এত ভয় কিসের ও হে তরুণ- সুমন মারমা
![](https://ipnewsbd.net/wp-content/uploads/2019/11/ee-1.png)
১.
প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা) একদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলের দিকে সফরসঙ্গীদের নিয়ে একটা কর্মসূচীতে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। কোন যানবাহন না থাকায় কয়েকদিন হেঁটে যেতে হচ্ছিলো। দুপুর বেলা একটা গ্রামে পৌঁছলেন। সেখানে যুব সমাজ নেশায় উচ্ছৃঙ্খল। একটা বাড়ি থেকে নারীর কন্ঠে কান্নার আওয়াজ পান প্রয়াত নেতা। সফরসঙ্গীদের দেখে আসতে বললেন। জানা গেল, নেশায় নিজ পত্মীকে প্রহার করেছেন সে বাড়ির ভদ্র লোকটি। লোকটিকে নেশা ছাড়তে এবং নারীদের সম্মান দিতে বলা হল। অতঃপর সে লোকটি আর নেশা করেননি।*
সেসময়ে (সত্তর দশক) আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশে খুব কমই ছিল। তারপরও বিলাসিতার রেওয়াজ কমতি ছিল না। নেশায় ডুবে থাকতো যুব সমাজ। যখন জাতীয় অস্তিত্বে টান পড়ে তখনও জুম্ম যুব সমাজ অজানা এক উচ্ছৃঙ্খলতায় মত্ত ছিলেন। সেসকল তরুণদের সংগঠিত করতে মহান নেতা এম এন লারমা এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুঁটে গিয়েছেন। অনেক তরুণ সংগঠিত হয়েছিলেন জুম্মদের অভিশাপ কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে। কিছু তরুণ তাদেরই বিরোধিতা করেছিলেন। এই অংশটি সমাজে বরাবরই থেকে যায়। সে অংশটি বর্তমান সময়ে চুক্তি বিরোধী কাজে লিপ্ত রয়েছে। পথ ভ্রষ্ট হয়েছেন অনেক তরুণ। তারপরও থেমে থাকেননি প্রয়াত নেতা। নিজের সামর্থ্য, দক্ষতা আর দূরদর্শিতা কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর দূরদর্শিতা ঐতিহাসিক চার দফা সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামা। এ দাবি বাংলাদেশের খন্ডতা স্বীকার করা নয়, সার্বভৌমত্ব ভাঙা নয়, সংবিধানকে অসম্মান নয়। তারপরও সেটা বাংলাদেশ সরকারের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। মূলত এটা ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণেরও একটা অংশ। জুম্মদের ভাষা, সংস্কৃতি তথা পরিচয় ভিন্ন হওয়ায় মূল স্রোতধারার সাথে খাপ খাওয়ার জন্য এই দাবিনামা। কারণ মূল স্রোতধারায় কোন না কোনভাবে এসকল জাতিগোষ্ঠীদের প্রভাবিত করতে পারে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাতে পারে। এ প্রেক্ষাপট থেকে চার দফা দাবিনামা। তরুণ বয়সে এম এন লারমা এসকল বিষয়সমূহ দূরদর্শিতা নিয়ে চিন্তা করেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এক ঝাঁক তরুণ জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাঁর (এম এন লারমা) সাথে মিলিত হয়েছিলেন। যেসময় অন্য দশজন তরুণ নিজের এক সুন্দর বাড়ি নির্মাণের চিন্তা করেছেন সেসময় তিনি সকল বিলাসিতা ত্যাগ করে সর্বোচ্চ আন্দোলনের জন্য তরুণ সমাজকে সংগঠিত করেছেন। এম এন লারমা’র পুরো পরিবার আন্দোলনের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন। সাথে অসংখ্য অদম্য সাহসী তরুণ সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের দুর্বার আন্দোলনের ফসল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন(ভূমি কমিশন)। এখন অনেক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে এসব কর্মক্ষেত্রে। সবাইকে অন্তর্ভুক্তিতে আনা হয়েছে। সকল জাতির মানুষকে এসব সুবিধায় যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয় হলো, এ সমস্ত কিছুর ফলেও কিছু একটা নেই। হ্যাঁ, সেটা হচ্ছে পার্বত্য চুক্তিটিই পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক এসব পরিষদ, কমিশন, সংস্থার যথাযথ ক্ষমতা, কার্যাবলী ও পদ্ধতি কার্যকর করা হয়নি।
মহান নেতা প্রয়াত হলেন ১০ নভেম্বর’৮৩ সনে। তাঁর দেখানো পথে হাঁটতে চলেছেন আরও অনেক তরুণ। থেমে থাকেনি আন্দোলন। কিন্তু কোথায় যেন একটা গন্ডগোল থেকে গেছে। কেন জানি আমরা আত্মকেন্দ্রিকতায় আটকে যাচ্ছি। সে বিষয়ে পরে আলাপ করছি।
২.
