকে আকুন্ঠ সমর্থন দিতে থাকেন এবং জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সকল কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করতে থাকেন।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৯৩ সালের ৩রা সেপ্টেম্বরে এবং তার পরের মাস অক্টেবরেই রাজশাহী ডিসি অফিস ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষনা করা হয়। ২৬ অক্টোবর রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, পবা, মোহনপুর, দুর্গাপুর; নাটোরের পুঠিয়া এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাজার হাজার আদিবাসী মানুষ ঢাক-ঢোল, তীর-ধনুক নিয়ে রাজশাহী মহানগরের কোর্টস্টেশন এবং গৌরহাঙ্গা রেলগেটে জড়ো হতে থাকেন। বেলা ১২টার দিকে রেলগেট থেকে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক বর্ণাঢ্যে রাজশাহী ডিসি অফিস অভিমুখে পদযাত্রা শুরু হয় এবং ডিসি অফিস ঘেরাও করা হয়। সেখানেই জাতীয় আদিবাসী পরিষদ প্রথম তার ৯দফা দাবি পেশ করে। ৩০ অক্টোবর তৎকালীন সাপ্তাহিক পত্রিকা গণ খবর এই সংবাদ প্রকাশ করে। গণখবরের মতে, এই ডিসি অফিস ঘেরাও স্মরণকালের বড় আদিবাসী সমাবেশ। রাজশাহীবাসী এতো বড় আদিবাসী সমাবেশ আগে কখনো দেখে নি। এই কর্মসূচিতেও রবীন্দ্রনাথ সরেনের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা দেখা যায়। সাপ্তাহিক গণ খবরে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি অনিল মারান্ডীর পরেই রবীন্দ্রনাথ সরেনকে শীর্ষ আদিবাসী নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় সকল আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় রবীন্দ্রনাথ সরেনের পদ চারনা থাকায় তিনি জাতীয় আদিবাসী পরিষদের আন্দোলন সংগ্রামকে সফল করতে সেসব এলাকার আদিবাসী জনগনকে সংগঠিত করেছিলেন। ধীরে ধীরে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের আন্দোলন বৃহত্তকারে রুপ নিতে থাকে। আন্দোলনে দলে দলে যুক্ত হতে থাকেন আদিবাসীরা। পুরো রাজশাহী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের লড়াই সংগ্রাম। রাজশাহী শহর কেন্দ্রীক হতে থাকে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের আন্দোলন এবং কার্যক্রম। অনুরুপভাবে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতৃত্বে রবীন্দ্রনাথ সরেনের সক্রিয় ভূমিকাও স্পষ্ট হতে থাকে।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নওগাঁ জেলার পোরসা উপজেলার তৎকালিন সভাপতি মহিন্দ্র পাহান বলেন, রবীন্দ্রনাথ সরেন যখন গ্রামে আসতেন তখন সাধারণ আদিবাসীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ত তার বক্তব্য শোনার জন্য। তখনকার আদিবাসীরা তাদের অত্যাচার নির্যাতনের প্রথম প্রতিবাদ শুনতে পান রবীন্দ্রনাথ সরেনের ঝাঁঝালো বক্তব্যে। তার বক্তব্য শুনে আম জনতা আদিবাসী প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। আন্দোলন সংগ্রামের কথা শুনলেই আদিবাসীরা ঝাপিয়ে পড়তো। কারন এর আগে অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের প্রতিবাদ প্রতিরোধ করার জন্য কেউ এভাবে উৎসাহ এবং সাহস দেয় নি।

আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ সরেনের স্পৃহা এবং সক্রিয়তা আরও স্পষ্ট হয় ১৯৪৬’র বিখ্যাত কৃষক বিদ্রোহ তেভাগা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯৬ সালের ৬ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাঁচোল কলেজ মাঠের বিশাল আদিবাসী-বাঙালি সমাবেশ আয়োজনে। তৎকালীন অন্যতম স্বনামধন্য জাতীয় পত্রিকা আজকের কাগজ’র মতে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজারের মত আদিবাসী বাঙালির জমায়েত হয়েছিল নাঁচোলের সমাবেশে। এই সমাবেশে নেতৃত্ব দেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অনিল মারান্ডি ও তেজোদীপ্ত আদিবাসী নেতা রবীন্দ্রনাথ সরেন। রবীন্দ্রনাথ সরেনের ঘনিষ্ট সহযোদ্ধা নওগাঁ বাসদের সমন্বয়ক জয়নাল আবেদীন মুকুল বলেন, “শুধু নওগাঁ থেকে ৯৬টি বাসে চড়ে আদিবাসীরা গিয়েছিলেন নাচোল সমাবেশে যোগ দিতে। নাচোলের তেভাগা আন্দোলন যার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল সেই মহিয়সী নেত্রী ইলা মিত্রকে সমাবেশের প্রধান অতিথি হিসেবে এবং ভারতের বিশিষ্ট লেখক মহাশ্বেতা দেবীকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে নিয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথ সরেন”। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের অন্যন্য নেতৃবর্গের মত তিনিও রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁসহ অন্যান্য এলাকার আদিবাসীদের জমায়েত সফল করতে ভূয়সী ভূমিকা রাখেন। রবীন্দ্রনাথ সরেনের নেতৃত্বে এই সমাবেশে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের মুখপাত্র মাসিক পত্রিকা উলগুলান প্রথম ছাপা ও প্রচার করা হয়।

