মতামত ও বিশ্লেষণ

করোনায় নয়, হামে মরছে দুর্গম অঞ্চলের পাহাড়ীরা: তরু চাকমা

বিশ্ব এখন করোনা নিয়ে ব্যস্ত। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এই করোনা ইস্যুর কারণে সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু কিছু এলাকায় হামের প্রাদুর্ভাব তেমন আলোচনায় আসছে না বললেই চলে। প্রশাসন ও গণমাধ্যম এ বিষয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্যও করছে না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আলোচিত ইস্যু করোনায় বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যার চাইতে পাহাড়ে কিছু এলাকায় হামের প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর সংখ্যা দেঢ় বেশি। তবুও প্রশাসন ও গণমাধ্যম কর্তৃক এটি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। এটি খুবই দুঃখজনক।

একবিংশ শতাব্দীতে বা যেখানে দেশে দেশে এমডিজি লক্ষ্য পরিপূরণের পর এসডিজি লক্ষ্য পূরণে কাজ চলছে সেখানে হামের প্রাদুর্ভাব বা হামে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, কল্পনা করা যায়? বাংলাদেশে হামসহ টিকাদান কর্মসূচীর শতভাগ সফলতা দাবির মুখে এ মৃত্যু কখনো ভাবা যায়? সংশ্লিষ্ট মহল থেকে হামের এ প্রাদুর্ভাবকে অজ্ঞাত রোগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। যেটিকে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখার মত মনে হবে। অথচ বাস্তব সত্যটি হচ্ছে, সেখানে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ও টিকাদান কর্মসূচী পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়নি। নিঃসন্দেহে এটি সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন অভিষ্টকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট পূরণে সতর্ক করবে। কয়েক বছর আগেও চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে ত্রিপুরা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতেও একই রকম সংকটের সৃষ্টি হয়। সেবারও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটিকে অজ্ঞাত রোগ হিসেবে চালিয়ে দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকার চেষ্টা করে। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয় যে, সেখানে কোন ধরণের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ও টিকা প্রদান করা হয়নি।

এখন মূল ঘটনার প্রতি নজর দেওয়া যাক। সাম্প্রতিক সময়ে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়ন এবং বান্দরবন জেলার লামা উপজেলার লামা ইউনিয়নে হামের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এই প্রাকৃতিক মহামারি প্রায় মাস খানেক পূর্বেই দেখা দেয় এবং কমপক্ষে ৩০০ জন শিশুর আক্রান্ত হওয়া ও ৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় সেখানকার অধিবাসীরা উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় দিনাতিপাত করছে ও জনজীবন নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে। এই চিত্র সে অঞ্চলের নাগরিক সুবিধা ও স্বাস্থ্য সেবার করুন অবস্থাকে প্রতিফলিত করে। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যে, বান্দরবন জেলার রুমা উপজেলায়ও হামে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

জানা যায়, সাজেকে মোট ৬টি গ্রামের প্রায় ২৫০ জন হামে আক্রান্ত হয় এবং তাদের অধিকাংশই শিশু। তুইছুই মৌজার অরুণপাড়া সবচাইতে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। ২০ দিনের ব্যবধানে ৬ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত অন্যান্য গ্রামগুলো হচ্ছে- লংথিয়ান পাড়া, কমলাপুর চাকমা পাড়া, নিউথাং/নতুনপাড়া, হাইচ্যাপাড়া ইত্যাদি। জানা যায়, কমপক্ষে ১০০ জন শিশু এবং ৭-৮ বছরের বয়সিরা বেশি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, তাদের গ্রামে শিশুদের এযাবত কোন টিকাই প্রদান করা হয়নি। সরকারের কোন স্বাস্থ্য সেবাও সেখানে পৌঁছায় নি। কোন স্বাস্থ্যকর্মী তাদের এলাকায় পা দেয়নি। উল্লেখ্য যে, সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা এবং সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি এ গ্রামবাসীদের বিশেষ করে শিশুদের পুষ্টিহীন ও রোগাগ্রস্ত করে রেখেছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে একটি দল হামের প্রাদুর্ভাব শুনে ঐ এলাকায় যায়। তারা ১৫ বছরের নিচে ২৮৫ জনকে টিকা দেয়। কিন্তু সংকটজনক ও চূড়ান্ত মুহূর্তে এখন টিকাই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নয়। এসময়ে তাদের নিরবিচ্ছিন্ন চিকিৎসা সেবা এবং পুষ্টির যোগান দেওয়া দরকার। টেকসই স্বাস্থ্য সেবার নিশ্চয়তাও গুরুত্বপূর্ণ।

গত ২৩ মার্চ ২০২০ তারিখে ইপিআই প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মাওলা বক্স চৌধুরী ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডা. আরিফুল ইসলামসহ চারজন চিকিৎসক দল সেখানে যায়। জানা যায়, চারজন শিশু এখনও মারাত্মক অবস্থায় রয়েছে। অনেক শিশু হামের পাশাপাশি ডাইরিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রয়েছে। শিশুরা পুষ্টিহীনতায়ও ভুগছে। তারা ৬ মাস থেকে ৪ বছরের সকল শিশুকে টিকা দিয়েছে। সকলকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল দেওয়া হয়েছে। কারণ, ভিটামিন এ ক্যাপসুল না পেলে আক্রান্ত শিশু অন্ধ হতে পারে। সাজেক ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জুস ও পুষ্টিজাতীয় খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

আরো জানা যায় যে, পুষ্টিহীনতার কারণে শিশুরা অনেক দুর্বল। টিকা দেওয়ার পরেও তারা তাদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কোন রোগীর মুমুর্ষু অবস্থায় অক্সিজেনেরও ব্যবস্থা নেই। কয়েকজনের অবস্থা এমন সংকটজনক যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হেলিকপ্টারে করে তাদেরকে চট্টগ্রামে নিয়ে এসেছে।

অন্যদিকে, বান্দরবন পার্বত্য জেলার লামা উপজেলার লামা ইউনিয়নে দুর্গম এলাকায়ও প্রায় একই সময়ে হামের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ম্রো অধ্যুষিত লাল্যাপাড়ায় ৪ মাসের এক ম্রো শিশু মারা গেছে এবং ৪২ জন আক্রান্ত হয়েছে যাদের মধ্যে কমপক্ষে ৩৩ জন শিশু। জানা যায়, গত ১৬ মার্চ তাদের মধ্যে ৩১ জন শিশু ও ২ জন প্রাপ্ত বয়স্ক রোগীকে ট্রাকে করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয়। প্রথম প্রথম স্বাস্থ্যকর্মীরা এটিকে অজ্ঞাত রোগ হিসেবে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, লাল্যাপাড়াসহ বান্দরবনের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি স্বাস্থসেবা পৌঁছায় নি।

এমতাবস্থায়, আক্রান্ত রোগীদের বাঁচাতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরো বেশি এগিয়ে আসা দরকার। তাদের স্বাস্থ্য সেবা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেও হাত বাড়ানো দরকার। করোনার সংকটে উক্ত মানবিক সংকটটি যেন হারিয়ে না যায়। করোনার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে হামের এ প্রাদুর্ভাবটি প্রশাসনের সুদৃষ্টি পাক এবং আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক সেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
………………………….
তরু চাকমা, সমাজকর্মী

Back to top button