একটা কথা খোলাসা করে তুলে ধরতে চাই। পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হচ্ছে না সেটা আমরা সকলে জানি। একজন সাধারণ মানুষও আঁচ করতে পারছে। ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া নবীন বন্ধুটিও জেনে গেছে চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তবে কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না সেটাও জেনে রাখা দরকার। জাতীয়ভাবে চাপ সৃষ্টি করে কতভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। গণতন্ত্র চর্চা করি বিধায় আলাপ-আলোচনায় বিশ্বাসী হয়েছি। কিন্তু সরকার সেটার তেমন গুরুত্ব দেননি। এবং তার খেসারতও দিতে হবে ১৬ কোটি ৯১ লাখ (৯ লাখ বাদ দিয়ে) মানুষ তথা সরকারকে। নগ্ন কথা হলো, খোদ সরকার চায় না পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হোক। সরকারের সাথে যুক্ত কতিপয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নযোগ্য নয়। চুক্তি বাস্তবায়ন করলে সেখানকার সেটেলার বাঙালিরা উচ্ছেদের শিকার হবে, সেনাবাহিনীকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে, পাহাড়িদের একক আধিপত্য বৃদ্ধি পাবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, পাহাড়িদের অধিকার দিয়ে দিলে বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৯১ লাখ মানুষের সাথে বৈষম্য করা হবে। মূলত সেজন্য পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করা যাবে না বা হচ্ছে না।
অপরদিকে ইউপিডিএফ শুরু থেকে চুক্তিকে বিরোধিতা করে আসছিলো। এখন সংস্কারপন্থীরা যুক্ত হয়েছে বিরোধীতার কাতারে। সংস্কারপন্থীরা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন চায় মর্মে দাবি করেজনগণের সমর্থন আদায় করতে চায়। কিন্তু তাদের চরিত্র ও ভূমিকা জনগণের কাছে উন্মোচিত হয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশকে হয় অশান্ত, নয় ভাল করে রেখে দিয়েছে সরকার। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আরও একটি চুম্বকীয় নগ্ন কথা তুলে ধরতে চাই, পরিবেশকে পুরোপুরি অশান্ত করে তুললে পাহাড়ি তরুণরা গা ঢাকা দেবে। তাদের ভাষায় আন্ডারগ্রাউন্ডে রিক্রুট হবে। সরকার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠবে। আমরা সরকার বিরোধী আন্দোলন বলি না। বলি চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন। এতে করে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি হবে। তার জন্য পরিবেশকে ধরি মাছ, না ছুই পানি করে রেখে দিয়েছে। পানিকে ঘোলাতে না করে বড়শি পেতে মাছ শিকার করছে সরকার। আর আমরা পানি পরিষ্কার আছে মর্মে যে যার মতো বিচরণ করছি। অপরদিকে ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি তো আছেই। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এই নীতির জালে আটকে পড়েছে। ছাত্রদের মধ্যে বিভক্তি টানা, সমাজ ব্যবস্থায় বিভক্তি টানা, জাতিতে জাতিতে বিভক্তি টেনে দিচ্ছে সরকার। চাকমাদের বিরুদ্ধে মারমাদের লেলিয়ে দিচ্ছে, মারমাদের বিরুদ্ধে ত্রিপুরাদের,¤্রােদের মারমাদের বিরুদ্ধে, বমদের তঞ্চঙ্গ্যাদের বিরুদ্ধে, পাংখোয়াদের তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা আর চাকমাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী লেকচার খাওয়াচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে। এসব কিছু আঙুল দেখিয়ে দেখানোর প্রয়োজন নেই আর। আমরা সবাই কোন না কোনভাবে এই ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতির শিকার হচ্ছি বা মুখোমুখি হচ্ছি।
আমাদের গা শিউরে উঠে যে মুহূর্তে কোন অঘটন ঘটে। কিন্তু আমরা জন্মগতভাবে সাহসী হয়ে জন্মায়নি খেয়াল রাখবেন। পরিস্থিতি আমাদেরকে সাহসী-ত্যাগী হতে শেখায়। তারপরও দায়িত্ব বলতে কিছু আছে আমাদের যেটা সমাজে-আন্দোলনে নিশ্চিত করতে পারছি না।
৩.