এভাবে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের শীর্ষ নেতৃত্বের শক্ত দাবিদার হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ সরেন। ১৯৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথ সরেনকে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। তারপর থেকে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের আন্দোলনের পরিসর রাজশাহী, নাটোর থেকে পুরো উত্তরবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তার নেতৃত্বে দীর্ঘ গণপদযাত্রা, বিভিন্ন সরকারি অফিস ঘেরাও এর মত বৃহৎ কর্মসূচিগুলো উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠিত হতে থাকে। তার মধ্যে ১৯৯৮ সালে ঢাকার সহরাওয়ার্দী উদ্দ্যান চত্তরে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ প্রায় ১০ হাজার আদিবাসীদের নিয়ে সমাবেশ করে। রাজশাহী নওগাঁ এলাকা থেকে ৫০টির অধিক বাসে আদিবাসীরা ঢাকায় গিয়ে জমায়েত করে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গনেশ মার্ডি বলেন, “আমি তখন নওগাঁর পত্নিতলার মধুইল এলাকায় ছিলাম সমাবেশের গণসংযোগে। ২০০ টাকা করে চাঁদা দাবি করা হলে অনেকেই দিতে চায় নি। কিন্তু যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে গাড়ি যাত্রা করবে তখন এতো মানুষ এসে জড় হল যে বাসে জায়গা দিতে পারি না। বহু মানুষ ২শ টাকা চাঁদাও দিয়েছে আবার বাসে গাদা গাদি করে দাড়িয়ে দাড়িয়ে গেছে ঢাকায়। আমাকেও দাড়িয়ে যেতে হয়েছে, বসার সিট পায় নি।”

এছাড়া নওগাঁর মহাদেবপুরের ভীমপুরে ২০০০ সালে ১৮ আগষ্টের আলোচিত আলফ্রেড সরেন হত্যাকান্ডের বিচারের দাবিতে রবীন্দ্রনাথ সরেনের নেতৃত্বে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ অভূতপুর্ব গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। মহাদেবপুরসহ নওগাঁর হাজার হাজার আদিবাসী সেই আন্দোলনে সামিল হয় এবং লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকে। ২০১০ সালে রাজশাহীর জিরোপয়েন্টে মানবাধিকার সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং ১০ হাজার আদিবাসীদের জমায়েতে রাজশাহী জিরোপয়েন্ট অবরোধ করে দেওয়া হয়। বৃহত্তর কর্মসূচির সিদ্ধান্ত গ্রহন, বাস্তবায়ন এবং জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ক্রমাগত সম্প্রসারন বরীন্দ্রনাথ সরেনকে শীর্ষ পরীক্ষিত নেতৃত্বে নিয়ে আসে।

