শিল্প ও সংস্কৃতি

অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই গান নিয়ে থাকতে চাই- সূচী

সতেজ চাকমা: আদিবাসী নারী কন্ঠ শিল্পী উ মিমি মারমা মিমি। যার ডাক নাম সূচী। পড়ছেন ঢাকার ইউনিভার্র্সিটি অব ডেভলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (UODA) এর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। গান করেন। তবে তাঁর গলায় যে গান হয় সে ধারার গান করা তেমন পরিচিত কোনো নারী শিল্পী এখনো সেভাবে প্রতিষ্ঠা পাননি। গান করেন ‘হার্ড রক’।

অসাধারণ সুরে নান্দনিক ছন্দ ও ভাষায় তাঁর গলার যে গান যেন মানুষের মনে বিষ্ময় ছড়িয়ে দিতে বেশ সাবলীল। ঢাকা কেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান বিশেষ করে আদিবাসীদের নিয়ে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে তাঁর বিষ্ময়ী গলায় গান গেয়ে কুড়িয়ে নিচ্ছেন অনেক ভালোবাসা। উ মিমি মারমা’র বেড়ে ওঠা খাগড়াছড়িতে। বাবা এবং মা দুজনেই সুর সাধনার মননশীর জাদুকর ছিলেন। বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠান, আঞ্চলিক নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন, মারমাদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব সাংগ্রাই থেকে শুরু করে স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সূচী নিয়মিত গাইতেন এবং তাঁর সুরের জাদুতে আচ্ছন্ন রাখতেন দর্শকদের।

তাঁর অর্জনের তালিকায় রয়েছে যথাক্রমে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে জাতীয় শিশু সপ্তাহ প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে প্রথম হওয়ার অনন্য গৌরব। সেই সাথে বিভাগীয় পর্যায়েও তিনি অর্জন করেছেন দ্বিতীয় পুরষ্কার। বাবার হাত ধরে গানের জগতে প্রবেশ করা এ শিল্পী তালিম নিয়েছে খাগড়াছড়ির রুমী চৌধুরী এবং কাজল সরকারের কাছ থেকে। হার্ড রক এর জাদুতে পারদর্শী এ গায়িকার সাথে কথা হয় আইপিনিউজ এর এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, গান করতে যেয়ে নারী হিসেবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা এবং ‘হ্যারাসমেন্টে’র শিকার হয়েছি বহুবার। অনেকেই অকথ্য মন্তব্য করতেন বলে জানান তিনি। এছাড়া “মেয়ের কন্ঠে ‘রক’ গান” বলেও অনেকে তাঁকে হেয় করতে দ্বিধা করতেন না এবং ‘ভয়েস’ কেন ছেলের মত- এইসব নানাবিধ খারাপ মন্তব্যর সম্মুখীন হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
এসকল নানা বিরূপ মন্তব্যের শিকার হওয়ার পরেও তিনি আশার সুরে বলেন, আগে লালনের গানকেও অনেকেই পাগলের গান বলে মন্তব্য করতেন। কিন্তু এখন অনেকেই লালন চর্চা করেন। নতুনত্বকে যারা সহজেই গ্রহন করতে চায়না তারাই এ ধরণের মন্তব্য করে আমাদের মত শিল্পীদেরকে দমিয়ে রাখতে চায় বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।

গান নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়প্রত্যয়ী এ নারী আদিবাসী শিল্পী মজার ছলে আরো জানান, ‘আমাকে যদি না খেয়ে সপ্তাহ ব্যাপী থাকতে বলেন তাহলে আমি থাকতে পারবো তবে কেউ যদি আমাকে গান শোনো বা গান করতে বারণ করেন তবে এক সপ্তাহ কেন এক মুহূর্তও থাকতে পারবো না।’ তবে গানের প্রতি এত দরদ থাকা সত্তেও শিল্পী হিসেবে স্বাভাবিক কিছু অনুভূতি ব্যক্ত করেন আইপিনিউজ এর সাথে। অন্য সব শিল্পীদের মত আর্থিক টানপোড়নের কথাও জানান তিনি। যার জন্য গানের জগৎ থেকে মাঝে ছিটকে পড়তে হয় তাঁকে। তবে নানা প্রতিকূলতা সত্তেও তিনি পাহাড়ের আদিবাসী জীবন নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা জানান। তিনি বলেন, পাহাড়ে আদিবাসীদের বঞ্চনা, নারী ধর্ষণ এবং বিভিন্ন ধরণের সহিংসতার কথাগুলো যখন কানে আসে তখন স্বভাবতই মনে কষ্ট লাগে। রাজনৈতিক প্লাটফর্মে এসে কথা বলতে না পারলেও তিনি তাঁর কন্ঠকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে সেসব বঞ্চনা ও নারী নিপীড়নের কথাগুলো গানে গানে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান। স্ব স্ব অবস্থান থেকে সবার এসবের বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত বলেও মনে করেন এই নারী শিল্পী। এছাড়া ধর্ষণের শিকার নারীদের করুণ অনুভূতিগুলো গানে গানে তুলে ধরার জন্য পরবর্তীতে তিনি স্বোচ্ছার থাকবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সকল কিছুর উর্দ্ধে মানবতাকে স্থান দিয়ে মানুষের জন্য গানকে নিয়েই এগিয়ে যাবেন বলে আশার কথা জানান পাহাড়ের নারী শিল্পী উ মিমি মারমা মিমি।

Back to top button