পার্বত্য চুক্তির পর জুম্মদের উপর দেড় ডজনের অধিকসাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা হলো।মহালছড়ি পুড়লো, তাইন্দং পুড়লো, লংগদু পুড়লো, আরও কত পুড়ে যাওয়ার ইতিহাস পড়তে হবে আমাদের আগামীতে। নিত্য এসব খবর পড়তে পড়তে সাহসী লোকটিও বিরক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু বিরক্ত হবার কারণ নিজের মধ্যে কোনদিন জানার চেষ্টা করেননি। কত লোমহর্ষক ঘটনা আমরা দেখেছি, কত নিষ্ঠুর অত্যাচার আমরা দেখেছি এবং কত বঞ্চনার কথা শুনেছি। কিন্তু কোনটিই আমার ক্ষেত্রে ঘটেনি বলে পার পেয়ে যেতে পারেন না। এড়িয়ে যেতে পারেন না। আপনারও দায়িত্ব রয়েছে সমাজকে নিয়ে ভাববার। রাজনীতিকে নিয়ে ভাববার আপনারও অধিকার রয়েছে। এত ভয় কিসের ওহে তরুণ??!!! ভয় কিসের? মৃত্যুর ভয়?
সমস্যা হচ্ছে আমরা মরতে ভয় পাই। জীবনের প্রতি অনেক মায়া। কারণ একবারই জীবন, দু’বার নয়। কিন্তু দেখেন, আমরা মরতে পারি না তাই বেঁচে থাকার জন্য ঝুঁকিতে রয়েছি। বাঁচার জন্য মরতে হবে আর যারা মরেছে তাঁরা আজও বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে। বর্তমান সময়ে কত জনে ত্যাগ স্বীকার করছেন জুম্ম জনগণের জন্য তা কি আমরা কখনও খোঁজ নিয়েছি? জুম্ম জনগণ কত বঞ্চনায় রয়েছে তা কি খবর নিয়েছি? আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের পুনর্বাসন হচ্ছে না তা কি খোঁজ নিয়েছি? হাজার হাজার একর ভূমি সেটেলার বাঙালিদের দ্বারা বেদখল হয়েছে সেসব কি খবর নিয়েছি? আশির দশকে সেই সেটেলার বাঙালিদের নিরাপত্তার জন্য গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প গ্রহণ করেছিল সরকার। এখনও কোটি কোটি টাকায় সে প্রকল্প অব্যাহত রয়েছে সেটার খোঁজ কি নিয়েছি? স্থায়ী বাঙালি যারা তাদেরকে কোনদিন খোঁজ নিয়েছি? না কোনটাই করিনি।
মনে হয়, আমরা এমন একটি প্রজন্ম অতিক্রম চলেছি যারা রাজনীতিকে ভোজন শালা আর অর্থনীতিকে দায়িত্ব মনে করে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, অর্থনীতি কোনভাবে দায়িত্ব হতে পারে না। সেটার জন্য রাজনীতি নিজেই দায়িত্ব নেয়। তাত্ত্বিকভাবে বলা হয়- অর্থনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং শিল্প হলো রাজনীতির কান্ড এবং শাখা-প্রশাখা। আমরা অর্থনীতিকেই সর্বাগ্রেস্থান দিই। কিন্তু রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা না পাওয়া অবধি অর্থনীতি পর হস্তের ধন। অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে পাবার জন্য মূলত আমাকে রাজনৈতিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু তা মোটেও সহজ নয়। পুরনো সমাজকে ভেঙে নতুন সমাজ বিনির্মাণের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। সমাজ বিকাশের স্তরগুলোকে চেনা লাগবে। সেসব সমাজে বিদ্যমান শ্রেণিসমূহকে পুরোপুরিভাবে চিনতে হবে। তারপরেই সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিতে হবে। সে দায়িত্ব প্রবীণের পাশাপাশি নবীনের বেশি। আমরা একটি সুন্দর সমাজ চাই। যেখানে পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকবো। সেখানে ক্ষুদ্রতার কোন অপমান বইতে হবে না।
৪.