ফলে ২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথ সরেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। প্রেসিডিয়াম সদস্য ক্রিষ্টিনা বিশ্বাস বলেন, “সম্মেলনে হল ভর্তি সবাই হাত উচু করে রবীন্দ্রনাথ সরেনকে সমর্থন করেন এবং সভাপতি নির্বাচিত করেন”। ঐ বছরে নওগাঁর পোরশা উপজেলার ছাওর ইউনিয়নের খাতিরপুর সোনডাঙ্গা গ্রামে নব নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান মনজুরুল হাসানের নেতৃত্বে প্রায় ৭২টি আদিবাসী পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। প্রতিবাদে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ লাগাতার আন্দোলন গড়ে তোলে। তার মধ্যে পোরশার সারাইগাছি মোড় থেকে প্রায় ৫০ কিমি দুরের নওগাঁ জেলা অভিমুখে দীর্ঘ গণপদযাত্রার সবচেয়ে বৃহৎ আন্দোলন। হাজার হাজার আদিবাসী নারী পুরুষ সেই পদযাত্রায় অংশগ্রহন করে। মহাদেবপুর পর্যন্ত এসে প্রথম দিনের পদযাত্রা সমাপ্ত হয় এবং মহাদেবপুর উপজেলা হলরুমে সবাই রাত্রি যাপন করে। সেখানে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঐতিহ্যবাহী নাচ, গান এবং মঞ্চনাটক প্রদর্শন করা হয়। সেখানেই জাতীয় আদিবাসী পরিষদের আলোচিত নারী নেত্রী বিচিত্রা তির্কি নিজের দুধের বাচ্চাকে পিঠে বেঁধে দীর্ঘ পদযাত্রা করে সবার নজরে আসেন। পুরো নওগাঁ জুড়ে আদিবাসীরা দীর্ঘদিনের অত্যাচার নির্যাতনের বিরদ্ধে গনপ্রতিরোধ গড়ে তোলে।

এভাবে রবীন্দ্রনাথ সরেন আদিবাসীদের গণআন্দোলন সংগ্রাম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন উত্তরবঙ্গ জুড়ে। মাসের প্রায় দিনে উত্তরবঙ্গের কোন না কোন জেলা উপজেলায় আদিবাসীদের উপর নির্যাতন নিপীড়নের প্রতিবাদে এবং নায্য বিচারের দাবিতে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের প্রতিবাদী কর্মসূচি যেমন: সমাবেশ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান, বিক্ষোভ মিছিল সংঘটিত হয়েছে। বৃহৎ কর্মসূচির মধ্যে ২০১৪ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে তৎকালীন ইউপি সদস্য আলোচিত বিচিত্রা তির্কির উপর হামলা এবং তার জমি দখলের প্রতিবাদে গণপদযাত্রা এবং ভূমি উদ্ধার, ২০১৫ সালে সমতল আদিবাসীদের জন্য স্বাধীন ও পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবিতে নাচোল থেকে রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয় অভিমুখে গণপদযাত্রা। দেশ-বিদেশে আলোচিত গাইবন্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্মে রংপুর চিনি কলের নামে আদিবাসী বাঙালিদের বাপ-দাদার ১৮৪২.৩০ একর জমি ফেরতের দাবিতে গাইবান্ধায় ২০১৫’র জনসভা, ২০১৬সালের ২৩শে জানুয়ারি ঢাকার মানববন্ধন, ১০ এপ্রিলে গাইবান্ধার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখে গণপদযাত্রা ও সমাবেশ, ৩০শে জুন সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসে বিশাল কৃষক-ক্ষেতমজুর-আদিবাসী বাঙালি সমাবেশসহ ৬ নভেম্বরে সাঁওতাল পল্লিতে হামলা, তিন সাঁওতাল হত্যা, বহু বাড়িঘর অগ্নিসংযোগ এবং উচ্ছেদের বিচার ও ক্ষতিপুরনের দাবিতে লাগাতার গণআন্দোলন গড়ে তুলতে প্রত্যাক্ষভাবে সেখানকার আদিবাসী বাঙালিদের সংগঠিত ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০২২ সালে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ধুমঘাটের নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা হত্যার বিচারের দাবিতে শ্যামনগর উপজেলা চত্তরে বিশাল মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথ সরেনের নির্দেশনায়। ২০২৩ সালের ৯ জুলাই’র নওগাঁর চৌমাসিয়া নওহাটা মোড় এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের চৌরাস্তা মোড়ের সড়ক অবরোধ, ৩রা সেপ্টেম্বর ঢাকার শাহবাগ চত্তরে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ৩দশক উদযাপনও তার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। এর বাইরেও আদিবাসীদের উপরে সংগঠিত বহু অত্যাচার নিপীড়নের প্রতিবাদে এবং বিচারের দাবিতে গনতান্ত্রিক কর্মসূচি গ্রহনে ও বাস্তবায়নে বিভিন্ন জেলা, উপজেলার আদিবাসী নেতৃবৃন্দদের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। উত্তরবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আদিবাসীদের প্রতিবাদী ভাবমূর্তি। আদিবাসী ছাত্র যুবদেরও সংগঠিত করার জন্য আদিবাসী ছাত্র পরিষদ ও যুব পরিষদ গঠন করেন। ছাত্র-যুবদের মাঝেও গড়ে ওঠে সংগ্রামী ও লড়াকু চেতনা।

