ঢাকায় পালিত হল বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮০তম জন্ম বার্ষিকী
সতেজ চাকমা: ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ পাহাড় তথা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮০ তম জন্মদিবস। এ উপলক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে দিনের শুরুতেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। উক্ত আয়োজনে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি লিটন চাকমার সভাপতিত্বে এবং সাংগঠনিক সম্পাদক সরল তঞ্চঙ্গ্যার পরিচালনায় একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা।সভায় বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা, জুম্ম শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম লিটারেচার এন্ড কালচারাল সোসাইটির সাহিত্য ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ঐতিহ্য চাকমা, পিসিপি ঢাকা মহানগর শাখার অর্থ সম্পাদক জিনেট চাকমা প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শহীদ মিনারে এই আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হয়।
বক্তারা বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তরুণ ছাত্র যুবাদের কাছে সকল সময়ের জন্য অনুকরণীয় ও অনুস্মরণীয় আদর্শ। মানবিক গুনের অধিকারী এ মানুষটি পাহাড়ের প্রত্যন্ত জুমিয়া জনপদ থেকে শুরু করে গণপরিষদ তথা সংসদেও স্বকীয় জাতি স্বত্ত্বার অধিকারের প্রশ্নে ছিলেন সরব এবং প্রতিবাদী।এছাড়া পরিচয়ের স্বীকৃতির জন্য গণপরিষদ বিতর্কে তাঁর রেখে যাওয়া যুক্তি ও বক্তব্যগুলো আগামী দিনের তারুণ্যকে লড়াইয়ের মাঠে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাবে বলেও উল্লেখ করেন বক্তারা। মানবেন্দ নারায়ন লারমা সহ পাহাড় তথা সকল নিপীড়িত আদিবাসী মানুষের অধিকারের সংগ্রামে এযাৎকালে শহীদ হওয়া সকল শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয় পুষ্প স্তবক অর্পনের পর পরই। মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা’র সরল ও বিপ্লবী জীবন দর্শন পাহাড়ের জুম্ম তারুণ্যকে আগামী দিনের পথ দেখাবে এই শপথ নিয়ে উক্ত আয়োজনের ইতি টানেন আলোচনা সভার সভাপতি লিটন চাকমা।
কবিতা আবৃত্তি ও আলোচনা সভা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া পাহাড়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদের আয়োজনে বিকালে টিএসসির প্রাঙ্গনে সঞ্জীব চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় মাতৃভাষায় কবিতা পাঠ ও আলোচনা সভা। উক্ত আলোচনা সভা ও কবিতা পাঠের আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের দীর্ঘদিনের বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীণ কণা। এছাড়া অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন কেদ্রীয় সংসদের সভাপতি মেহেদী হাসান নোবেল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য নারী নেত্রী চঞ্চনা চাকমা, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলীক মৃ এবং পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগরের সাধারন সম্পাদক রেঙ ইয়ং ম্রো প্রমুখ। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, চাক, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা সহ বিভিন্ন আদিবাসী ভাষার কবিতা পাঠের পাশাপাশি বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা জীবনের উপর চলে বক্তাদের আলোচনা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে অলীক মৃ বলেন, বর্তমান তরুণ ছাত্র সমাজকে অবশ্যই এম. এন.লারকে পাঠ করতে হবে। তাঁর সশস্ত্র লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে যে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তার মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়নের কথাও তুলে ধরেন এই ছাত্র নেতা।
মেহেদী হাসান নোবেল বলেন, ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসাবে যেসব মানুষদের জন্য গর্ব করি তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা। ছাত্র রাজনীতির অধ্যায় শেষ করে তিনি নিজ জাতিসত্ত্বার মুক্তির লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন যা বিরল বলে উল্লেখ করেন এই ছাত্র নেতা। একজন বিপ্লবী নেতার যেসব গুন থাকা জরুরী যেসবের সবকিছুই তিনি ধারণ করেন বলেও যোগ করেন ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি।
চঞ্চনা চাকমা বলেন, তরুণদেরকে অবশ্যই মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নারী অধিকারের জন্য সোচ্চার ছিলেন বলেও দাবী করেন তিনি। বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নারীদের নিয়ে বলা- ‘সমাজে একজন পুরুষ যে অধিকার ভোগ করবে একজন নারীও একই অধিকার ভোগ করবে’ বলে স্মরণ করেন এই নারী নেত্রী।
রেঙ ইয়ং ম্রো আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে মহান নেতা এম. এন লারমার দূরদর্শীতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর দেয়া সংসদীয় বিতর্কে মাঝি-মাল্লা, কামার-কুমোর, কৃষক শ্রমিক এমনকি পতিতার অধিকারের কথা যে তিনি বলেছিলেন তাঁর কথার প্রতিফলন যদি বর্তমান সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণীতে থাকতো তাহলে আজকের মত দুর্নীতি ও লুট-পাত হতো না বলেও মত দেন এই ছাত্র নেতা।
এছাড়া সভার প্রধান অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীণ বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা ছিলেন মানবিকতাবোধে উদ্দীপ্ত একজন মানুষ। তিনি তাঁর জনগোষ্ঠীর যে স্বীকৃতি তৎকালীন সংবিধানে চেয়েছিলেন তা বুজতে পারেননি তৎকালীন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা।
এদেশ বহু ভাষা ও বহু সংস্কৃতির মানুষের দেশ বলে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দর্শন হতে পারে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ সকল তরুণের পাঠেয়। পাহাড়ে চলমান নির্যাতন নিপীড়ন অবসানের জন্য সরকারকে আরো সংবেদনশীল হওয়ারও আহ্বান জানান বিশিষ্ট এই লেখিকা। উক্ত সংগঠনের সাধারন সম্পাদক জশোয়া দেওয়ানের পরিচালনায় এবং সভাপতি পরেশ চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হওয়া উক্ত কবিতা পাঠ এবং আলোচনা সভার স্লোগান ছিল- ‘লারমা তোমার চেতনা, হারিয়ে যেতে দেবনা।’