কাপ্তাইয়ের তুমাচিং মারমাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হলো, লংগদুর সুজাতা চাকমাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হলো, কৃতি ত্রিপুরাকেও ধর্ষণের পর হত্যা করা হলো। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম ধর্ষণের আবাসভূমিতে পরিণত হয়েছে। পুলিশ ধর্ষণ করছে, বিজিবি ধর্ষণ করছে, সেনা সদস্যরা ধর্ষণ করছে, সেটেলার বাঙালিরা ধর্ষণ করছে, গাড়ির চালক ধর্ষণ করছে আরও কত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। রোকেয়া লিটা’র ‘ডুমুর ফুল’ বইটিতে এসব কিছু আড়াল করতে সরকারের কুরুচিপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। রোকেয়া লিটা পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন একটি মহলের প্রকল্প পেয়েছিলেন পাহাড়িদের বিরুদ্ধে লিখতে। বর্তমানে সেটেলার বাঙালিরা সরকারকে খুশি করতে কতিপয় নিজস্ব বুদ্ধিজীবীর জন্ম দিয়েছেন। যারা কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেন। বিশাল বিশাল জনসভা করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যাতে বাস্তবায়ন হতে না পারে তার জন্য তারা বসে নেই। কিন্তু আমরা চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনে যোগ দিতে অনীহা। এই অনাগ্রহ আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের মারাত্মক দুর্ঘটনা ডেকে আনবে। আমরা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ডুবে রয়েছি। যে শিক্ষা সহায়ক বা জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হতে পারতো। কিন্তু সার্টিফিকেট পাওয়াটাই মুখ্য হয়ে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়। দেখা যায়, আমাদের ছেলে-মেয়েরা প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করছে না। যে শিক্ষায় মানবতা শেখায়, অধিকার কী জিনিস জানতে শেখায়, পরিবর্তন হতে শেখায়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখতে শেখায়, সামাজিক মূল্যবোধ অর্জন করতে শেখায়, নৈতিক মূল্যবোধ অর্জন করতে শেখায় সে শিক্ষা থেকে আমরা খুব দ্রুত সরে যাচ্ছি। যার ফলে আনন্দে চেতনাহীন হয়ে যাচ্ছি আর নীতিহীন রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছি। কথায় আছে, গ্রন্থগত বিদ্যা আর পর হস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন। যেটা শিখছি তা সমাজে কাজে লাগাতে হবে। সমাজ ও দেশের জন্য কাজে লাগাতে হবে। সমাজে গিয়ে শিক্ষা অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা আর জ্ঞান অর্জন এক নয়। আজকে আমাদের সমাজে যে নিপীড়ন ও অত্যাচার চলছে তা উপলব্ধিতে আসতে হবে। যে শিক্ষা কঠিন সময়ে সমাধান দিতে পারে না, পরিবর্তন করাতে পারে না, সমাজে মানুষের সাথে মিশতে দেয় না, অধিকার হারা মানুষদের আর্তনাদ বুঝতে পারে না সে শিক্ষাকে ধিক্।
৫.
পনেরোটা পরিবার ভালই দিন কাটাচ্ছিল। ঝিরির পানি আর জুম চাষ। সকল ঋতুর সবজি প্রায় বাজারে নামাতে পারতো। কিন্তু হঠাৎ একদিন কিছু ইন করা ভদ্রলোকসহ সেনাবাহিনীর গাড়ি এলো তাদের বাড়ির আঙিনায়। বাচ্চারা বরাবরই লাজুক। কিশোর বয়সী ছেলে-মেয়েরা সেনাবাহিনী দেখলে কিছুটা ভয়ে থাকতো। আমি নিজেই সেনাবাহিনীর গাড়ি দেখলে ঝোঁপে লুকিয়ে পড়তাম ভয়ে। আতঙ্ক লাগে। যাক, সেদিন এসেছিলো এবং বলে গেল পাড়া প্রধানকে অমুখ তারিখে উপস্থিত থাকতে। পড়ে জানা গেল, জেলা প্রশাসন ঐ জায়গায় পর্যটন গড়ে তুলবে। হ্যাঁ, নীলাচল পর্যটনের কথা বলছি। এরকমটি ঘটেছে। সময়সীমার মধ্যে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে নিরীহ মানুষদের।**
অপরদিকে নীলগিরির সুরটা আরও অনেক করুণ। সেসব এলাকায় স্থানীয় মানুষের কোন অংশীদারিত্ব নেই। পর্যটন আইন অনুসারে পর্যটনের জন্য স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ত করা অর্থাৎ অংশীদারিত্ব থাকতে হবে। পার্বত্য চুক্তি অনুসারেও সকল পর্যটন পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে থাকবে। কোন আইন মানা হচ্ছে না। যে যেভাবে পারে পর্যটন বানাচ্ছেন। নীলগিরি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত, নীলাচল জেলা প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত, নীলগিরির পাশে একটা রয়েছে সেটি বিজিবি নিয়ন্ত্রিত। ঢাকা থেকে আমার বন্ধুরাসহ আমিও নীলগিরি গিয়েছিলাম কিন্তু আমি ভেতরে ঢুকিনি। বান্দরবানের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও আমি আজ অবধি ভেতরে যায়নি। খবর নিয়েছি, স্থানীয় লোকদের ঢুকতে দেয়া তো দূরের কথা, ঢুকতে গেলেও টাকা দিয়ে ঢুকতে হয়। পার্বত্য চুক্তি পরিপন্থী কাজ সরকার করেই যাচ্ছে। অবৈধভাবে পর্যটন স্থাপন, নিরীহ মানুষদের রাতারাতি উচ্ছেদ। একটা বিষয় লক্ষ করার মতো, সামাজিক সংগঠন নামধারী সংগঠনগুলো এসব মানতে নারাজ। কারণ তারা শাসকগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক রেখে চলেন। অথচ ভুক্তভোগী মানুষেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাঁটা তার পার হচ্ছেন। এসমস্ত তাদের খেয়াল নেই। আমাদের কাঁদায়, তবে অল্পক্ষণের জন্য নয় কি???
