‘আদিবাসী নারীরা বহুমাত্রিক বঞ্চনার মধ্যে বসবাস করছেন’-সুলতানা কামাল
‘আদিবাসী নারীরা বহুমাত্রিক বঞ্চনার মধ্যে বসবাস করছেন’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল। আজ মোহাম্মদপুরের সিবিসিবি সেন্টারে অনুষ্ঠিত দুদিনব্যাপী আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের ৪র্থ জাতীয় আদিবাসী নারী সন্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘আদিবাসী নারীরা সর্বক্ষেত্রেই বঞ্চনার শিকার হয়, আদিবাসী হিসেবে, নারী হিসেবে, আদিবাসী নারী হিসেবে, আরো নানান ভাবে। আর বঞ্চনার কথা বাদই দিলাম, রাষ্ট্রতো আদিবাসীদের অস্তিত্বই স্বীকার করছেনা। সংবিধানে আদিবাসীদের পরিচয় নাই। রাষ্ট্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে পরিচয় দিতে চাইছে, বাংলাদেশের আপেক্ষিকতায় হয়তো সংখ্যায় তারা কম কিন্ত অন্য স্থানে তারাতো সংখ্যায় বেশি। ফলে এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিচয় নিরপেক্ষ কোন পরিচয় নয়।’
‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে সমতা আর সাম্যের স্বপ্ন রয়েছে। কেউ বা কোন দল যদি মুক্তিযুদ্ধের সমতা ও সাম্যের বাংলাদেশের আদর্শ থেকে সরে যায় তবে তাদের ভূলের অংশীদার আমরা হবোনা। কারো বিচ্যুতি ঘটলেও আমরা আমাদের বিচ্যুতি ঘটাবনা’ বলেও জানান তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্ঠা সুলতানা কামাল।
উদ্বোধনী বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪৮ বছর পূর্তি আমরা পালন করছি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রগতি উদযাপন করছি। কিন্তু একদিকে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও আরেকদিকে জনসাধারণের মাঝে আয়ের বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে। আবার রাষ্ট্র আদিবাসীদের বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করছে যা কাম্য নয়। ”
তিনি আদিবাসীদের পারিবারিক অধিকার কি অবস্থায় রয়েছে তা নজর দেয়ার কথা বলেন। এজন্য তিনি পারিবারিক আইন প্রতিষ্ঠার জন্য জোর দাবি জানান। সেসাথে আদিবাসীদের নিজেদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার যে ষড়যন্ত্র চলছে তার প্রতি সোচ্চার হওয়ারও দাবি জানান।
আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘আদিবাসীদের বঞ্চনা, পিছিয়ে পড়া, দুঃখ হাহাকার কিছুই এই রাষ্ট্র দেখছেনা। তবে আমরা বসে থাকার পক্ষে নই, আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আদিবাসী সমাজের অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে নারী পুরুষ উভয়ই খেটে খায়, শ্রম দেয়, উপার্জন করে। আদিবাসী নারীরা অবশ্যই অনেক শক্তিশালী। তারা আরো সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।’
‘সর্বত্রই নারীদের নিরাপত্তার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। বাইরেতো নারীরা লাঞ্চিত হচ্ছেই, আজকাল ঘরেও নারীদের নিরাপত্তা নাই’ বলে মন্তব্য করেছেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার এভিলিনা চাকমা।
শিক্ষাক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে দেখা যায় আদিবাসীরা ৯৭ ভাগ ভর্তি হয়, প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে যাবার হার ৫৯ ভাগ এবং এসএসসিতে এসে তা ২৪ ভাগে দাঁড়ায়। নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি।’
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, ‘এই রাষ্ট্র, প্রশাসন, ভূমিদস্যুরা আমাদের তিলে তিলে মেরে ফেলছে। আমাদের জমি কেড়ে নিচ্ছে, আমাদের মেয়েদের অপহরণ করছে, এই হলো বর্তমান অবস্থা।’
তিনি আদিবাসী নারীদের সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আক্ষেপ করে বলেন, ‘আদিবাসী নারীদের কী যোগ্যতা নেই, যে তারা সংসদে যেতে পারবেনা? আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সংসদে আদিবাসী নারীদের প্রতিনিধি পাঠানোর কোন সৎ ইচ্ছা নেই!’
কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, ‘রাষ্ট্র আদিবাসী নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন সুপারিশ গ্রহণ করলেও এর যথাযথ বাস্তবায়ন আমরা লক্ষ্য করি না। আদিবাসী নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে সকল জাতীয় আইন ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি রাষ্ট্র গ্রহণ করেছে তা বাস্তবায়নে সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক মিনু মারিয়া ম্রং বলেন, নারী অধিকার প্রশ্নে মানুষ এখন এতো সোচ্চার হওয়ার পরও আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা কমছে না। সেটা ক্রমশই বেড়ে চলেছে।’ আদিবাসী নারীদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আরো আন্দোলন গড়ে তোলার তিনি জোরালো আহ্বান জানান।
দুইদিনের এ আদিবাসী নারী সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি তার বক্তব্যে দেশের আদিবাসী নারীদের বিভিন্ন বঞ্চনার কথা তোলে ধরেন। দুইদিনের এ সম্মেলনে ছয়টি অধিবেশন রাখা হয়েছে যেখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের নারী, আদিবাসী ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি তৃণমূল আদিবাসী নেতৃবৃন্দ আলোচনায় অংশ নেবেন। চতুর্থ আদিবাসী নারী সম্মেলনে এবার সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শতাধিক আদিবাসী নারী ও উন্নয়নকর্মীরা অংশ নিয়েছেন।