জাতীয়

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভাঃ আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি নেই (শেষ পর্ব)

বিশেষ প্রতিবেদনঃ
২.

এরপর পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন সংক্রান্ত ক্রমিক নং ৮(খ) এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি জানান যে, ১৫/৬/২০১৯ তারিখে অগ্রগতি প্রতিবেদন কমিটির আহ্বায়কের নিকট পেশ করা হয়েছে।

তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও আ লিক পরিষদ আইনের সাথে The Chittgong Hill Tracts Regulation 1900-এর অসামঞ্জস্যসমূহ দূরীকরণ সংক্রান্ত ক্রমিক নং ৮(গ) এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি সম্পর্কে ভারপ্রাপ্ত সচিব জানান যে,The Chittgong Hill Tracts Regulation 1900 সম্পর্কে আঞ্চলিক পরিষদ ২টি সুপারিশ পেশ করে- (ক) ১৯০০ সনে বিশেষ কার্যাদি কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত স্মারক বাতিল করা এবং (খ) উক্ত রেগুলেশন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও আঞ্চলিক পরিষদ আইনের বিধানাবলীর সাথে যতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ ততটুকু কার্যকর থাকবে মর্মে প্রজ্ঞাপন জারি করা। লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগ উক্ত রেগুলেশন সম্পর্কিত ২টি মামলার সার্টিফায়েড কপি চাইলে আ লিক পরিষদ থেকে তা প্রেরণ করা হবে বলে জানানো হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা ২০১৯ চ‚ড়ান্তকরণ সংক্রান্ত ক্রমিক নং ৮(ঘ) এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্পর্কে গৌতম কুমার চাকমা জানান যে, ১/১/২০১৭ আ লিক পরিষদ ভূমি কমিশনের বিধিমালার খসড়া পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। ৬/২/২০১৭ তারিখে পার্বত্য মন্ত্রণালয় তা ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। দীর্ঘ সময় পরে ২৮/৩/২০১৯ ও ১০/৪/২০১৯ তারিখে ভূমি কমিশনের খসড়া বিধিমালার উপর দু’টি সভা হয়েছে। ভূমি কমিশন আইনে বলা হয়েছে, প্রচলিত আইন, প্রচলিত রীতি ও প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করবে কমিশন। আইনে কেবল প্রচলিত আইন সম্পর্কিত সংজ্ঞা রয়েছে। বিধিতে প্রচলিত রীতি, প্রচলিত পদ্ধতি ও বেদখল সম্পর্কিত সংজ্ঞা ও অন্যান্য কতিপয় বিষয় সন্নিবেশিত হয়নি। তাই বিধি ১ হতে বিধি ৬ পর্যন্ত সম্পর্কিত আঞ্চলিক পরিষদের সুপারিশ পুনরায় বিবেচনার্থে পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পরবর্তী সভা আহ্বান করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বৈঠকের সভাপতি পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবকে দায়িত্ব প্রদান করেন।

অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার সংক্রান্ত ক্রমিক নং ৮(ছ) এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্পর্কে ভারপ্রাপ্ত সচিব জানান যে, সশস্ত্র বিভাগের ০১/১০/২০০৯ তারিখের পত্রে উল্লেখ করা হয় যে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর ৫৫২টি অস্থায়ী ক্যাম্প হতে ২০০টি ক্যাম্প সরে নেওয়া হয়েছে। এ সময় জনসংহতি সমিতির সভাপতি জানান যে, চুক্তির স্বাক্ষরের পর কিছু নতুন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে বাঘাইছড়ি উপজেলার সিজক বুদ্ধ মন্দিরের জায়গায় সেনা ক্যাম্প দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয় হতে সেনা সদরে পত্র প্রেরণের জন্য পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে বৈঠকের সভাপতি নির্দেশনা দেন।

লীজ বাতিলকরণ সংক্রান্ত ক্রমিক নং ৮(জ) এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্পর্কে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব জানান যে, রাংগামাটি পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনার জানিয়েছেন ১৩টি লীজ দেওয়া হয়েছিল। শর্ত ভংগ করায় ৮টি বাতিল করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় ৩১টি লীজ দেওয়া হয়। শর্ত পালন না করায় সব বাতিল করা হয়। ৬টি বিষয়ে আপীল মামলা চলছে উচ্চ আদালতে। বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ১৮৭১টি লীজ দেওয়া হয়। শর্ত ভংগ করায় ৪১৬টি বাতিল করা হয়। এ সময় জনসংহতি সমিতির সভাপতি অভিযোগ করেন যে, বান্দরবান জেলায় বাতিলকৃত অধিকাংশ লীজ দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে পুনরায় বহাল করা হয়েছে।

ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও উপজাতীয় উদ্বাস্তু বিষয়ক টাস্ক ফোর্সের সভা নিয়মিত অনুষ্ঠিতকরণ সংকান্ত ক্রমিক নং ৮(ঝ) এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্পর্কে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব টাস্ক ফোর্সের সভা অনুষ্ঠানের জন্য বিভাগীয় কমিশনারকে অনুরোধ করা হলে সভা আহবানের কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এ সময় টাস্ক ফোর্সের সাচিবিক সহায়তার জন্য বিভাগীয় কমিশনারের পরিবর্তে উক্ত টাস্ক ফোর্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য জনসংহতি সমিতির সভাপতি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বিষয়টি সম্পর্কে যথাশীঘ্র কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে বৈঠকের সভাপতি নির্দেশনা দেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং টাস্ক ফোর্সে পদ সৃজন ও শুন্যপদ পূরণ সংক্রান্ত ক্রমিক নং ৮(ঞ) এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্পর্কে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব অগ্রগতি বিবরণ তুলে ধরেন। এ বিষয়ে যথাশীঘ্র বাস্তবায়ন করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণার্থে বৈঠকের সভাপতি পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটিকে সাচিবিক সহায়তার জন্য আলাদা অফিস, জনবল ও অর্থ বরাদ্দ সংক্রান্ত ক্রমিক নং ৮(ট) এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্পর্কে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব জানান যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

ভূমি কমিশনের সভা: সরকার এখনও বিধিমালা চূড়ান্ত করেনি

গত ১৯ মার্চ ২০১৯ এবং ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রাঙ্গামাটি সার্কিট হাউজে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের যথাক্রমে দু’টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত সভায় ভূমি নিষ্পত্তি সংক্রান্ত দরখাস্তগুলোর উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। দরখাস্তগুলোর মধ্যে প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের ভূমি বিরোধগুলো আগে নিষ্পত্তির জন্য বিবেচনায় নেয়া হবে বলে কমিশনের সদস্যবৃন্দ সর্বসম্মতিক্রমে অভিমত ব্যক্ত করেন। ভূমি কমিশনের বিধিমালা দ্রুত প্রণয়নের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়কে তাগাদা দেয়া এবং বিধিমালা প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি শুরু করা হবে না বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গত ২৭ জুন ২০১৮ তারিখে বান্দরবান সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বৈঠকের ৯ মাস পর ভূমি কমিশনের এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।

১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় বিগত সভার সিদ্ধান্ত অনুমোদন, কমিশনের কাজের অগ্রগতি, আভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু ব্যক্তিগণ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়। বস্তুত এই পর্যন্ত ভূমি কমিশনের কাজে কোন অগ্রগতি হয়নি। কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন, স্টাফ নিয়োগ, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় দুটি সাব-অফিস স্থাপন, কমিশনের জন্য তহবিল বরাদ্দ ইত্যাদি বিষয়সমূহ পূর্বের মতই অসম্পন্ন অবস্থায় রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ২০১৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের উপদেষ্টা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অনেক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সাথে গত ১৫ মে ২০১৯ আ লিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার নেতৃত্ব এক প্রতিনিধিদলের এবং গত ৮ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য ও আইন বিষয়ক কমিটির আহবায়ক গৌতম কুমার চাকমার নেতৃত্বে আরেক প্রতিনিধিদলের অনুষ্ঠিত সভা অন্যতম। বিশেষ করে ১৫ মে অনুষ্ঠিত সভায় ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন; চুক্তির বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগ চলমান মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা; চুক্তিকে লঙ্ঘন করে ১৯৯৬ সালের কার্যবিধিমালা অনুসারে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগের এসআরও নম্বর গ্রহণ ও ভেটিং গ্রহণ বাধ্যবাধকতা আরোপ না করা;আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের অধীনে প্রবিধান প্রণয়ন ও গেজেট নোটিফিকেশনের প্রক্রিয়া যথাযথ বাস্তবায়ন করা; চুক্তি মোতাবেক প্রণীত আইন অনুসারে পুলিশ (স্থানীয়) এবং আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সকল অফিস, জনবল ও আর্থিক বিষয় পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা; নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অফিস ও প্রতিষ্ঠানসহ সকল বিষয় ও কার্যাবলী পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা; বিদ্যমান আইন অনুসারে পার্বত্য জেলার সকল উন্নয়ন কার্যক্রমে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে যথাযথভাবে সম্পৃক্ত করা; ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয় সংস্থা ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলার সকল বিষয় পার্বত্য মন্ত্রণালয় ইহার কার্যপ্রণালী বিধি মোতাবেক সমন্বয় করবে মর্মে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ কর্তৃক গেজেট নোটিফিকেশন জারি করা ইত্যাদি ৮টি বিষয়ের উপর আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু তার পরেও এসব বিষয়ে কার্যকর ও দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর আজ ২২ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার আজ দীর্ঘ ১১ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির উপরে উল্লেখিত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে সরকারকে এগিয়ে আসতে কোন দৃশ্যমান ও সদিচ্ছাপূর্ণ উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ফলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সময় বিশেষে সভা অনুষ্ঠিত হলেও সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তবলী বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক ও দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই বললেই চলে। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা। দেশের সামগ্রিক স্বার্থেই এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাই দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থেই এ চুক্তি বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরী। তাই আর বিলম্ব না করে দেশের সামগ্রিক স্বার্থে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে সময়সূচি ভিত্তিক কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ পূর্বক রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও সদিচ্ছাপূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে সরকারকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে।

Back to top button