সামাজিক সংগঠন বিষয়ে কথা তুলতেই হয়। তুমাচিং মারমাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হলো। আমি সেদিন রাজস্থলীতে ছিলাম। রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনসমূহও বিভিন্ন জায়গায় কর্মসূচী দিয়েছে জাতীয় রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো বাদে। সকালবেলা আমাকে ফোন দেন তখনকার সময়ে বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট’স কাউন্সিলের (বিএমএসসি) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। আমরা একই এলাকার। একটা মাহিন্দ্র অটো রিজার্ভ করে বান্দরবান শহরের দিকে রওনা দিলাম। ওখানে বিএমএসসি’র ব্যানারে তুমাচিং মারমাকে ধর্ষণের পর হত্যা এর প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। আমাকে বক্তা হিসেবে যেতে হচ্ছে। কিন্তু আমি যাচ্ছিলাম প্রতিবাদ করতে, বিচার চাইতে। গিয়ে দেখি এলাহী কান্ড। সভাপতি সাহেব সভাপতিত্ব করতে চাইছেন না তাই শুরু করতে দেরি হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম বেচারা ভয় পাচ্ছে যদি ছাত্রলীগ কর্মীরা দেখে তাহলে বহিষ্কার করবে, সেই ভয়ে। সে সভাপতি ভদ্রলোকটি জেলা ছাত্রলীগে কোন একটি সম্পাদকমন্ডলীর দায়িত্বে আছেন। তাই ভয়ে সভাপতিত্ব করতে চাইছেন না পদবী বাঁচাতে। কী করে আন্দোলন হবে এরকমই হলে। প্রকৃত নিঃস্বার্থ আন্দোলন কিভাবে করবেন তারা? সমাজকে ঘুণেধরা স্রোত থেকে কিভাবে তুলে আনবেন! শুধু সে ভদ্র লোকটি নয়, আরও অনেক লোক আছেন যারা ভদ্রের মুখোশ পড়ে অস্তিত্ব রক্ষার গল্প শোনান। সংশোধন হওয়ার দরকার আছে। ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরামের বিষয়টিও একই। পাংখোয়া স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর বিষয়টিও একই। রাঙামাটি জেলার আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত রেমলিয়ানা পাংখোয়ার নিজের অনুসারী করতে এই ছাত্র সংগঠন সৃষ্টি করা হয়েছে।
সমস্যা সবার এক। কিন্তু বুঝেন যে যার মতো। অনেকে নিজেকে তুলে ধরতে সৃষ্টি করেছেন সংগঠন। যাদের কাছে অর্থের কোন জবাবদিহিতা নেই। নেই স্বচ্ছতাও। মানবতার গল্প শুনিয়ে চলেছেন অথচ পার্বত্য চুক্তি কী এখনও জানেন না। যে সকল সামাজিক সংগঠন রয়েছে তাদের মধ্যেকার বেশির ভাগ কর্মী পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে অজ্ঞ এবং অনেকে না জেনে মন্তব্য বা বিরোধিতা করেন। অথচ তারা অধিকার নিয়ে মুখে ফেনা তুলেন। কিভাবে একজন মানুষ এত আদর্শহীন হতে পারেন!উপরে বলেছিলাম, আমরা কোন এক আত্মকেন্দ্রিকতায় আটকে যাচ্ছি। কেন? সে সদুত্তর সবার ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে কিন্তু সর্বজনগ্রাহ্য একটি যুক্তি আছে, সেটি হচ্ছে সঠিক পন্থায় শিক্ষা লাভ না করা। মনোবিজ্ঞান শাস্ত্রের মতে, আত্মকেন্দ্রিকতা একটি মানসিক ভারসাম্য হারানোর প্রাথমিক পর্যায়। এতে করে পরযোগিতা, মানে পর কল্যাণ ব্যাঘাত ঘটে। নিজের মতো করে ভাবতে থাকে। মানবতা তার জীবন থেকে ছেড়ে যেতে থাকে। আত্মকেন্দ্রিক হওয়ায় সার্বিক মঙ্গল বিসর্জিত হতে থাকে। আত্মকেন্দ্রিকতার ফলে পরচর্চাও বৃদ্ধি পায় এবং এতে করে তাতে সে শান্তি লাভ করতে চায়। সুতরাং আত্মকেন্দ্রিকতা হলো চিন্তার উদ্দেশ্যকে নিজের মধ্যে আবদ্ধ রাখা।
৬.
