বান্দরবানের লামায় আদিবাসী কিশোরী ধর্ষণের প্রতিবাদে রাজধানীতে মানববন্ধন
![](https://ipnewsbd.net/wp-content/uploads/2020/02/tt-1.png)
সতেজ চাকমা: গত ৩১ জানুয়ারী ২০২০ বান্দরবানের লামা উপজেলা সংলগ্ন কক্সবাজারের চকরিয়ার হেব্রম মিশনারী চত্বরে নবম শ্রেণীর এক শিক্ষাথী ধর্ষণের ঘটনা সহ সারাদেশে আদিবাসী নারীদের উপর সংঘটিত সহিংসতার প্রতিবাদে এবং দোষীদের শাস্তির দাবীতে রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ জআদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও নারী প্রগতি সংঘের যৌথ আয়োজনে এই মানববন্ধন করা হয়।আজ(৭ ফেব্রুয়ারী) সকাল ১০.৩০ ঘটিকায় অনুষ্ঠিত উক্ত আয়োজনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শহনাজ সুমী।
তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে আদিবাসী নারীসহ নারীর উপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধান এবং পার্বত্য অধিবাসীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পরও চুক্তিটি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার ফলে বিশেষত সেটেলার বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বহু জুম্ম নারী যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ ব্যক্ত করেন তিনি।
সংহতি জানিয়ে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সম্পাদক রেহেনা ইউনুস। তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেন, আমরা আমাদের কন্যা সন্তানদের কীভাবে নিরাপদে রাখবো সেটা নিয়ে এখন খুব উদ্ধেগের সাথে সময় কাটায়। সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও সেটার প্রতিফলন বাস্তব ক্ষেত্রে নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ক্ষোভ জানিয়ে এ নারী নেত্রী আরো বলেন, আমরা নারী সমাজের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত দাবী করছি। কিন্তু সে দাবীগুলো কোথায় যাচ্ছে। সরকার ধর্ষককে খুঁজে বের করতে পারছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. ঈষাণী চক্রবর্তী সংহতি বক্তব্যে বলেন, ধর্ষণ এবং দুর্নীতি এখন সমাজে মহামারী আকার ধারণ করেছে। এই মহামারীকে দূরীভূত করতে হলে দরকার দুষ্টান্তমূলক শাস্তির। তা না হলে সেটা চলতেই থাকবে বলেও উদ্ধেগ প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, অনেক মানবাধিকার কর্মীরা একমত না হলেও আমি মনে করি ধর্ষণের শাস্তি সর্বোচ্চ (মৃত্যুদন্ড) হওয়া উচিত। কেননা, মানবতা ও মানবাধিকার তাঁর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যিনি মানবিক আচরণ করেন। কিন্তু ধর্ষকদের পাশবিকতা মানবিক আচরণ হতে পারে না।মুজিব বর্ষের মত নারী নিপীড়ন বিরোধী বর্ষও ঘোষণার দাবী করেন ঢাবির এই অধ্যাপক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস সংহতি বক্তব্যে বলেন, পাকিস্তান শাসনের সময় পাকিস্তানিরা যে কায়দায় বাঙালিদের শাসন করেছিল বাংলাদেশের শাসকরাও একই কায়দায় পাহাড়ে শাসন করছে। ভাষাগত,সামরিকসহ নানা নিপীড়নের শিকারে পাহাড়ের আদিবাসীরা ক্রমশ প্রান্তিক থেকে প্রান্তিক হচ্ছে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই অধ্যাপক।
তিনি আরো বলেন, পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালে যৌনতার জন্য বাঙালি মেয়েদেরকে ধর্ষণ করেনি। তারা ধর্ষণ করেছিল যুদ্ধের কৌশল হিসেবে। ধর্ষণের মাধ্যমে পুরো জাতিকে ‘ডিমোরালাইজড’ (মনোবল ভাঙার চেষ্টা) করার চেষ্টা করেছিল। পাহাড়েও একই কারণে আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট এই শিক্ষক।
এছাড়া তিনি লামায় সংঘটিত আদিবাসী নারী ধর্ষণের ঘটনার দায় পার্বত্য মন্ত্রীকে নিতে হবে বলেও দাবী করেন কেননা, লামায় সংঘটিত এ ঘটনাটি বান্দরবানের সাংসদ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুরের অংশগ্রহনকৃত একটি অনুষ্ঠানের পাশে এটি ঘটেছিল এবং অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনকরাী কৃর্তক এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এছাড়াও মানবন্ধনে উপস্থিত থেকে আরো বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের প্রজেক্ট ম্যানেজার নাজনীন পাপ্পু, কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর খোকন সুইটেন মুর্মু,মানবাধিকার কর্মী মাহবুব আলম, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের মনিরা ত্রিপুরা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারন সম্পাদক অলীক মৃ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি নিপণ ত্রিপুরা, বাগাছাস ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক ডন জেত্রা, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি অন্তর ত্রিপুরা প্রমূখ।
আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমার পরিচালনায় উক্ত মানবন্ধনের সভাপতি এবং বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক ফাল্গুনী ত্রিপুরার সমাপনি বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এ মানববন্ধন সমাপ্ত হয়। তাঁর সমাপনি বক্তব্যে তিনি নিম্নোক্ত পাঁচ দফা দাবী নামা তুলে ধরেন-
১। বান্দরবানের লামায় আদিবাসী কিশোরী ধর্ষণসহ সারাদেশে আদিবাসী নারীদের উপর সহিংসতার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে;
২। ঘটনার শিকার পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণসহ নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে;
৩। আদিবাসী নারীসহ নারীর প্রতি সকল ধরনের নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে;
৪। পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের অধীনে পার্বত্য নারীদের সকল ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে একটি বিশেষ সেল গঠন করতে হবে এবং
৫। অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূণার্ঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।