তিনি শুধু আদিবাসীদের অত্যাচার নির্যাতন, ভূমি দখল, খুন-ধর্ষনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করেন নি। তিনি আদিবাসীদের সংস্কৃতি রক্ষা ও পালনেও আদিবাসীদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। নওগাঁর নিয়ামতপুরের আঘোরে তিনিই প্রথম ৩০ জুন সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস ও বিরসা মুন্ডা শহীদ দিবস যৌথভাবে পালন করেছিলেন। বহু আদিবাসী নারী পুরুষ সেই সমাবেশে চাউল ডাউল নিয়ে আসেন এমনকি রান্না করার খড়িও নিয়ে আসেন। দৈনিক প্রথম আলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন দিলু বলেন, “নাচোল থেকে আমি ১২ মাইল কাঁচা-কাদা পথ হেটে আঘোরের সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করি। তখন আমি ভোরের কাগজে কাজ করি। তার অনেক পরে প্রথম আলো প্রতিষ্ঠা হয়”। তিনি আরও বলেন, “জাতীয় আদিবাসী পরিষদই প্রথম এদেশের আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি তোলে”। আবার ১৯৯৫ সালে প্রথম নওগাঁর মহাদেবপুরের নাটশাল মাঠে স্বাড়ম্বড়ে ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব পালন করেন। প্রতিবছর মহাদেবপুরসহ নওগাঁর অন্যান্য এলাকা থেকে বহু কারাম নাচের দল এবং হাজার হাজার মানুষ এসে জড়ো হয় এই উৎসবকে উপভোগ করার জন্য। প্রতিবছর জাতীয় আদিবাসী পরিষদের বিভিন্ন জেলা উপজেলা কমিটি সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস, বিরসা মুন্ডা শহীদ দিবস ও কারাম উৎসব পালন করে থাকে। রবীন্দ্রনাথ সরেন সাঁওতালদের ফুল বাহা উৎসবকেও ২০১৭ সাল থেকে জাকজমকভাবে উৎযাপন শুরু করেন দিনাজপুরের পার্বতীপুরে নিজ গ্রাম বারকোনায়। দিনাজপুরে এই বাহা উৎসব ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এভাবে তিনি আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক বিপ্লবও গড়ে তোলেন এবং উত্তরবঙ্গ জুড়ে স্থানীয় বাঙালীরা সাঁওতাল, উরাও, মুন্ডা, মাহাতো, মাহালী, তেলীদের আদিবাসী হিসেবে ডাকতে শুরু করে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের প্রবীন নেতা মহিন্দ্র পাহান বলেন, “একটা সময় ছিল যখন বাঙালিরা আমাদের সাতাল, ধাঙর বলে গালি দিত এবং বৈষম্য করতো। এখন বাঙালিরা আমাদের গ্রামকে আদিবাসী গ্রাম বলে।”

তিনি তার আন্দোলন সংগ্রাম শুধু উত্তরবঙ্গে সীমিত রাখেন নি। দেশের সকল প্রান্তের আদিবাসীদের উপরে অত্যাচার, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। পাবর্ত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন, টাঙ্গাইলের ছলেশ রিছিলের মধুপুর শালবনের আন্দোলন, পাহাড়ের কল্পনা চাকমার অপহরণ, কক্সবাজারের রামু, উখিয়া পুঠিয়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার, লংগদু হামলাসহ দেশের আদিবাসীদের নায্য অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠার সকল আন্দোলনকে রাজপথে থেকে তিনি সমর্থন দিয়েছেন, সংহতি জানিয়েছেন। ঢাকাসহ সারা দেশে তিনি আদিবাসীদের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন। তিনি আদিবাসীদের জীবন, ভূমি, অধিকার ও দাবির প্রশ্নে কখনো আপোস করেন নি। সকল পরিস্থিতিতে রাজপথে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ সরেন জীবদ্দশায় বার কয়েক শারীরিক জটিলতায় পড়েছেন, অসুস্থ হয়েছেন এবং প্রতিবার সেরেও উঠেছিলেন। এবারও শারীরিকভাবে ঘুরে দাড়িয়েছিলেন কিন্তু গত ১৩ জানুয়ারি হেরে গেছেন মৃত্যুর কাছে। তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু এদেশের আদিবাসীদের বেঁচে থাকার, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই সংগ্রামের বিশাল উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। তার আদর্শে এদেশের আদিবাসীদের আন্দোলন সংগ্রাম চলবেই অবিরাম।

লেখক,
তরুন মুন্ডা
সাবেক সাধারণ সম্পাদক
আদিবাসী ছাত্র পরিষদ
কেন্দ্রীয় কমিটি

Back to top button