নারী। এই একটা শব্দে গোটা ‘মা’ কুলকে বোঝানো হয়। আধুনিক সভ্যতায় নারীকে পণ্য হিসেবে বেশি উপস্থাপন করা হয়। প্রাচীন গ্রীসে শুধুমাত্র রাজ পরিবারের নারীদের ক্ষমতা ছিলো। তবে সে ক্ষমতা যেকোন সময় ছিনিয়ে নেয়া যেত। আর সামন্ত সমাজেও নারীর কোন ক্ষমতা তো দূরের কথা, জীবনের কোন গুরুত্বই ছিল না। নারীকে কেন্দ্র করে ভূখন্ড দখল রাজা-বাদশা আমলে লক্ষ করা যায়। মহাভারতে শেষ যুদ্ধের ময়দানে শিখন্ডিনিকে লড়াই করতে দেয়া হয়নি নারী বলে। গৌতম বুদ্ধ কঠোর সাধনার পর শরীরের ক্লান্তি নিয়ে চলতে পারছিলেন না। সুজাতা নামক প্রথম এক রমণী তাঁকে পায়েস খাইয়েছিলেন। সব কিছুর পরও নারীরা অবহেলিত সমাজে। পুরুষের আধিপত্য যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে তখন নারীরা নারীবাদী হতে বাধ্য হয়। কিন্তু নারীবাদী হওয়াটাও অতি সংশোধনবাদে ও হঠকারিতায় পড়ে। নীতিবিদ্যায় নারী এবং প্রকৃতিকে এক কাতারে দেখানো হয়েছে। প্রকৃতিকে আমরা নিজের প্রয়োজনে ধ্বংস করছি। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে। নারীকেও তাই করছি আমরা। মাতৃকুলকে অবহেলা আর অযতœ করা মোটেও উচিত নয়।
সত্তর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন আন্দোলন সর্বোচ্চ পর্যায়ে তখন অনেক জুম্ম নারী গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল। প্রতিটি সমাজ সংস্কারের আন্দোলনেও নারীদের ভূমিকা অনবদ্য। ১৯৭৫ সনে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি, ১৯৮৮ সনে হিল উইমেন্স ফেডারেশন গঠিত হয়। এতে করে নারী সমাজ সংগঠিত হবার ক্ষেত্র তৈরি করে। চুক্তির আগ পর্যন্ত নারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ প্রশংসনীয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে কেমন যেন নিভু নিভু অবস্থানে রয়েছে নারী সামজের অগ্রগামী এই অংশটি। চুক্তি বাস্তবায়নের কোন সম্ভাবনা নেই জানার পরও নারী সমাজ সংগঠিত হতে পারছে না। নানা বাস্তবতায় জর্জরিত সমাজে তাদের আরও সাহসী হতে হবে। তাদেরকে সর্বক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সব কিছুর আগে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। তরুণ সমাজকে যথাযথ শিক্ষা ও কাউন্সেলিং করতে হবে। সংগ্রামের ইতিহাস সম্বন্ধে তাদের ধারণা দিতে হবে। কথায় আছে- যে জাতি সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে জানে না সে জাতি আন্দোলনে সঠিক পথ বাছাই করতে পারে না।
৭.
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন একটি ভয়ানক জাতি নিধনের নমুনা। কোন একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার অন্যতম হাতিয়ার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। উদাহরণ হিসেবে দেয়া যায়-
ক) জুম্ম আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী অনেক জায়গা-বস্তুর নাম পরিবর্তন করে দিয়ে সরকারি দলিলে অন্তর্ভুক্তকরণ;
খ) জুম্মরা কথায় কথায় নিজের ভাষায় মনের কথা প্রকাশ না করা বা কথা বলার সময় বাংলা শব্দ ব্যবহার করা;
গ) সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করা;
ঘ) পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসীদের পরিচয়কে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা;
ঙ) খাদ্য বস্তু সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি;
চ) পোশাক-পরিচ্ছদকে অসম্মান করা ইত্যাদি।
দিন যত যাচ্ছে এই আগ্রাসন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দুর্বলতা আমরাই প্রকাশ করছি। অন্তত চেষ্টা করি সংস্কৃতিকে চর্চা করতে। বর্তমান সময়ে যারা ইউটিউব বা সামাজিক মাধ্যমে সাংস্কৃিতক বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি প্রচার করেন তা নিছক বিনোদন মাত্র। সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে মন থেকে সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। কারণ সংস্কৃতিই আমার পরিচয়। সামাজিক মাধ্যম বা ইউটিউবের উপর নির্ভর না হয়ে নিজস্ব সাংস্কৃতিক অঙ্গন গড়ে তুলতে হবে যেখানে সকলে মিলে সংস্কৃতি চর্চা করতে পারে। সংস্কৃতিকে নিয়ে কোনদিন ব্যবসা করতে নেই। নিজের সংস্কৃতিকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরার জন্য হয়তো একটা উপায় ভাবা যায় কিন্তু তা যাতে বাণিজ্যিক রূপ না নেয়। প্রত্যেক জাতির আলাদা আলাদা সংস্কৃতি রয়েছে। আরও রয়েছে সাহিত্য-শিল্প। আমাদের ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। প্রতি ১৫ দিনে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার ভাষা হারিয়ে গিয়েছে চর্চার অভাবে। অনেক ভাষার মানুষ আছেন যারা নিজের ভাষা হারিয়ে ফেলে অন্য ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করেন। এতে করে তার পরিচয় ও অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ে। শহরে বসবাসকারী শিক্ষিত জনের মুখে প্রায়শ নিজের মাতৃভাষা শোনা যায় না। নিজেকে পরিপাটি করতে গিয়ে নিজের ভাষাই হারাচ্ছেন তারা। ভাষাকে টিকিয়ে রেখেছেন অধিকাংশ গ্রামীণ মানুষেরা। তারা ভাল বাংলা বলতে না পারায় আমরা ইতস্তত হই। কিন্তু সম্মানের সাথে বলতে হয়, তারাই প্রকৃত ভাষার ধারক এবং বাহক। শহরে বেড়ে ওঠা শিশুটি তার সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতেই চায় না। কিন্তু গ্রামে বেড়ে ওঠা শিশুটি আসল পরিচয় জেনেই বড় হচ্ছে। সুতরাং শিশুটিকে বাল্যকাল থেকে সংস্কৃতির সংস্পর্শে রাখুন।
৮.
ধর্ম। শুরুতে প্রয়াত ধর্মীয় গুরু মেজর ক্যহ্লাউ ভান্তেকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। যিনি তাঁর জীবদ্দশায় জুম্ম জনগণের জন্য নিজের শক্তি এবং সামর্থ্যকে দান করেন। প্রতিটি প্রাণিকুলে ধর্ম রয়েছে। আমরা জানতাম শুধু মানবকুলের জন্য ধর্ম। ভ্রান্ত ধারণা। এটি আচার এবং বিশ্বাসের উপর নির্ভর একটি মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা। বলা হয়ে থাকে মানব ধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। বৈজ্ঞানিক চিন্তায় ধর্ম হলো একটি শৃঙ্খলা। যেটি সমস্ত প্রাণিকুলকে শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে রাখে। এটি কালক্রমে অতি বিশ্বাসে জন্ম দিয়েছেন নানা জন। ভাববাদী দর্শন সৃষ্টির বহু পরে এই ধর্মের সৃষ্টি। পৃথিবীর এক একটি অঞ্চল জুড়ে দার্শনিক ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে। প্রতিটি ধর্মে দার্শনিক ভিত্তি রয়েছে। যখনই সমাজের জন্য না হয়ে ধর্মের জন্য সমাজ স্বীকৃত হয়েছে সে হতে ধর্মের অপব্যাখা শুরু হয়। তাছাড়া আমরা জানি, সমাজ বিকাশের ধারায়ও সামন্ত প্রভূরা নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্য এবং শোষণকে আড়াল করার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। প্রাণিকুলে ধর্ম হচ্ছে তাদের মধ্যেকার শৃঙ্খলা। তাদের জন্মসত্তার শৃঙ্খলা। কুকুর তার মালিকের খুব ভক্ত। পিঁপড়ে ছোট হলেও তারা শৃঙ্খলায় চলতে ভালবাসে। ঘোড়া শত কিলোমিটার মালিককে পিটে চড়ালেও অভিযোগ করবে না। এটাই তাদের ধর্ম। কিন্তু আমরা এখন ধর্ম বলতে কোটি টাকা দানকে বুঝি। ধর্ম বলতে ত্রিপিটককে গান গাইয়ে শহরে ঘুরে বেড়ানোকে বুঝি। ধর্ম বলতে অতি বিশ্বাসকে বুঝি। কিন্তু না। গৌতম বুদ্ধ কোন ভগবান বা ঈশ্বর নন। তিনি একজন মানবতাবাদী দার্শনিক। তাঁর দর্শনের নাম বৌদ্ধ দর্শন। তিনটা পিটক নিয়ে ত্রিপিটক। সূত্র পিটকে তাঁর সমস্ত দর্শন সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ রয়েছে। অভিধম্ম পিটকে সে সমস্ত সূত্রের ব্যাখা বা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আর বিনয় পিটকে সমস্তমানুষের আচার-নিয়ম নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটি আমাদের অধ্যয়ন করা উচিত। যে সমস্ত বিষয়গুলো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই সেগুলো গ্রহণ করবো না। কিন্তু এটি মাথায় তুলে পূজো করলে তো হবে না।
ধর্ম হলোচর্চার বিষয়, মুখ বন্ধ করে মুখস্থ করে সুরে সুরে বলা নয়। বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে বৌদ্ধ দর্শনে। কিন্তু আমরা সেটিকে খর্ব করে ধর্মকে অবমাননা করেছি। হীনযান, মহাযান, সৌতান্ত্রিক এবং বৈভাষিক সম্প্রদায় থাকতে পারে কিন্তু অতি বিশ্বাসের কোন স্থান থাকতে পারে না। চিকিৎসা, শিক্ষার পর ধর্মেও বাণিজ্যিক রূপ লক্ষ করার মতো। সংস্কার হওয়া উচিত ধর্মে। সমাজের জন্য যে সকল বিষয় হিতের বিপরীত সেগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে। বেদ এবং উপনিষদে প্রবীণ বয়সে ধর্ম চর্চা করার কথা উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া গৌতম বুদ্ধ স্বয়ং বলেছেন, বিচার-বিশ্লেষণ না করে কোন কিছু গ্রহণ করবেন না। পঞ্চবর্গীয় শিষ্যগণের উদ্দেশ্যে এই উপদেশ। এগুলো আমাদের স্মরণে থাকতে হবে। মুসলিম দর্শনেও আল-কোরানে বলা হয়েছে- সব কিছুর কোন না কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে। এগুলো হাদিসে ব্যাখা দেয়া হয়েছে। পুরনো ও নতুন টেস্টামেন্টেও মানব ধর্মের প্রমাণ মেলে। সুতরাং জুম্মদের রাজনৈতিক চেতনা বিকাশে ধর্ম যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় সেটার প্রতি ধর্মীয় গুরুদের নজর দিতে হবে। মনে রাখবেন, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ব্যতীত কোন ধর্মই নিরাপদ নয়। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে তথা ধর্মীয় অধিকার এবং স্বাধীনতার জন্য ধর্মীয় গুরুদের ভূমিকা রাখতে হবে।
৯.
পরিসমাপ্তিতে বলতে হয়, চারপাশে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে তারপরও আমার নিরবতা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে আমি হুজুগে মাতাল। পরিস্থিতি সর্বদা আমার অনুকূলে থাকবে না। আমাদের জন্য পরিবর্তন হাতছানি দিচ্ছে। নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতে হবে। আপনার শক্তি আর সামর্থ্য কাজে লাগান। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছেন?? ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আপনার উপর নির্ভর করছে। সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখতে হবে। অধিকার আদায় করতে হবে।
বি:দ্র: (*) তারকা চিহ্নিত লেখাগুলো প্রবীণদের স্মৃতিচারণা।
সুমন মারমাঃ সহ সভাপতি, পিসিপি কেন্দ্রীয় কমিটি।